১৯৪৭: ভাঙা বাংলার প্রথম দুর্গাপুজো

১৩ অক্টোবর। ভোর থেকেই কলকাতার গঙ্গার ঘাটগুলোয় তর্পণের ভিড়। আকাশবাণী-তে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ শুরু হয়ে শেষও হয়ে এসেছে। গার্স্টিন প্লেসের বাড়িটায় সবাই একত্রে জড়ো হয়েই অনুষ্ঠান করেন, লাইভ। এমনই হয়ে এসেছে গোড়া থেকে, হবেও আরও কিছু বছর। আশ্বিনের আবহ সর্বত্র। এসবের মধ্যেই কাগজওয়ালারা বাড়ি-বাড়ি পৌঁছে দিলেন কাগজ। মহালয়ার সকাল; পুজোর মেজাজ নিশ্চয়ই ধরা থাকবে সংবাদপত্রেও! কিন্তু কোথায় কী! যুগান্তরের প্রথম পাতার হেডলাইন— ‘বহু মুসলমান ও মন্ত্রিসভার সদিচ্ছা সত্ত্বেও পূর্ব্ববঙ্গে অশান্তির আতঙ্ক’। 

১৩ অক্টোবর। সাল ১৯৪৭। দু-মাসও সম্পূর্ণ হয়নি দেশভাগের। দেখতে দেখতে চলে এল মহালয়া। উৎসবের মরশুম। কিন্তু মানুষের মনে কি উৎসবের হাওয়া বইছে আদৌ? এই দু’মাস খবরের কাগজ খুললেই তো কোনো-না-কোনো অশান্তির খবর। নইলে আতঙ্ক। ওপার বাংলা থেকে দলে দলে মানুষজন চলে আসছেন এপারে। পূর্ববঙ্গের ইতিউতি হামলার খবর। অবশ্য একটা চাপা অশান্তি চলছিল গতবছর থেকেই। আগস্টে কলকাতায় দাঙ্গা হল, তারপর নোয়াখালি-সহ আরও কত জায়গায়। দেশভাগের পর আক্রোশ বাড়ল বই কমল না। রোজই কিছু-না-কিছু লেগেই আছে ওপারে। আর এসবের মধ্যেই চলে এল পুজো।

সে-বছরের যুগান্তর পত্রিকার কলকাতা সংস্করণের সংখ্যাগুলো উল্টেপাল্টে দেখছিলাম। পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন অন্যতম প্রধান দৈনিক সংবাদপত্র। পড়তে পড়তে, খানিক আন্দাজ পাওয়া যায় সেই বছরের দুর্গাপুজোর। হ্যাঁ, এখনকার মতো তখনও পুজোর কটাদিন পত্রিকার মুদ্রণ বন্ধ থাকত। কিন্তু তার আগে-পরের দিনগুলোর খবর মন দিয়ে পড়লে, ছবিটা আন্দাজ করে নিতে অসুবিধা হয় না কোনো।

যেমন মহালয়ার পরের দিনের কাগজটি। ১৪ অক্টোবর, ১৯৪৭। একটি খবরের শিরোনাম— ‘দুর্গাপূজা ও বকর ঈদ উপলক্ষে ঢাকায় শান্তিরক্ষার জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টা’। ভেতরের খবর থেকে জানা যায়, ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের উদ্যোগে একটা মিটিং আয়োজিত হয়েছিল। সেই মিটিং-এ সিদ্ধান্ত হয়, প্রত্যেক বছরের মতো এ-বছরও হিন্দু বাড়িগুলিতে নির্বিঘ্নেই দুর্গাপুজো হবে।

এমন সিদ্ধান্ত নিতে হল কেন? কারণটা সহজেই বোঝা যায়। ধর্মের ভিত্তিতে জন্ম নেওয়া পূর্ব পাকিস্তান; সেখানে অন্য ধর্মের লোকেরা নিজ ধর্মাচরণ কতটা নির্বিঘ্নে করতে পারবেন— তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতই। ফলে, ‘বরাভয়’ দিতে হচ্ছে প্রশাসকদের। আট দফা পরিকল্পনা জারি করে বেঁধে ফেলতে হচ্ছে মানুষদের।

