প্রকাশ্যে এনেছিলেন ঠান্ডা যুদ্ধের পটভূমি, প্রয়াত কিংবদন্তি ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক জন লি ক্যারে

‘দ্য স্পাই হু কেম ইন ইন দ্য কোল্ড অ্যান্ড টিঙ্কার’— বিখ্যাত সেই গ্রন্থের রচয়িতা তিনি। সামনে এনেছিলেন, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের বাইরেও যে ভয়াবহ কূটনৈতিক লড়াই চলে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে। ব্রিটেনের ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির কার্যকলাপকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন উপন্যাস-চিত্রণে। প্রখ্যাত ব্রিটিশ সাহিত্যিক এবং সাবেক গুপ্তচর জন রি ক্যারে প্রয়াত হলেন। আক্রান্ত হয়েছিলেন নিউমোনিয়ায়। ব্রিটেনের একটি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন বেশ কয়েকদিন ধরেই। শনিবার ৮৯ বছর বয়সে থেমে গেল লড়াই।

তবে জন লি ক্যারে নামে পরিচিত হলেও তাঁর আসল নাম ডেভিড জন কর্নওয়েল। ১৯৩১ সালে ইংল্যান্ডের ছোট্ট শহর ‘পুলে’-তে জন্ম জন লি’র। তবে ছোটোবেলা বড় হয়ে ওঠা এক অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যে। জ্ঞান হওয়ার আগেই সংসার ছেড়ে যায় তাঁর মা। ছোট্ট ভাই আর তাঁর বড়ো হয়ে ওঠা সম্পূর্ণ বাবার কাছেই। তারপরই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ধীরে ধীরে বাড়ছিল আর্থিক অনটন। কাজও হারালেন বাবা। শুরু হল দেনায় ডুবে যাওয়া আস্তে আস্তে। তবে তার মধ্যেও মনের জেদেই তিনি চালিয়ে গেলেন পড়াশোনা।

যুদ্ধোত্তর সময়ে নতুন করে বীমার ব্যবসা শুরু করেন জন লি’র বাবা। সেখানেও সংসার চালাতে বাধ্য হয়েই জালিয়াতি। সেইসঙ্গে নেশায় ডুবে যাওয়া। অবশেষে পুলিশের কাছে গ্রেপ্তার হতে হল তাঁকেও। নিজের পৃথিবীটাই যেন ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে যাচ্ছিল জন লি’র। জেল থেকে বাবা ছাড়া পাওয়ার পরেও সে সম্পর্কে আর জোড়া লাগেনি। বাবা মৃত্যুর পর কেবলমাত্র শ্রদ্ধা জানাতে শেষকৃত্যে উপস্থিত ছিলেন জন।

ইংল্যান্ডে বড়ো হয়ে উঠলেও বিশেষ করে জার্মান ভাষার ওপর একটা আকর্ষণ তাঁর ছিলই ছোটো থেকে। ১৯৪৮ সালে বৈদেশিক ভাষা নিয়েই তিনি পড়াশোনা করেন সুইজারল্যান্ডের বার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৫০ সালে দেশে ফিরে রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। পড়াশোনা চলাকালীন সময় থেকেই ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্সে শুরু হয় কাজ করা। সেটা ১৯৫২ সাল। যোগ দিলেন এমআই৫-এ। সোভিয়েত ইউনিয়নের খবরাখবর নিতেই শুরু হল গুপ্তচরবৃত্তি। 

১৯৫৪ সালে শিক্ষকতা শুরু করেন মিলফিল্ড প্রিপেয়ারেটরি স্কুল। সামরিক শিক্ষা এবং বিভিন্ন ফ্রেঞ্চ ও জার্মান ভাষার প্রশিক্ষা দিতেন তরুণ সৈনিকদের। চার বছর পর ১৯৫৮ সালে দায়িত্ব নেন এমআই৫-এ সক্রিয় অফিসার হিসাবে। বছর দুয়েকের মধ্যে পদোন্নতি হয়ে এমআই৬-এ বদলি হন তিনি। 

