হীরক রাজার দেশে-র শেষটা মনে আছে? যেখানে হীরক রাজের বড়ো মূর্তিটা দড়ি বেঁধে মাটিতে ফেলে দেওয়া হয়; সঙ্গে ভেসে আসে ‘দড়ি ধরে মারো টান/ রাজা হবে খান খান’? ব্রিটেনের রাস্তাতেও ভেতরে ভেতরে এমন সুরই বোধহয় বেজে উঠেছিল। ব্রিস্টল আর পার্লামেন্ট স্কোয়ারে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক দুটো ঘটনা তুলে ধরছে প্রতিবাদ। মানুষের অধিকারের দাবি নিয়ে, কালো মানুষদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে যে ঝড় উঠেছে গোটা বিশ্বে, তারই সামনে পড়লেন এডওয়ার্ড কলস্টোন এবং উইনস্টন চার্চিল।
মে-র শেষের দিকে আমেরিকায় এল শ্বেতাঙ্গ পুলিশের হাতে মারা যান জর্জ ফ্লয়েড নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ নিরাপত্তাকর্মী। একবিংশ শতকেও এমন ঘটনায় জ্বলে ওঠে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র; যে আগুন এখনও বহাল। এটা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা তো নয়; কালো মানুষের ওপর শারীরিক, মানসিক অত্যাচার এখনও চলছে অনেক জায়গায়। রেসিজমের বিরুদ্ধে এই প্রতিবাদ আমেরিকার গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে অন্য দেশেও। ব্রিটেনেও সমানে চলছে বিক্ষোভ সমাবেশ। সবার দাবি একটাই, এভাবে কালো মানুষদের ওপর নিপীড়ন বন্ধ করতে হবে। রেসিজম বা বর্ণবিদ্বেষ যেন পুরোপুরি মুছে যায়।
সেই প্রতিবাদই সম্প্রতি গড়াল মূর্তি ভাঙার দিকে। ব্রিস্টল হারবারে প্রতিবাদীরা ঝাঁপিয়ে পড়ল একটি কালো পাথরের মূর্তির ওপর। চোখে কাপড় বেঁধে, দড়ি দিয়ে মাটিতে ভেঙে ফেলা হল তাকে। মূর্তিটি ছিল এডওয়ার্ড কলস্টোন নামের এক ইংরেজ সাহেবের। ১৭-শ শতকের অন্যতম দাস ব্যবসায়ী ছিলেন ইনি। আর দাস ব্যবসা বললেই মনে পড়বে হাজার হাজার কালো মানুষের অবহেলা, অত্যাচারের কথা। তাঁদেরকে মানুষের চোখে দেখা হত না; যখন তখন মেরে ফেলতেও হাত কাঁপত না। সেই প্রথার সঙ্গে জড়িত এক ব্যক্তির মূর্তি কেন আজও থাকবে, এটা নিয়ে আগেও প্রতিরোধ হয়েছিল ব্রিস্টলে। কিন্তু মূর্তি সরেনি। সেই মূর্তিই ভেঙে ফেললেন প্রতিবাদীরা।
আরেকজনও এই প্রতিবাদের সামনে এসে পড়েছেন। তিনি স্বয়ং প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার উইনস্টন চার্চিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তাঁর ভূমিকা, তাঁর প্ল্যান ইত্যাদি নিয়ে অনেক আলোচনা আজও হয়। কিন্তু উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে তাঁর ‘বর্ণবিদ্বেষ’ সত্ত্বার কথাও মনে করিয়ে দেন অনেকে। কীভাবে শুধু তাঁর কিছু সিদ্ধান্তের জন্য বাংলায় দুর্ভিক্ষ তৈরি হয়েছিল, সেটা অনেকেরই জানা। কেবল তাই নয়, এশিয়া ও আফ্রিকায় ব্রিটিশ উপনিবেশের মানুষগুলোর প্রতি চার্চিলের ব্যবহারও ছিল বিদ্বেষমূলক। সেখানকার কালো বা বাদামি চামড়ার মানুষদের ঘৃণার চোখে দেখতেন তিনি। তাঁরা যাতে ‘সভ্য’ হয়, সেজন্যই ব্রিটিশদের তাঁদের শাসন করা উচিত, এমন মনোভাবের কথাও বলেছেন তিনি।
আরও পড়ুন
বিদেশে গবেষণার চাকরি ছেড়ে জৈব খামারের উদ্ভাবক, শিকড়ের টানে ডা. হরি নাথ
আজ তাঁর সেই কথাগুলোই সামনে উঠে আসছে। প্রতিবাদীদের রোষের কবলে পড়েছে চার্চিলের মূর্তি। তাঁর সাধের ব্রিটেনই তাঁকে কাঠগড়ায় তুলেছে। পার্লামেন্ট চত্বরে তাঁর বিশাল মূর্তির সামনে জমায়েত করেছে মানুষ। কখনও মূর্তির ওপর উঠে প্রতিবাদ জানাচ্ছে, কখনও গায়ে লিখে দেওয়া হচ্ছে ‘রেসিস্ট’। ওয়েস্টমিনস্টারেও মূর্তির নিচে চার্চিলের নামের জায়গায় কালো স্প্রে দিয়ে লিখে দেওয়া হয়েছে ‘রেসিস্ট’। নানা ভাবে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন তাঁরা। সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে মানুষের অধিকারের জন্য লড়াইয়ে নেমেছে মানুষই। সে আমেরিকাতেই হোক, কি ব্রিটেন, জার্মানি বা নিউজিল্যান্ডে। দড়ি ধরে টান মারার ডাক দিচ্ছে সবাই…
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
প্যাকিং হয় দুর্গারও, কুমোরটুলি থেকে বিমানে চেপে পাড়ি দেন বিদেশে