এদিকে, ঠিক পরেরদিনই কাগজে ছাপা হচ্ছে আরেকটি খবর। কলকাতার ভূতপূর্ব মেয়র ও কলকাতা জেলা মুসলিম লিগের সেক্রেটারি এস এম ওসমান প্রেস বিবৃতিতে জানিয়েছেন, আসন্ন দুর্গাপূজা ও বকরি ইদ উপলক্ষে ‘পূর্ব্ব পাকিস্তানে শান্তিভঙ্গ হইলে মুসলমানগণই দায়ী হইবে’। তিনি বলছেন, ‘বর্তমানে যে সময় স্বাধীনতা লাভ হইয়াছে, সেই সময়ে মুসলমান ও হিন্দুদের এই দুইটি বিরাট উৎসব উপলক্ষে ভ্রাতৃভাব প্রতিষ্ঠার সুযোগ গ্রহণ করা হইবে বলিয়াই আমি বিশ্বাস করি।’

অবশ্য এসবের মধ্যেও অন্য-অন্য ছোটো-বড়ো খবরে অশান্তির ছবি উঠে আসছেই। কখনও বাস্তুত্যাগীদের ওপর আক্রমণ, কখনও ঢাকা কালীবাড়িতে বাজনায় আপত্তি, কখনও আবার চট্টগ্রামে অশান্তি। এসবের হাত ধরেই এগিয়ে আসছে দুর্গাপুজো। 

কলকাতাতেও কি তেমনই সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল কিছু? এমনটা মনে হচ্ছে তৎকালীন পুলিশ কমিশনারের একটি বিবৃতি দেখে। পার্ক সার্কাসের এক জনসভায় তিনি বলেন, কলকাতায় হাঙ্গামা হতে দেওয়া হবে না কিছুতেই। সেই লক্ষ্য নিয়ে কলকাতা পুলিশের সাহায্যার্থে ১০০০ যুবককে নিয়ে তৈরি হবে ‘জাতীয় সেবক বাহিনী’ও। কী কাজ এই বাহিনীর? ‘সাম্প্রদায়িক মনোভাবের ঊর্দ্ধে রহিয়া জনসাধারণেরই সেবা করিয়া যাইবে।’ 

অন্যদিকে নোয়াখালির ফরোয়ার্ড ব্লকের নেতা টেলিগ্রামে আশ্বস্ত করছেন, পুজোয় গোলোযোগের সম্ভাবনা নেই। সমস্ত নোয়াখালি জেলা ঘুরে দেখেই তাঁর এই উপলব্ধি। ঢাকায় কিন্তু ততক্ষণে ১৪৪ ধারা জারি হয়ে গেছে। ৩০ অক্টোবর অর্থাৎ লক্ষ্মীপুজো পর্যন্ত বলবৎ থাকবে এই নির্দেশ। অশান্তি এড়াতেই যে এই পদক্ষেপ, তাতে কোনো সন্দেহই নেই। ভেতরে-ভেতরে পরিস্থিতি কী পরিমাণ উত্তপ্ত থাকলে ১৪৪ ধারা জারি করতে হয়, তা সহজেই অনুমেয়। 

১৭ অক্টোবরের সংবাদপত্র থেকে জানতে পারি পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষের বক্তব্য। পূজা ও ঈদে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় রাখার আবেদন জানান তিনি। যুগান্তরের ভাষায়, ‘পশ্চিমবঙ্গে একজন মুসলমানও ভয়ে কোরবাণি বন্ধ করে এবং একজন হিন্দুও ভয়ে পূজা বন্ধ করে, তাহা তিনি চান না।’

এদিকে পুজো ক্রমে এগিয়ে আসছে। ঢাকার পাশাপাশি, ১৪৪ ধারা জারি হয়ে গিয়েছে খুলনাতেও। পশ্চিমবঙ্গের প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ ও পূর্ববঙ্গের খাজা নাজিমুদ্দিন যৌথ বিবৃতি দিচ্ছেন, ‘পশ্চিম ও পূর্ব্ব উভয় বঙ্গের গভর্ণমেন্টই শান্তিরক্ষা এবং সাম্প্রদায়িক শুভেচ্ছামূলক আবহাওয়া সৃষ্টির জন্য দৃঢ়সংকল্প।’ তাঁদের কথায়, ‘আমরা স্বাধীনতা লাভ করিয়াছি কিন্তু আজ আমরা চরম পরীক্ষার সম্মুখীন। আমরা আশা করিতে পারি যে, আমরা বিবেক, বুদ্ধি ও সৎসাহস হারাইব না এবং আমাদের দেশবাসীকে সুখী ও সমৃদ্ধিশালী করিতে সক্ষম হইব।’