তবে এমআই৬-এ খুব একটা সুখকর হয়নি চাকরি। বছর চারেক পরই অভিযোগের আঙুল ওঠে তাঁর দিকে। গুপ্তচরবৃত্তিতে দেশের খবর বিপক্ষের হাতে তুলে দিচ্ছেন তিনি, উচ্চপদস্ত আধিকারিকদের থেকে এমনটাই সন্দেহ ওঠে সেইসময়। ১৯৬৪ সালে সেই অভিযোগেই বরখাস্ত করা হয় তাঁকে।

আরও পড়ুন
শেষ হল কান্ট্রি মিউজিকের একটি অধ্যায়, প্রয়াত কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী চার্লি প্রাইড

এমআই৬-এ কর্মরত অবস্থাতেই লেখালিখির জগতে প্রবেশ করেছিলেন জন লি। ১৯৬১ সালেই প্রকাশিত হয়েছিল প্রথম বই ‘বার্লিন ওয়াল’। প্রথম থেকেই লেখার বিষয় হিসাবে উঠে এসেছিল যুদ্ধ। বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিকে শুরু থেকেই উপন্যাসে তুলে ধরার চেষ্টা করে গেছেন তিনি। পরবর্তীকালে নিজের উপলব্ধ ঠাণ্ডা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটকেও ধরেছেন কথাসাহিত্যে। দেখিয়েছেন ক্রূর কূটনৈতিক বাস্তবকে।

তবে তাঁর লেখার বিশেষত্ব হল যুদ্ধ কেন্দ্রিক উপন্যাসগুলির নায়ক কিন্তু কখনোই যোদ্ধা বা ইন্টেলিজেন্ট এজেন্টরা নন। বলা যায় জেমস বন্ডের প্রতিষেধক। জেমস বন্ডকে যেমন নায়কোচিত চরিত্র হিসাবেই দেখা যায় উপন্যাসের পাতায় কিংবা সেলুলয়েড স্ক্রিনে। তাঁর গল্পের এই একই ধরণের চরিত্ররা আসলে ‘অ্যান্টি-হিরো’ সকলেই। এককথায় বিংশ শতকের মধ্যভাগের বৈশ্বিক রাজনীতির লিখিত দলিলই রচনা করে গেছেন জল লি ক্যারে।

সব মিলিয়ে লিখেছেন ২৫টির বেশি বই। তার মধ্যে বেশ কয়েকট উপন্যাসের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে সিনেমাও। ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর শেষ বই ‘স্টোরিস অফ মাই লাইফ’। যা একপ্রকার প্রশ্ন তোলে ব্রিটিশ ইনটেলিজেন্স এবং প্রশাসনের দিকেই। তবে শুধু লেখাতেই নয় ব্যক্তিগত জীবনেও বারবার সরাসরি বিরোধিতা করেছেন তিনি। ব্রেক্সিটে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বোরিস জনসনের বিপক্ষেও তুলেছিলেন একাধিক প্রশ্ন। খোলা চিঠি পাঠিয়েছেন লেবার পার্টিতে। বারবার খুঁজেছেন মুক্তির খোঁজ।

আরও পড়ুন
ভারতীয় নৃত্যশৈলীতে এনেছিলেন আধুনিকতার ছোঁয়া, প্রয়াত কিংবদন্তি শিল্পী আস্তাদ দেবু

কিংবদন্তির মৃত্যুতে শুধু ব্রিটেনই নয় শোকস্তব্ধ বিশ্বের পাঠক থেকে লেখক, সব মহলই। শ্রদ্ধা জানিয়েছেন স্টিফেন কিং, রবার্ট হ্যারিস, মার্গারেট অ্যাটউড প্রমুখ কথা সাহিত্যিকরা। এভাবেই যেন ইতিহাস এবং ব্রিটিশ সাহিত্যের একটা অধ্যায়ের পাতা উলটে গেল নিশ্চুপেই...

Powered by Froala Editor

More From Author See More