আজ থেকে প্রায় ছ’দশক আগের কথা। ষাটের দশকের শুরুর দিক ছিল সেটা। ক্রান্তীয় অরণ্য বা রেইনফরেস্টে সীমাহীন বৃক্ষচ্ছেদনের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন তিনি। আমাজনকে বাঁচাতে হেঁটেছিলেন আন্দোলনের পথে। আজ বিশ্ব উষ্ণায়ন, বৃক্ষচ্ছেদন, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে গোটা বিশ্বজুড়েই চর্চা হলেও সেসময় বিষয়টি ছিল একেবারেই অনালোচিত। টমাস ই. লাভজয় (Thomas E. Lovejoy)। গত ২৫ ডিসেম্বর উৎসবের দিনেই বিদায় নিলেন বিশিষ্ট সংরক্ষণবিদ (Conservationist) এবং প্রভাবশালী জীববিজ্ঞানী। বয়স হয়েছিল ৮০ বছর।
এই যুগের অন্যতম সংরক্ষণবিদ ও জীববিজ্ঞানী হলেও, গোটা পৃথিবীর কাছে তাঁর পরিচয় ‘জীববৈচিত্র’-এর (Biodiversity) জনক হিসাবেই। এই শব্দবন্ধটির জন্ম দিয়েছিলেন তিনিই। সেটা সত্তরের দশক। ব্রাজিল-সহ ল্যাটিন আমেরিকার আমাজনিয়ান ক্রান্তীয় অরণ্যের সংরক্ষণের দাবিতে তিনি লড়াই করছেন একাধিক আন্তর্জাতিক সংগঠন ও সংশ্লিষ্ট দেশগুলির প্রশাসনের সঙ্গে। সেই সময়েই তাঁর রিপোর্টে প্রথম উল্লেখিত হয় ‘জীববৈচিত্র’ বা ‘বায়ো ডায়ভার্সিটি’ শব্দটি। প্রাণের সংখ্যা বা ঘনত্ব নয়, বরং বৈচিত্রময় বিভিন্ন প্রজাতির সহাবস্থানেই বিশেষভাবে জোর দিয়েছিলেন টমাস লাভজয়। দেখিয়েছিলেন, পরিবেশ ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে সমানুপাতিকভাবেই হ্রাস পেতে থাকে জীব প্রজাতির সংখ্যাও। পাশাপাশি, জলবায়ু পরিবর্তন বাস্তুতন্ত্রকে কীভাবে প্রভাবিত করে, তাও প্রথমবারের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপন করেছিলেন তিনি।
শুধু বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল খণ্ডিতকরণের প্রভাব উপস্থাপনই নয়, প্রশাসনের বিমুখতা দেখে সত্তরের দশকে পরিবেশ রক্ষায় তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আস্ত একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। উদ্যোগ নিয়েছিলেন বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য বিশেষ তহবিল গঠনের। পাশাপাশি এই লড়াই যে, একার পক্ষে লড়ে যাওয়া সম্ভব নয় তা ভালোই বুঝেছিলেন টমাস। সার্বিকভাবে তাই সাধারণ মানুষকে আন্দোলনে সামিল করতে তিনি শুরু করেছিলেন টেলিভিশন শো। ‘নেচার’-খ্যাত সেই অনুষ্ঠানে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট, বাস্তুতন্ত্র ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব-সহ একাধিক বিষয় তিনি তুলে আনতেন সাধারণের জন্য। সচেতনতামূলক প্রচারকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে অনুষ্ঠানে হাজির করতেন নানান বিশিষ্ট ব্যক্তি, রাজনীতিবিদদের। বিজ্ঞানীমহল তো বটেই, পরবর্তীকালে যা অনুপ্রাণিত করেছিল অগণিত মানুষকে। সামিল করেছিল বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আন্দোলনে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে আধুনিক সংরক্ষণ প্রকল্পের অন্যতম পথিকৃৎ এবং আদি ‘বায়ো-পলিটিশিয়ান’ বলা চলে তাঁকে।
এই আন্দোলনের জন্য ল্যাটিন আমেরিকায় একাধিকবার প্রতিকূলতার সম্মুখীনও হতে হয়েছিল কিংবদন্তি জীববিজ্ঞানীকে। কখনো তাঁর কাছে পৌঁছেছিল প্রাণনাশের হুমকিও। তবে এসবের পরেও দমেননি টমাস। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে কাজ করতে কোনোদিনই পছন্দ করতেন না টমাস। বরং, তাঁর কর্মক্ষেত্র ছিল প্রকৃতির উন্মুক্তাঙ্গন। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সক্রিয়ভাবেই তিনি জড়িয়ে ছিলেন সেই কার্যকলাপ এবং সংরক্ষণ প্রকল্পের সঙ্গে। বিশ্বব্যাঙ্ক, জাতিসংঘ, নেচার ফাউন্ডেশন-সহ অসংখ্য বৈশ্বিক সংস্থার পরামর্শদাতা এবং উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করেছেন শেষ বয়সেও।
আরও পড়ুন
সমুদ্রের জলও সহজে পানযোগ্য, দিশা দেখাচ্ছেন ভারতীয় বিজ্ঞানীরা
বাস্তুতন্ত্রের সংরক্ষণে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য টাইলার পুরস্কার থেকে শুরু করে ফাউন্ডেশন ফ্রন্টিয়ার্স অফ নলেজ অ্যাওয়ার্ড, ব্লু প্ল্যানেট অ্যাওয়ার্ড-সহ একাধিক সম্মাননা রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। তবে এত কিছুর পরেও কেবলমাত্র ‘জীববৈচিত্র’-এর জনক হিসাবেই পরিচিত রয়ে গেছেন তিনি। এমন একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্বের প্রয়াণে বিরাট শূন্যস্থান তৈরি হল সংরক্ষণ আন্দোলনের জগতে।
আরও পড়ুন
গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার স্বীকৃতি, ইএমবিও-র ‘ইয়ং লিডার’ দুই বাঙালি বিজ্ঞানী
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
যুদ্ধের ব্যয় কমিয়ে বিনিয়োগ হোক পরিবেশ-সমস্যায়, দাবি নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীদের