‘তখন আমার লোকটা কোথায় শীতের মধ্যে ঘুরে বেড়াবে কোন প্লাটফর্মে কোন বটগাছতলায় কোন বন্ধ দোকানের নীচে কিংবা কোন অভাগিনীর ঝুপড়ির মুখে এসে খসে পড়বে আর পড়তেই থাকবে’
ক্ষ্যাপা স্বামী শিব ঠাকুরের জন্য এই উদ্বেগ কি হতে পারে মা দুর্গার? তাই কি এত উতলা? খালি খালি এত কু ডেকে যায় মন? তাই কি বাড়ি ফেরার জন্য তাড়াহুড়ো এত? তাই কি ক্রমাগত বেজে যায় বিদায়ের ঢাক?
অথচ জয় গোঁসাইয়ের ‘গৃহবধূর ডায়েরি’ কবিতাটা এতগুলো প্রশ্নের সামনে হয়তো ফেলতই না, যদি না ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’ ছবির শেষের দিকে আচমকা খুলে যেত সম্পর্কের জটিল মনস্তত্ত্বের আলাদা একটা দিক। যে ভাবে আজীবন আলগা থাকার অভিযোগ ছিল যার প্রতি, সেই প্রয়াত কবি ইন্দ্রনীলের স্ত্রী রাধিকা আচমকাই স্বামীর মৃত্যুর পর আবিষ্কার করে তার কবিতার মধ্যে নিজেকে। এবং তার ব্যাকগ্রাউন্ডে বেজে ওঠে উৎবের চিরাচরিত ঢাক সহসাই। সেই আওয়াজ কি বোধনের আগে স্বামীকে ছেড়ে আসবার মতো, নাকি আবার ক্ষ্যাপা, উলোঝুলো স্বামীর কাছে ফেরত যাওয়ার আগে বিসর্জনের মতো— সেই আবর্তেই আমাদের ফেলে দিতে ভালবাসেন পরিচালক। শুধু অকালবোধনের সেই আলগা অনুষঙ্গটা ভাসতে থাকে খোয়াই, কোপাই বা অজয়ের বালি ঢাকা জলে।
বাঙালির ছোটোখাটো মান-অভিমান বারবার অত্যন্ত নিপুণ ভাবে ফুটে উঠেছে যাঁর সিনেমায়, দুর্গাপুজোর মতো একটা ‘ঘটনা’ তাঁর ছবি এড়িয়ে যাবে, সেটা বোধহয় সম্ভবও ছিল না। তাই প্রায় গোটা তিনেক ছবিতে ভীষণই সরাসরি দুর্গাপুজোর সময়, পরিবেশ এবং ব্যাকড্রপকে নিয়ে এসেছেন ঋতুপর্ণ। উৎসবের সবটুকু নিজের শিল্পে নিতে চেয়েছেন তিনি। জীবনকে আষ্টেপৃষ্ঠে ভালবেসে যাওয়া শিল্পীর কাছে সেটাই স্বাভাবিক নয় কি? তাই হয়তো রবীন্দ্রনাথের জীবনীনির্ভর তথ্যচিত্র ‘জীবন স্মৃতি’তেও ঠাকুরবাড়ির পুজো দেখানোর সুযোগ ছাড়েননি তিনি। সেই ঠাকুরবাড়ি, একদিকে যাদের দুর্গাপুজোর জাঁকজমক ছিল প্রবাদপ্রতিম, অন্যদিকে দেবেন ঠাকুর ক্রমশ ঢলে পড়ছেন পরমব্রহ্ম লাভের চর্চা এবং বিশ্বাসের দিকে। ঠাকুরদালানে একচালার সোনা রঙের প্রতিমা, ঢাক বেজে চলেছে নাগাড়ে, পিঠে বাঁক নিয়ে যে এল, সে কি অমলের সেই দইওয়ালা? অথচ কপালে লাল তিলক নিয়ে সেসব উৎসব থেকে অনেকটাই দূরে দেবেন্দ্রনাথ। এই জাঁকজমক যেন পরমারাধ্যের কাছে পৌঁছতে দিচ্ছে না তাঁকে কিছুতেই। শুধুমাত্র কাটা কাটা কিছু দৃশ্যের বুননে আর মেটে রঙের দালানের উপরের দিকে দেবেন্দ্রনাথের হতাশ একটা চাহনি দিয়েই সেই টানাপোড়েন ধরে ফেলেন পরিচালক ঋতুপর্ণ।
আরও পড়ুন
১৯৪৭: ভাঙা বাংলার প্রথম দুর্গাপুজো