বাংলা ভাগ হয়েছে বটে, কিন্তু সেই ভাগে তখনও অভ্যস্ত হননি অনেকেই। অনেকেরই মনে-মনে ধারণা, শিগগিরিই আবার জুড়ে যাবে দু-বাংলা। সে যাইহোক, ধর্মীয় যে উত্তেজনাকে অস্ত্র করে সেবার ভাগ হল বাংলা, তার রেশ দুর্গাপুজোতেও পড়ার সম্ভাবনা ছিল যথেষ্টই। ফলে, অন্যান্য বছরের তুলনায় এ-বছর যে পরিস্থিতি অনেকটাই আলাদা হতে চলেছে, তা নিয়ে সন্দেহ ছিল না কারোরই। সাবধানতাও নেওয়া হচ্ছিল যথাবিধি। 

তবে এসবের মধ্যেও কিন্তু অশান্তি শুরু হয়ে গেছেই। মহালয়ার আগেই, বরিশালে দুর্গাপ্রতিমা ভাংচুর করা হয়। সাংবাদিক লিখছেন— ‘গত ১১ অক্টোবর রাত্রিতে কয়েকজন অজ্ঞাত নামা ব্যক্তি কুলকাঠিতে একখানি দুর্গা প্রতিমা ভাঙ্গিয়া ফেলে। উক্ত গ্রামের আরও প্রতিমা ভাঙ্গিয়া ফেলা হইয়াছে। অবিলম্বে তদন্ত করিয়া পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য উপযুক্ত কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানান হইয়াছে।’ এ-সংবাদ পড়ে, পাঠক যদি বর্তমান বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা টানেন, বিশেষ দোষ দেওয়া যায় না বোধহয়।

১৯ অক্টোবর। পঞ্চমী। যুগান্তরের প্রথম পাতায় জাতির উদ্দেশে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল চক্রবর্তী রাজাগোপালচারীর বক্তব্য মুদ্রিত হয়েছে। তিনি বলছেন, ‘শারদীয় পূজার এই পক্ষকাল আনন্দ ও সম্প্রীতির আনন্দ ও সম্প্রীতির আলোকে উদ্ভাসিত হইয়া উঠুক, শান্তিই যে কাম্য বাঙ্গলা পুনরায় তাহা সর্ব্বজনসমক্ষে ঘোষণা করুক।’ ঠিক তার পাশের কলামেই দেখা যাচ্ছে ময়মনসিংহে ‘অপ্রীতিকর ঘটনা’র উল্লেখ। খুলনায় প্রতিমা ভাঙার খবর। ছয় নম্বর পাতায় যশোহর জেলার মুসলিম নেতৃবৃন্দের আবেদন— ’২০শে অক্টোবর হিন্দু সম্প্রদায়ের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ উৎসব শারদীয় পূজা আরম্ভ হইতেছে ও ২৪শে শেষ হইবে। ২৫শে আমাদের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ কোরবানীর দিন ইদুজ্জোহা। পূজা ও ইদুজ্জোহার দিন আমাদের দুই সম্প্রদায়ের মিলনের দিন হিসাবে উদযাপন করা প্রয়োজন।’

