সিংহাসনের আদলে তৈরি বেদি। তার ওপরেই বসানো রয়েছে দেবী দুর্গার আকণ্ঠ মূর্তি। পূর্ণাবয়ব নেই কোনো। নেই দেবীর সন্তান-সন্ততিদের মূর্তি। বরং, দেবীর মুখাবয়বের দু’পাশের দেওয়ালে আঁকা রয়েছে লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ, কার্ত্তিক এবং শিবের ছবি। না, মণ্ডপসজ্জা নয়। বরং, বিষ্ণুপুরের নিকটবর্তী বেলিয়াতোড়ের জমিদার পরিবারে এভাবেই পূজিত হন দেবী। কেবলমাত্র দেবীমস্তক আরাধনা হয় বলে শতাব্দীপ্রাচীন এই পুজো পরিচিত ‘মুণ্ড পুজো’ নামে।
প্রশ্ন থেকে যায়, শুধুমাত্র মুখাবয়ব পুজোর কারণ কী? বলাইবাহুল্য এই রীতির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বহু জনশ্রুতি, লোককথা। তবে তারও আগে ফিরে দেখা দরকার প্রায় চারশো বছর পুরনো এই পুজোর ইতিহাস। পশ্চিমবাংলার গণ্ডি ছাড়িয়ে যার শিকড় ছড়িয়ে রয়েছে বাংলাদেশ পর্যন্ত।
হ্যাঁ, এই পুজোর সূত্রপাত হয়েছিল বাংলাদেশের যশোরে। আরও ভালো করে বলতে গেলে যশোরের রাজবাড়িতে। রাজা প্রতাপাদিত্য রায়ের কুলদেবী হিসাবেই পূজিত হতেন দেবী। পরিচিত ছিলেন যশোরেশ্বরী নামে। তখন অবশ্য মুণ্ডপুজো হত না। বরং, অষ্টধাতুর তৈরি পূর্ণাবয়ব দেবী চণ্ডীর মূর্তির পুজো হত যশোর রাজবাড়িতে।
আরও পড়ুন
বেদাঙ্গ জ্যোতিষের নববর্ষ উদযাপন থেকেই শুরু দুর্গাপুজো?
যে সময়ের কথা হচ্ছে সেটা সপ্তদশ শতক। ভারতজুড়ে তখন মোঘল রাজত্বের দাপট। মোঘলদের সেই রাজ্যবিস্তারের মেঘ ঘনিয়ে আসে বাংলার ওপরেও। যশোর আক্রমণ করেন মোঘল সেনাপতি মানসিংহ। না, সেই মোঘল আক্রমণকে ঠেকানো সম্ভব হয়নি। তুল্যমূল্য যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত পরাজয় স্বীকার করেন প্রতাপাদিত্য। কিন্তু মোঘল অধিগ্রহণে কুলদেবীর আরাধনায় ব্যাঘাত ঘটতে পারে একথা ভাবেই দেবী যশোরেশ্বরীকে যশোর থেকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন প্রতাপাদিত্য।
আরও পড়ুন
পুজোর খেলা, ভাঙার খেলা
তবে যশোর ছাড়ার অনুমতি ছিল না তাঁর। শেষ পর্যন্ত মানসিংহেরই পরোক্ষ সাহায্যে রাজা প্রতাপাদিত্যের কনিষ্ঠপুত্র রাজীবলোচন বুকে করে দেবীকে নিয়ে রওয়ানা দেন পশ্চিমে। উদ্দেশ্য ছিল, পুরীধামে পৌঁছে নতুন করে দেবী মন্দির গড়ে তোলা। কিন্তু এতটা পথ পায়ে হেঁটে অতিক্রম করা তো আর মুখের কথা নয়। কাজেই সাময়িক বিশ্রামের জন্য থামতে হয়েছিল বিষ্ণুপুরের নিকটবর্তী এক বিশ্রামালয়ে।
আরও পড়ুন
দুর্গাপুজো, বটতলার পুস্তিকা ও প্রথম শারদীয়া পত্রিকা
তবে ছদ্মবেশ ধরেও পরিচয় লুকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি রাজীবলোচনের। রাজপুরুষোচিত চেহারা আর বাগ্মিতাই তাঁকে আলাদা করে দিয়েছিল অন্যান্য পরিব্রাজকদের থেকে। ফলত, স্বাভাবিকভাবেই এহেন পরিব্রাজকের কথা পৌঁছাল বিষ্ণুপুরের মল্লরাজ বীর হাম্বিরের কাছে। ডাকও পড়ল রাজদরবারে। রাজীবলোচনের ব্যক্তিত্বে গুণমুগ্ধ হয়ে রাজীবলোচনকে বিষ্ণুপুরের দেওয়ান পদের জন্য মনোনীত করেন বীর হাম্বির। তবে রায়বংশধরের শর্ত ছিল একটাই। দশভূজাকে যথার্থভাবে অধিষ্ঠার জন্য মন্দির তৈরি করতে দিতে হবে। সেই শর্ত মেনেই বিষ্ণুপুরের গোপালগঞ্জ মন্দির গড়ে তোলেন মল্লরাজ। আজও সেখানে পূজিত হন অষ্টধাতুর তৈরি যশোরেশ্বরী।