শব্দ-দৃশ্যের রসায়নে ঋতুপর্ণের চলচ্চিত্রের নিজস্ব যে ভাষা, তা তো প্রথম থেকেই ঠিক করে নিয়েছিল নিজস্ব ঘরানা। অথচ বাংলার মাটি ঘেঁষা সংস্কৃতি কখনোই ‘দুচ্ছাই’ পায়নি তাঁর কাছে। কখনোই সংস্কৃতির ‘অরগ্যানিক’ সারসত্তাটা মুছে যায়নি বাংলা সিনেমার নতুন সেই ভাষা থেকে। ‘হীরের আংটি’, ‘উৎসব’ এবং ‘অন্তরমহল’— এই তিনটি ছবিতেই খুবই সরাসরি এনেছেন তিনি দু্র্গোৎসবের অনুষঙ্গ। তবুও বিষয়গত আঙ্গিকের দিক থেকে কী ভীষণ ভাবেই যে আলাদা এই তিনটে ছবি একে অপরের থেকে, বাংলা ছবির দর্শকদের তা নতুন করে বলতে হয় না আর।
আরও পড়ুন
সেলুলার জেলে প্রথম দুর্গাপুজো
ছোটোবেলার গরমের ছুটির দিনগুলোতে নিমেষেই ফিরিয়ে নিয়ে যায় ‘হীরের আংটি’। গরমকালের সেই স্কুল ছুটির পর্ব মানেই, হোমটাস্কের গেরো কাটিয়ে ডিডি বাংলায় ‘ছুটি ছুটি’ অবধারিত। আর ‘ছুটি ছুটি’ মানেই, অবশ্যদ্রষ্টব্য একটা ছোটদের ছবি, ‘হীরের আংটি’। সেই কচিকাঁচা বয়সে সাদাকালো টিভির সামনে গুঁড়োগাড়া আরও কয়েকজন। এবং একটা আশ্চর্য গল্প। কই, অন্য সিনেমার মতো ঝাড়পিট নেই একদমই। কিন্তু তাও বেশ লাগছে তো বসে বসে দেখতে! পরে বয়স বাড়লে, সেই ছোটোদের সিনেমাই ফিরে এসেছে অন্যরকম মনখারাপ নিয়ে। নিজের প্রথম সিনেমাতেই সেই মনখারাপটা ভরে দিতে পেরেছিলেন একমাথা ঝাঁকড়া চুলের তরুণ, ঋতুপর্ণ ঘোষ। ভরে দিতে পেরেছিলেন শিকড়ের টান। আর তার জন্য দুর্গাপুজোর থেকে বড় ব্রহ্মাস্ত্র কি তিনজন দেবতাদেরও দেবতা মিলেও দিতে পারতেন তাঁকে?
ছোটোদের ছবি হলেও, নির্মাতা মাত্রেই জানেন, শুধু এই গোষ্ঠীর জন্যই বানাতে চাওয়া যে কোনও শিল্পকর্ম ঠিক কতটা কঠিন ও খাটনির! তবু ঘাসের পিচে দেরিতে ভাঙা স্যুইং সামলে দিতে পারা ব্যাটসম্যান যেমন জাত চিনিয়ে দেয় প্রথম দিনেই, তেমনই ঋতুপর্ণের প্রস্তুতিও ধরা পড়ে ‘হীরের আংটি’ ছবির প্রথম থেকেই। পিতৃপক্ষের শেষ হয়ে দেবীপক্ষের শুরু হয়, আর বিশাল চণ্ডীমন্ডপের উপর দিয়ে ঘুরে-বেড়াতে থাকে ক্যামেরা। ঠাকুরদালানে চলছে প্রতিমা তৈরির কাজ। সেই প্রতিমার কাঠামোর পাশেই একদিকে শৈশবের একের পর এক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যান বয়স্ক প্রতিমা শিল্পী। ঘন সবুজ ধান ক্ষত আর আলের উপর দিয়ে যাতায়াত ঢাকিদের। অন্যদিকে রাতের আলোছায়ায় দুই প্রৌঢ়ের কথাবার্তায় ছায়া যেন আগাম বিষণ্ণতার। ছুটি ফুরোলে বাড়ির কর্তা চলে যাবেন বিদেশে থাকা ছেলের কাছে। বহুদিনের সঙ্গী বাড়ির পুরনো চাকরকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইলে, রাজি হয় না সে কিছুতেই। শেষমেশ কর্তামশাই ‘ওদেশেও দুর্গাপুজো হয়’ বলে মানানোর চেষ্টা করলে, ধেয়ে আসে অমোঘ প্রশ্ন সেই— ওদেশে কি ঢাক বাজে? কাশফুল ফোটে ওই দেশে?