আর এসবের মধ্যেই চলে এল ষষ্ঠী। পশ্চিমবঙ্গের ‘বিভিন্ন এলাকায় পুলিশ প্রহরীর সহিত মিলিটারি মোতায়েন রাখার পরিকল্পনা।’ বাংলার ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রী জনাব ফজলুল হকের বিবৃতি, ‘হিন্দু ও মুসলমান উভয়েরই শান্তিপূর্ণ থাকা উচিত এবং বর্ত্তমানে সহরে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে যে সম্প্রীতি বিরাজ করিতেছে তাহা অক্ষুণ্ণ রাখা উচিত।’ এদিকে কলকাতায় পুজোর আমেজ শুরু হয়ে গিয়েছে প্রতিবারের মতোই। পঞ্চমীতেই বাগবাজার সার্বজনীনের পুজো উদ্বোধন করলেন স্যার যদুনাথ সরকার। আহিরীটোলা সার্ব্বজনীনের উদ্বোধনে মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ। ষষ্ঠীর বিকেলে শ্যামবাজার সার্ব্বজনীনের উদ্বোধন করলেন নেতাজির দাদা, শরৎচন্দ্র বসু। বাংলার বিভিন্ন স্থানের সর্বজনীন দুর্গাপুজোর তালিকায় উঁকি দিচ্ছে ঢাকা, ময়মনসিংহ, পাবনা, রাজশাহী, নিলফামারীর নামও। সপ্তমীর সকালে যুগান্তর জানাচ্ছে, ‘পথের মোড়ে মোড়ে এই বৎসর অপেক্ষাকৃত অধিক তোরণ নির্ম্মাণ করিয়া এবং বিভিন্ন পার্কে জনশিক্ষার জন্য প্রদর্শনী খুলিয়া অধিকতর উৎসাহে কলিকাতার বাঙ্গালী এইবার পূজায় নামিয়াছেন।’ এই অধিকতর উৎসাহের একটা কারণ যে দেশের স্বাধীনতাপ্রাপ্তি, তাতে সন্দেহ নেই। অন্যটি কি হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশপ্রাপ্তির কারণে? দেশভাগের সমর্থনে পশ্চিমবঙ্গবাসীর অবস্থান আমাদের অজানা নয়। তারই কি প্রতিফলন ঘটল সেবারের দুর্গাপূজাতেও?

সম্প্রীতি বজায় রাখার চেষ্টা চালিয়েছিল বামপন্থীরাও। তৈরি হয়েছিল নির্দিষ্ট কমিটিও। সেই কমিটির আহ্বায়ক নিরঞ্জন সেন জানান, পূর্ববঙ্গের সর্বত্রই শান্তিতে দুর্গাপুজোর শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ‘ঢাকা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, দিনাজপুর এবং রংপুরে সকল দলের মিলিত যে সকল শোভাযাত্রা বাহির হইতেছে, তাহাতে সহস্র সহস্র হিন্দু ও মুসলমান যোগদান করিতেছেন।’ সপ্তমীর সকালে এ এক সুখবর বইকি! এরপর দিন পাঁচেক পত্রিকা পাওয়া যাবে না। পূর্ববঙ্গের কথা ভেবে উৎকণ্ঠায় দিন কাটাবেন পশ্চিমবঙ্গের অনেকেই। সেখানে এই খবর খানিক আশা জাগায়। বাংলা ভাগ হলেও, ভ্রাতৃত্ব হয়তো ভেঙে যায়নি এত তাড়াতাড়ি। এখনও কিছু আশা রয়ে গেছে।

আরেকটি কথা উল্লেখ করতেই হয়। ২১ অক্টোবর, সপ্তমীতে, দুর্গাপুজোয় মেতে কলকাতা। সেইসঙ্গে, আরেক ‘দিবস’ও পালিত হচ্ছে শহরে। আজাদ হিন্দ সরকারের পঞ্চম প্রতিষ্ঠা দিবস। ১৯৪৩ সালে এই দিনেই অস্থায়ী আজাদ হিন্দ সরকার প্রতিষ্ঠা করেন সুভাষচন্দ্র বসু। তাঁর মৃত্যু কিংবা বেঁচে থাকা নিয়ে নানা গুজব চলছে চারদিকে। এর মধ্যেই, দিনটি পালনে শহরজুড়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে ফরোয়ার্ড ব্লক। শুধু কলকাতাই নয়, বর্ধমানেও পালিত হচ্ছে দিনটি। 

আজকের দিনে ভাবতে অবাক লাগে, কিন্তু সে-বছর পুজোর দিনগুলোয় সম্প্রীতি রক্ষায় এগিয়ে এসেছিলেন সাহিত্যিক ও শিল্পীরাও। সপ্তমীর সকালে বঙ্গীয় সংস্কৃতি সম্মেলনের আহ্বানে তাঁরা হিন্দু ও মুসলিম মহল্লায় পরিভ্রমণ করছেন। ঈদের দিন মুসলিম মহল্লায় ফের সম্প্রীতি মিছিল। তারপর, ২৬ অক্টোবর, ওয়েলিংটন স্কোয়ারে ‘বিজয়া ও ঈদ প্রীতি সম্মেলন’। সময়োপযোগী পদক্ষেপ, সন্দেহ নেই। 