কিন্তু এই গল্পের সঙ্গে ‘মুণ্ড পুজো’-র যোগ কোথায়? আছে। এবার সেই যোগসূত্রের দিকেই এগোনো যাক বরং। গোপালগঞ্জে মন্দির প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি নিকটবর্তী বেলিয়াতোড়ের রাজ্যধর হিসাবে রায় পরিবারকে বিস্তীর্ণ জমি দান করেছিলেন মল্লরাজ। রাজীবলোচন গোপালগঞ্জ ছেড়ে না গেলেও পরবর্তীতে বেলিয়াতোড়েই নতুন করে গড়ে ওঠে রায় পরিবারের জমিদার বাড়ি। তবে যশোরেশ্বরী থেকে যান গোপালগঞ্জেই। অন্যদিকে প্রথা মেনে প্রতিবছর বেলিয়াতোড়েও আয়োজন হত দুর্গাপুজোর।
কিন্তু বেলিয়াতোড়ে রাজবাড়ি প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই মুণ্ডপুজো হত কিনা, সেই ইতিহাস বেশ অস্পষ্ট। কয়েকশো বছর পুরনো কোনো নথিও অবশিষ্ট নেই আর। তবে জনশ্রুতি, রায়কর্তাকে স্বপ্নাদেশ দিয়েছিলেন যশোরেশ্বরী। যেহেতু দশভুজারূপে তিনি পূজিত হন বিষ্ণুপুরে তাই অন্যত্র তাঁর পুজো করতে গেলে শুধু মুখমণ্ডলের আরাধনা করতে হবে। সেই থেকেই পরিবারের বাৎসরিক দুর্গাপুজোর এমন অভিনব নিয়ম। যশোরেশ্বরীর আদলে ‘মুণ্ড পুজো’ হয় বলেই দেবীর পাশে অনুপস্থিত থাকেন তাঁর চার সন্তান। বদলে সেগুন কাঠের রথঘরের কাঠের দেওয়ালে রং-তুলিতে ফুটে ওঠে লক্ষ্মী, গণেশ, কার্ত্তিক, সরস্বতী ও শিবের প্রতিকৃতি।
একটা সময় পর্যন্ত বেলিয়াতোড় এবং গোপালগঞ্জ— এই দুই শহরের দুর্গাপুজোতেই অংশ নিতেন রায় পরিবারের সদস্যরা। বর্তমানে বদল এসেছে সেই প্রথাতেও। দুর্গাপুজো চলাকালীন বেলিয়াতোড়ে যান না রায় পরিবারের সদস্যরা। বরং, ‘বাহক’ মারফত পাঠানো হয় পুজোর সমস্ত সামগ্রী, উপকরণ। সেই উপকরণ না পৌঁছানো অবধি শুরু হয় না দেবী যশোরেশ্বরীর পুজো।
তবে শুধু মুখমণ্ডলের আরাধনাই এই পুজোর বিশেষত্ব নয়। বরং, তার সর্বাঙ্গেই লেগে রয়েছে ঐতিহ্য এবং অভিনবত্বের ছাপ। ঢাকের বদলে শোনা যায় কাড়া-নাকাড়ার ধ্বনি। বেলিয়াতোড়ের দুর্গাপুজোর গল্প শেষ হতে পারত এখানেই। তবে আরও একটি বিষয় না বললে, অপূর্ণ থেকে যায় ঐতিহ্যবাহী রায় পরিবারের কথা। চিত্রকর যামিনী রায় এবং ঐতিহাসিক তথা বড়ু চণ্ডীদাসের লেখা ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এর আবিষ্কর্তা বসন্তরঞ্জন রায়ও বেলিয়াতোড়ের এই পরিবারেরই সদস্য। একটা সময় সক্রিয়ভাবে তাঁরা অংশও নিতেন এই ‘মুণ্ড পুজোয়’। এমনকি যামিনী রায়ের আঁকা দেবীর একাধিক চিত্রেও ছাপ রয়েছে সন্তানবিহীন দেবী প্রতিকৃতির। হয়তো পরিবারের এই শতাব্দীপ্রাচীন রীতিকেই তিনি ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন রং-তুলির দ্বৈরথে…
তথ্য ও ছবি ঋণঃ
সৌম্যকান্তি রায় (বেলিয়াতোড় রাজ পরিবারের সদস্য এবং পুজোর আহ্বাহক)
শৌনক মুখোপাধ্যায়
Powered by Froala Editor