প্রথম ছবি থেকেই এই শিকড় আঁকড়ে ধরার কথা বলতে চেয়েছিলেন পরিচালক। বাংলা ছবি তার হীরের আংটি হারিয়ে ফেলেছে আজ কত বছর যে হল! হারিয়ে দিতে না চাইলে, অগত্যা তাঁর বাড়িয়ে রাখা আঙুলের কোনো একটা ধরে পৌঁছে যেতে হয় তাঁরই কোনও সৃষ্টির কাছে। আশ্বিনের শারদ প্রাতে সেই আঙুল আমাদের নিয়ে যায় যার কাছে, তার নাম ‘উৎসব’।
‘হীরের আংটি’র মতো সেই, ‘উৎসব’-এও মৃৎশিল্পীর সঙ্গে বাড়ির ছেলেপুলেদের গালগল্পের দৃশ্য বাদ যায় না। ফেলুনাথের সেই আইকনিক দৃশ্যের পর হয়তো, বনেদি বাড়ি আর দুর্গাপুজো থাকলে, সেই দৃশ্যও এসে পড়া একরকম বাধ্যতামূলকও বটে! একচালার দুর্গা যেন পুরো সংসারটাকে একসঙ্গে ধরে রাখারই চেষ্টা। অথচ চাইলেই সেটা হয় কোথায়? অশুভ শক্তির মতো এসেই পড়ে ভাঙন বা বিচ্ছেদ। তবু তো সব দত্যি-দানো হারিয়ে অন্ত্যেমিলে বেঁচে ফেরে রূপকথারা। সিঁদুর খেলার পরেই তাই বিসর্জনের বদলে ঋতুপর্ণের উৎসবে বেজে ওঠে আগাম শুভদিনের আগমনী। ধ্রুপদী সঙ্গীতের মতোই ক্রমশ আলাপ থেকে ঝালায় উঠতে থাকে উৎসবের আমেজ। এক মা; তার দুই ছেলে দুই মেয়ে... দুর্গাপুজোর আবহে এমনই এক পরিবারের শাখা-প্রশাখা নিয়ে ঋতুপর্ণের এই ছবি তাই সারা ফেলে দেয় জাতীয় স্তরেও।
বরং তুলনায় বহু বিতর্কে জর্জরিত ‘অন্তরমহল’। যে ছবির শিরায় শিরায় বয়ে যায় অবিচ্ছেদ্য দুঃখের স্মৃতি একটা। চোখে আঙুল দিয়ে যা দেখিয়ে দেয় হিন্দুয়ানী নিয়মের অজস্র ফাঁকফোকর; নির্মমতা। জেগে থাকে শুধু নতুন পটুয়ার মতো সূর্যদীঘল দুই চোখ। বুকের ভিতর অবধি দেখে ফেলে যে। জাত-ধর্ম পেরিয়ে আপামর বাঙালির প্রাণের যে উৎসব, তাই যেন ধরে ফেলেন ঋতুপর্ণ এই মৃৎশিল্পীর মাধ্যমে। সেই সঙ্গেই নারী-ক্ষমতায়নের অন্য একটা দিকও যেন এঁকে ফেলতে চান তিনি। যৌনতা, বিশেষ করে নারীর যৌনতা নিয়ে যে লুকোচুরি এবং কোথাও কোথাও ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ জাতীয় শুচিবায়ুগ্রস্ততা রয়েই গেছে বাঙালি সমাজে, তার শিকড়েও যেন টান পড়ে সজোরে। আর এই কাজে বারংবারই তিনি ফিরিয়ে আনেন দেবী দুর্গা এবং তাঁকে ঘিরে আবর্তিত হয়ে চলা সমগ্র একটি উৎসবের কেন্দ্রবিন্দুকে। যে সমস্ত মেয়েরা বাড়ি আগলে বসে থাকে অপেক্ষায়, ভাঙন আটকাতে চেষ্টা করে যায় অবিরত, তারাই কখন যেন দেবী হয়ে ওঠে ঋতুপর্ণের সেলুলয়েডের গল্পে। যেসব গল্প প্রশ্ন তুলে যায়, কতটা শুনতে পেরেছি আমরা তাদের কান্না? বেজে চলে নাগাড়ে কোথাও তাই ‘অন্তরমহল’ সিনেমায় ব্যবহৃত সেই, ‘গিরিপুরী সকলই আঁধার, কবে আসবি আবার...’
নবমী নিশি শেষ হলেই তাই মনে হয় কোথাও, আর তো গল্প বলতে আসবেন না তিনি! ঋতু-বিসর্জনের কান্নার এই অশ্রুবিন্দু কি কোনোদিনই শোকাবে আমাদের?
Powered by Froala Editor