একলাফে পৌঁছে যাওয়া যাক ২৭ অক্টোবরের সংবাদপত্রে। দুর্গাপূজা ও ঈদ দুই-ই ফুরিয়েছে ততদিনে। মহাত্মা গান্ধী বিবৃতিতে জানিয়েছেন, দু-বাংলাতেই শান্তিপূর্ণভাবে দুর্গাপুজো ও ঈদ পালিত হওয়ায় তিনি আনন্দিত। কিন্তু অন্য একটি সংবাদ জানাচ্ছে, পূর্ববঙ্গের অন্যত্র বিশেষ সমস্যা না হলেও, বিসর্জনকে কেন্দ্র করে বরিশাল ও ময়মনসিংহের দু-একটি জায়গায় কিঞ্চিৎ গোলোযোগ হয়। অথচ পাবনায় মুসলিম ন্যাশানাল গার্ডরাই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে এসেছিলেন শান্তিরক্ষায়। কলকাতাতেও কোথাও-কোথাও অগ্রণী হয়ে শান্তিরক্ষা করেছেন মুসলমানরাই। যে ঢাকা ঘিরে উদ্বেগ জন্ম নিচ্ছিল, সেখানে ‘পূজা ও ঈদ উৎসব নির্ব্বিঘ্নে উদ্‌যাপিত’। এমনকি, ২৭ তারিখ ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্কে পালিত হল হিন্দু-মুসলমান মিলনোৎসবও। কুড়িগ্রামেও মিলনের দৃশ্য। ‘পথে পথে হিন্দু-মুসলমান নির্ব্বিশেষে লোকের ভিড়। সকলেই কোলাকুলি ও প্রণাম করিয়াছে। মুসলমানদের নামাজের পর হিন্দুরা ঈদগা ময়দানে গিয়া সমবেত হয় এবং মুসলমানদের সঙ্গে কোলাকুলি করে।’ অনুরূপ দৃশ্য খুলনাতেও। সেখানকার অনেক জায়গাতেই ‘পূজা উপলক্ষে মুসলমানেরা হিন্দু বাড়ীতে এবং ঈদ উপলক্ষে হিন্দুরা মুসলমান বাড়ীতে নিমন্ত্রিত হন। এরূপ সহযোগিতার ও সম্প্রীতির মনোভাব গত ১০ বৎসরের মধ্যে দেখা যায় নাই।’ কিন্তু কেন এই ‘ব্যতিক্রমী’ ঘটনাবলি? অনুমান করতে পারি, দেশভাগ যে বিচ্ছেদের আশঙ্কা বুনে দিয়েছিল তাঁদের মনে, তার ফলে আরও কাছাকাছি চলে এসেছিলেন তাঁরা। পরস্পরকে আঁকড়ে স্বপ্ন দেখছিলেন নিরুপদ্রব ভবিষ্যতের। 

ভাঙা বাংলার প্রথম দুর্গাপুজোর ছবিটা কেমন ছিল, তা নিয়ে আমার কৌতূহল বহুদিনের। এ-লেখার সুবাদে খানিক নিবৃত্তি হল। দেশভাগ তখন অতি-সাম্প্রতিক ঘটনা। ফলে বাংলার সর্বস্তরে যে খুব বেশি প্রভাব ফেলেছিল, তাও নয়। সে-পর্যায়ের শুরু আরও কয়েক বছর পর থেকে। অন্তত ১৯৪৭-এর দুর্গাপুজো দিয়ে পরবর্তী বছরগুলোর ধারণা করতে বসলে, সর্বদা নাও মিলতে পারে। ফলে, সেই নির্দিষ্ট বছরটিকে ঘিরেই এ-লেখার ইতি টানা যাক।

নাকি একটি উদাহরণ দিয়েই শেষ করব? পরের বছরের কথা। ১৯৪৮ সাল। ১১ অক্টোবর, মহানবমী। সেদিনের যুগান্তরের প্রথম পাতার হেডলাইন— ‘পূর্ব্ববঙ্গ হইতে সংখ্যালঘুদের ব্যাপক বাস্তুত্যাগের সংবাদ’। পুজোর মধ্যে এমন খবর কারই বা ভালো লাগে, বলুন?

Powered by Froala Editor