না চাইলেও থামতে হয় – অবসরে সেটাই বুঝিয়ে দিলে, প্রিয় ক্যাসিয়াস

প্রিয় ক্যাসিয়াস, 

কীভাবে শুরু করব জানি না। আসলে কী জানো, আবেগ ভালোবাসা কীভাবে জন্ম নেয় তা আমি বুঝে উঠতেই পারিনি কোনোদিন। তবু কেন জানি না আজ বড্ড লিখতে ইচ্ছে করছে তোমায়। জানো ক্যাসিয়াস, চিরকাল থেমে যাওয়াকে হারের প্রতীক হিসাবে শেখানো হয়েছে আমাদের। দেখানো হয়েছে পরাজয়ের চিহ্ন হিসাবে। তবুও তো থামতে হয় একদিন, কখনও নিজের অজান্তেই সম্পূর্ণ যাত্রাপথে পড়ে যায় একটা দাঁড়ি। আসলে সবাই থামতে জানে না। থামতে জানাটাও যে একটা শিক্ষা এটা কেউ বুঝলই না কোনোদিন! 

মনে আছে তোমার, যেদিন সবার মতো বল জালে জড়ানোর বদলে বেছে নিয়েছিলে বল থামানোকে। পায়ে বুটের সঙ্গে হাতে আগলে নিয়েছিলো গ্লাভসটাকেও। তারপর। লা ফ্যাব্রিকা। প্রথম দল। রিজার্ভ বেঞ্চ। চ্যাম্পিয়ান্স লিগ। ফাইনাল ৷ ভ্যালেন্সিয়ার হারের সঙ্গে সঙ্গে তৈরি করলে রূপকথা। পৃথিবী প্রথম দেখল এক বছর আঠারোর ছেলের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে ওঠার গল্প ৷ কেঁদেছিলে সেদিন? জানি না। তবে আমি কেঁদেছিলাম জানো। যেদিন দাদু চলে গেল। অবশ। নিশ্চুপ। আগেরদিন পর্যন্ত হেসে ওঠা মুখটা সেদিন অকাতরে চেয়েছিল আমার দিকে। কষ্ট পাচ্ছিল খুব। তাই থামতে হল। আচ্ছা, থামা মানেই কি মুক্তি? থামা মানেই কি আসলে হেরে যাওয়া? আমার মনে আছে। ২০১০। সাউথ আফ্রিকা। সুইজারল্যান্ড। প্রথমেই  হোঁচট খেলে তুমি। রাগ। কটাক্ষ। চিৎকার। আছড়ে পড়ল। মুখ ফিরিয়ে নিলো সহধর্মিনীও। তবুও তো থামোনি সেদিন। বরং থামিয়েছিলে। পর্তুগাল। প্যারাগুয়ে। জার্মানি। নেদারল্যান্ডস। বাঁপা।  আর্জেন রোবেন। যখন থামলে, তখন সবটা বদলে গেছে।স্পেনে আছড়ে পড়ছে আনন্দের ঢেউ। তোমার ঠোঁটে লেপ্টে যাচ্ছে প্রাণের  মানুষের ঠোঁট। কোনো কোনো মুহূর্তে থামাও কত সুন্দর, তুমি বুঝেছিলে সেদিন। তোমায় মুগ্ধ হয়ে দেখেছিলাম। কিন্তু পারিনি। পারিনি কোনোদিন। রাগ হলে মায়ের উপর না চেঁচিয়ে থাকতে। আঘাত দেওয়া প্রতিটা মানুষকে ভালোবাসায় আগলে নিতে। আসলে থামা, আর থামানো সবাই একসঙ্গে ব্যালেন্স করতে পারে না। তুমি পারতে। তুমি পেরেছিলে! 

তোমার মনে পড়ে, স্পেন। রাউল, হেলগুয়েরা, মোরিয়েন্তেস, দ্যাসেইনা, নাদালদের স্পেন। প্রতিবার অসামান্য টিম নিয়েও হার। ভরাডুবি। ঝামেলা। দলের আগে রিয়েল বার্সা আবেগ। দ্বন্দ্ব। তারপর। তুমি এলে। হাতে আর্মব্যান্ড। পাশে পুয়োল। জাভি। আন্দ্রেস। পিকে। র‍্যামোস। অলোন্সো। স্পেন। দেশ। তোমার দেশ। সমস্ত দ্বন্দ্বের পরিসমাপ্তি। জন্ম এক রূপকথার। আজও থামা শব্দটা মনে পড়লে তোমার দিকে তাকাই। থামানো শব্দটা মনে পড়লে তোমার দিকে তাকাই। তুমি নিশ্চয় ভোলোনি। ২০০২। ট্রফি। তারপর। আকাল। বাড়তে থাকা খিদে। ২০০৯। রোনাল্ডো। ওজিল। ডি মারিয়া। বেঞ্জিমা। হটসিটে স্পেশাল ওয়ান। কিন্তু বিপক্ষে বার্সা। পেপের বার্সা। জাভি। লিও। আন্দ্রেসের বার্সা। স্বপ্নের বার্সা। পারলে না। তবুও তো থামোনি সেদিন। তারপর ২০১৪৷ এবার হটসিটে কার্লো। এসি মিলানকে সব কিছু উজাড় করে দেওয়া কার্লো। বিপক্ষে অ্যাটলেটিকো। দিয়েগো সিমিওনে। ৯২.৪৮ মিনিট৷ র‍্যামোস। পারলে তুমি। আবার। দশ বছর পর আবারও লিখলে রূপকথা। পূর্ণ করলে লা ডেসিমা। বছর ষোলোতে লা ফ্যাব্রিকাতে যুক্ত হওয়া একটা ছেলে হয়ে উঠলো মাদ্রিদের অবিসংবাদিত রাজা। 

