চোখে ‘ঘুম’ নেই

মার খেতে খেতে উঠে দাঁড়াচ্ছে প্রেম। ট্যাক্সি ফেঁসে যাচ্ছে জ্যামে। এক লম্বা দাড়ি ড্রাইভার ফোনে বন্ধুকে বলছে সৌদি গেলে অনেক পয়সা। তার উবার গাড়ির গ্যারেজের মালিক এমন অনেক লেবার পাঠায় সেখানে। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনি অঙ্ক। ফ্লাইটের খরচা বাদ দিয়েও ছ’মাসে তিনলাখ রোজগার করিয়ে দেয় সে বন্ধুকে। শুধু মৌলালি থেকে শিয়ালদা আসবার সময়টুকুতে। ওরা কথা বলছে, একে অন্যের কথা শুনছে মাঝেমধ্যে। আমি গান শুনতে শুনতে তাদের কথায় মন রাখছি। প্রতিবার ছেলেটি কথা শুরু করায় চমকে যাচ্ছি আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করছে না তো?

আজ রাস্তায় এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। একটি ছেলে ছুটে আসছে ফুটপাত ধরে, হাতে রঙিন পার্স। পিছনে একদল সিগনালে আটকে চিৎকার করছে। হালকা শুনছি ‘চোর’, পিঠের রুকস্যাক দিয়ে ঠেলে দিয়ে বলি ব্যাগটা ফেলে পালা। ও কথা শোনে। আমার ক্যাফের দিকে হারিয়ে যায় ছেলেটি। আমার হেঁটে আসা রাস্তা ধরে গাছে মিলিয়ে যায়। বাঁচে। যে দল তাড়া করেছে আজ, পেলে আর গোটা ফিরত না!

উচ্চতায় ঘুম আমাদের সকলের চেয়ে উঁচুতে। ভার্টিগোর প্রসঙ্গ তুলতেই ছোট থেকে শুনে এসেছি দার্জিলিং। মেঘে ঢাকা এক স্বপ্নের শহর, তার কিছু আগে এক বৃদ্ধ স্টেশন, সোনাদা। ভেঙে দুমড়ে পড়ে আছে কত ক্লান্তি নিয়ে। সেখানে সুরেলা গলার এক মেয়ে মেঘের কোলে কালো জামা পরে বসে গ্লেনারিজের বারান্দার ছবি দিচ্ছে গতকদিন। আমাদের তিনহাজারি মধ্যবিত্ত বাজেটে মদ ঢুকলে দার্জিলিংকে সরিয়ে দেয় শংকরপুর। আর পাহাড়ে ভয়ের ছুঁতোয় হাত ধরে নেমে যাই সমুদ্রে। কেউ আমার বারমুডা কেউ আমার জামা ধার নিয়ে ডুব দিচ্ছে একইসঙ্গে। যতদিন পকেটে বালি খুঁজে পাব, ভিড় কলকাতায় হাঁটু জল ছলাৎ দেবে আমার অফিস রুটিনে।

শিয়ালদা থেকে ট্রেন ছেড়ে যায়, একটা ম্যাড়ম্যাড়ে ট্রেন জার্নির ভিতর লাল হয়ে সকাল হয়ে যায় ক্ষেতের চালচিত্রে। আমরা দাঁড়িয়ে। সূর্য ছুটে যাচ্ছে এনজেপি-র দিকে। প্রকাশ্যে বিবাদ নেই কারুর। যে ছুটি পাবে সেই ঘুরে আসুক আজ। আমিও কোনওদিন... তবু কেমন যেন মেঘের মাঝে বরফ দেখতে পাচ্ছি এবার। এখানে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে খানিক বেশি। ওখানে অসীম বরফ। তারচেয়ে একটু নীচু পাহাড়গুলো ন্যাড়া মাথায় দাঁড়িয়ে রয়েছে সামনে। বডি কন্ট্যাক্ট গেম হলে ফোর্থম্যানও মেডেল পায়, ব্রোঞ্জ। এখানে যেন একটুর জন্য বরফ পায়নি তারা। ভিক্ট্রি স্ট্যান্ডের নীচে মুখ ফিরিয়ে শহরের দিকে চলে যাচ্ছে।