কিন্তু সর্বশ্রেষ্ঠ রাজারও সাম্রাজ্যের পতন যে নিশ্চিত তা ভুলেছিলে তুমি। তাই কান্না। বিদায়। তোমার মায়ের চোখ দিয়ে ঝরে পড়া জল।  নো ফেয়ারওয়েল। তবুও থামলে না তুমি। চলে গেলে পর্তুগাল। পোর্তো। সব থেকে কম বয়সী হিসাবে চ্যাম্পিয়ানস লিগ খেলার কৃতিত্ব অর্জন করা সেই বছর ষোলোর ছেলেটা আজ সবথেকে বেশি ক্যাপের মালিক। এগোচ্ছিলে।  ভালোবেসে। এই বয়সেও প্রতিটা দিন উজাড় করে দিচ্ছিলে নিজেকে। আর আমার মনে পড়ছিল বাবার কথা। কোনোদিন ভালোবাসা বুঝতে দিত না জানো৷ লুকিয়ে রাখত নিজেকে। কিন্তু কলকাতা ছাড়ার বিমান ধরলাম যেদিন, বাবার চোখে তাকিয়েছিলাম আমি। তাতে মিশেছিল থামিয়ে দেওয়ার একটা অব্যক্ত আবদার। একটা চিন্তাজড়ানো চোখে ভালোবাসা মাখানো থেমে যাওয়ার আর্তি। ফিরে গিয়ে জড়িয়ে ধরেছিলাম। আজও সেদিনের কথা মনে পড়লে আমি তোমার দিকে দেখি। দায়িত্বের কথা মনে পড়লে তোমার দিকে দেখি!

আরও পড়ুন
বুটজোড়া তুলে রাখলেন আন্দ্রে শার্লা, অথচ কথা ছিল লেফট উইং-এ ফুল ফোটানোর

কিন্তু হঠাৎ কী যেন হয়ে গেল। একটা এমন শট আছড়ে পড়লো তোমার দিকে যাকে তুমি আটকে দিলেও তা থামিয়ে দিল তোমাকেও। এই প্রথম না চাইতেও থামতে হল তোমায়। থামতে হল এক অপ্রত্যাশিতভাবে আছড়ে পড়া বাধার সামনে। তবুও তো ফিরে এসেছিলে আবার। প্রতিটা বিপত্তিকে দুহাতে আগলে নিয়ে এত বছর হেঁটে আসার পরও তোমার ইচ্ছেশক্তিতে বিন্দুমাত্র ভাটা পড়তে দাওনি। কোচিং টিম। স্ট্রাটেজি। ট্যাকটিক্স। কাজ চলছিল। কিন্তু আবারও একবার মাঠে ফেরার ইচ্ছেটাকে ভুলতে পারছিলে না তুমি। তেকাঠির প্রতিটা প্রান্তর যেন তোমায় ডাকছিল। হাতছানি দিচ্ছিল পেনাল্টি বক্সের প্রতিটা ঘাস। যেখানে সারাটা জীবন রাজত্ব করেছ তুমি। 

কিন্তু জীবন সে অনুমতি দিল না। তুমি বুঝলে কখনও কখনও না চাইলেও থামতে হয়। জীবনের প্রতিটা বাধাকে নিঃশব্দে ফিস্ট করে আসা তুমি সেদিন আবারও উপলব্ধি করলে থামা আর থামতে জানার মাহাত্ম্যকে। কহিঁ পর পহঁচনেকে লিয়ে কহিঁসে নিকলনা বহত জরুরি হোতা হ্যায়। কোথাও পৌঁছানোর জন্য, কোথাও থেকে বেরিয়ে আসা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। তাই লিও। রোবেন। ফোরলান।  ভিয়া, এটো। জেরার্ড। মুলারকে স্বহস্তে থামিয়ে আসা তুমি আজ নিজেও থামলে। থামতে বাধ্য হলে। শেষ হল একটা অধ্যায়। একটা যুগ। হয়তো এখান থেকেই আবার কোনো নতুন গল্পের সূচনা হবে। তুমি ফিরে আসবে অন্য কোনোভাবে। অন্য কোনো রূপে। সময়রেখা জানান দেবে এভ্রি এন্ড ইজ আ নিউ বিগিনিং। থেমে যাওয়ার সংজ্ঞা আজীবনের মত বদলে যাবে সেদিন, আর এক বহুল পরিচিত বাক্য প্রতিধ্বনিত হবে সমগ্র আকাশজুড়ে, There won't be any full stops in success, there would be only commas. Success is not a destination, Success is a Journey. 

ভালো থেকো ইকর। ভালোবাসায় থেকো! 

আরও পড়ুন
কী যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে, যদি না মোহনবাগানী হয়!

ইতি সেই ছেলেটা, 

যে তোমার প্রাণের ক্লাবকে 

ভালোবেসে আপন করতে পারেনি কোনোদিন!

আরও পড়ুন
মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এলেন যুবরাজ, ক্রিকেটের সঙ্গে শেখালেন জীবনেরও পাঠ

Powered by Froala Editor

More From Author See More