এমনই এক পাহাড় সিঙ্গালিলা। যাকে নেয় তাকে এতটাই আপন করে নেয় যে ড্রাইভারের চোখ ছলছল করে ওঠে ফেরার দিন। দুটো বাদামি কুকুর পিছনে ছুটতে ছুটতে কাঁদে। গাড়ি থেকে আপ্রাণ হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিই ওদের। মনে হয় অবসর নিচ্ছি। প্রকৃতি প্রকৃতি খেলার মাঝে বারংবার ফোন ঢুকে আসায় ফর্ম পড়ে যাচ্ছে এবার। সতীর্থরা খানিকদূর অব্দি ছুটে এসে মিশে যায় পাহাড়ে। ওখানে একটা স্কুল রয়েছে। কতগুলো হলুদ ইউনিফর্ম পরা ছেলেমেয়ে প্যারেড করে পাশের মাঠে। যেন উৎসব, ড্রাম বাজছে আমার ফেয়ারওয়েলের।

পরাগ ফোনে বিহু শোনায়। চিনিয়ে দেয় লামাহাটা। আদিম পাইনে ঘেরা এক ছোট্ট লেক। আমি তার আকাশ সমান উঁচুতে দাঁড়িয়ে অন্ধকার গুনছি। কোথাও একটা নদীতে যাব আজ। শুনেছি সিঙ্গালিলার পায়ে পায়ে ঝর্না অথচ কাল স্কুটি চালিয়ে যাওয়া নীল পোশাকের পুলিশ মেয়েটি এমন নির্জন থেকে নেমে এল গাড়ির সামনে, আমি তার ঘর খুঁজতে গিয়ে ঝর্না হারালাম। কখনও যাইনি বলেই হয়তো বুঝিনি পাহাড় এক ভাঙা প্রেমের দৃশ্যরূপ। বহু রাস্তা ঘুরে ঘুরে নামতে হয় কাছের জিনিসটিতে। ভেঙে যাওয়া কাঠের ব্রিজে শ্যাওলা জমা দেখে আমি অদৃশ্যের হাত চেপে ধরি। মুহূর্ত পিছলে গেলে তাকে এই স্রোতে খুঁজব কোথায়?

রিয়াং এক রূপকথার নাম। নদী থেকে পায়ের লোমে জল নিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছি গাড়ির দিকে। পিছনে কেউ চোর বলে তাড়া করেনি এখানে। সামনে কেউ জল ফেলে দিয়ে পালাতেও বলল না। কেবল একটা ফাঁকা ব্রিজের গায়ে ফৎফৎ করে উড়ে যাচ্ছে রঙিন পতাকা। চারপাশে তার ওড়ার শব্দ। আমাদের পাঁচজনের নিঃশ্বাস ছাড়া অন্যদিন একা নদীই তার শব্দ শোনে। যদি কখনও ভেবে থাকি পাহাড় কেমন হবে-র মতো একটা চায়ের দোকান এখানে। কবে কে আসবে না জেনেই বসে রয়েছে। দু একরকম খাবার বানিয়ে দেবে বুড়ো। হোমস্টের লোডশেডিং-এ বারংবার এনে বসাচ্ছি তাকে। টলোমলো নেশায় সে ভাত বেড়ে দিচ্ছে। গোল থালার উপর পাহাড়প্রমাণ ভাত। বাঁহাতে ধারালো হাতা দিয়ে সেই পাহাড় দুভাগ করছেন বৃদ্ধ। তাতে ডালের ঝর্না নামাচ্ছেন। ঢ্যাঁড়সের গাছপালা পুঁতে দিচ্ছেন খাদের দিকে। একটা আলু তুলে মুখে ভরতেই হুড়হুড় করে ধস নেমে যায় সাদা থালার সিঙ্গালিলায়।

এখান থেকে বাঁদিকে উপরে উঠে গেলেই ডাও হিল। পরাগ দেখাল রাস্তাটা। সেখানে গাছে গাছে কুয়াশা বোনা। লম্বা লম্বা গুঁড়ি আর অন্ধকার সব খাদ। তেমন খিদে পাচ্ছে না আর। নেশাও চড়ছে না কিছুতেই। ঘরে মেঘ ঢুকে আসছে, কম্বলে বৃষ্টি ঢেকে শুয়ে দেখছি কাঠের চাল। ঝিরঝির শব্দ পড়ছে তাতে। যে এই হোমস্টে চালায়, ছেলেটি ভাই বলে ডাকছে আমাদের। তারপর মোমবাতি দিয়ে যাচ্ছে। খাবার পৌঁছে দিচ্ছে ঘরে। দরজা খোলার আগে দেখতে পেলাম পিছনে তার ছোট বোন। কিছুক্ষণ আগে ফাঁকা গ্লাস যার হাতে পাঠিয়েছে দেখে বেশ লজ্জায় পড়েছি। এবার নিজের পিছনে লুকালাম সেই গ্লাস। মোমের আলোয় ঘরে খাবার দিয়ে ফিরে গেল ওরা। ওদের ঘর মেঘের ওপাশে। একটু নীচে। একটা চারপেয়ে মেঘের দলা ওদের ঘর থেকে ছুটে আসে আমার ঘরে, খেলাধুলো করে ফিরে যায়। আবার কখনও ফিরে এলে ওর জন্যই হয়তো থেকে যেতে পারি আহালদারায়।

কালকে দার্জিলিং। খানিক আমার বায়নায়। ব্যাগ খুলে টাকা গুনছি এখন, হতেই হবে, বাজেটে না কুলালেও যেতে হবে একবার অন্তত। ওখানে এখন বৃষ্টি, মেঘ। গ্লেনারিজের দক্ষিণ খোপে একটা লাল কোট পরা নেপালি মেয়ে আমার টেবিলে ফেলে আসা চশমা কুড়িয়ে নেবে। ম্যালে হাঁটতে এই মেঘলাদিনেও দেখা হবে রোদ্দুরের সঙ্গে। ও মদ খেতে ডাকবে, আমি বাড়ি ফেরার তাড়া আছে বলে বুঝতে পারব এখানে কোনও বাড়ি নেই আমার। এখানে ছাতা ভাঙলে কেউ ধারে সারিয়ে দেবে না কোনওদিন। ভাবলে বুক হু হু করে ওঠে। গত রাস্তায় যারা হাত দেখিয়ে এ গাড়ি থামাতে পারেনি, তাদের ওই এক ধাঁচের মুখ আমি স্বপ্নে ভেবেছি কতবার!

রেস্তোঁরার কাচে লেখা রয়েছে ‘আ মিল উইদআউট ওয়াইন ইজ কলড ব্রেকফাস্ট’। এবারের মতো ছাতা উল্টে গেল ঢালু রাস্তায়। ফেরার পথে টয়ট্রেন দেখতে পেলাম কয়েকবার। ‘ঘুম’ যে এত বে-আব্রু হতে পারে জানতাম না কোনওদিন। পাশের সিট থেকে হালকা শব্দে ভেসে এল ‘গুলি কাঁদছে?’। গুলি সানগ্লাস পরেছে। গুলি গোটা পাহাড়কে পিছনে ফেলে একটা চেনা পিস্টনের দিকে দৌড়ে নেমে যাচ্ছে নিজের অজান্তে। গাড়িটা একটু থামাবে দাদা? নামতাম!