মহারাজা কীর্তিচাঁদের কীর্তির কথা শুনে পাশ ফিরে শুয়েছিল বর্ধমানের খোকা-খুকুরা। কিন্তু বর্গি এল দেশে। এখান থেকে ওখান থেকে চিৎকার করে তারা বলছে, খাজনা চাই। খাজনা দেওয়ার মতো সামর্থ্য অবশ্য বর্ধমানবাসীর তখনও ছিল। সারা দেশ থেকে মোঘল সাম্রাজ্যের গৌরবরবির আলো মুছে যেতে চলেছে। কিন্তু বর্ধমানের উর্বর মাটিতে চাষ-আবাদ বেশ ভালোই হত। আর সেই কারণেই মারাঠা পেশোয়া বালাজি বিশ্বনাথের নজর পড়েছিল এদিকে। ভাস্কররাম পণ্ডিত নামের এক দুর্ধর্ষ সেনাপতিকে পাঠালেন বাংলা থেকে খাজনা আদায় করতে।
এই বর্গি আক্রমণের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় গঙ্গারামের ‘মহারাষ্ট্র পুরাণ’-এ। সেখানেই এক জায়গায় মেলে কয়েকটি পঙক্তি। গঙ্গারাম লিখছেন, ‘একা ভাস্কর লইয়া কিছু শুন বিবরণ / জেরূপে ডাঞিহাটে কৈলা পূজা আরম্ভন।। / ভাস্কর করিবে পূজা বলি দিবার তরে। / ছাগ মহিষ আইসে কত হাজারে হাজারে।’ গঙ্গারাম ‘ডাঞিহাট’ লিখেছিলেন বটে, তবে সম্ভবত সরকারি কাগজে তখনও জায়গাটির নাম ছিল দৈনহাট। শোনা যায় গঙ্গাতীরের এই প্রাচীন শহরে প্রতিদিনই হাট বসত। আর সেখান থেকেই এমন নামকরণ। এই দৈনহাটই আজকের দাঁইহাট। বর্তমানে পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়া শহরের কাছে গঙ্গাতীরের শহর। এখন সেখানে রীতিমতো সাজো সাজো রব। দুর্গাপুজোকে ঘিরে গোটা রাজ্যেই তাই। তবে এই পুজো তো যেমন তেমন পুজো নয়। এর গোড়াপত্তন দস্যু ভাস্কর পণ্ডিতের হাতে।
১৭৪০ সালে মারা যান বর্ধমানের মহারাজ কীর্তিচন্দ্র রায়। তাঁর মৃত্যুর পর চিতাভস্ম সমাধিস্থ করে সমাজবাড়ি নির্মাণ করা হয় এই দাঁইহাট শহরে। এর ঠিক পরের বছরই বাংলায় হানা দিল বর্গির দল। ‘১৭৪১ থেকে ১৭৪৪ পর্যন্ত একটানা বর্গি আক্রমণ হয়েছিল বর্ধমানে। তার মধ্যেই কোনো এক বছরে ভাস্কর পণ্ডিত দুর্গাপুজোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন।’ বলছিলেন ভাস্কর পণ্ডিতের পুজোর বর্তমান পুরোহিত অভিজিৎ ভট্টাচার্য। তবে খুব সম্ভবত ১৭৪২ সালে হয়েছিল এই আয়োজন। কারণ মহারাষ্ট্র পুরাণের বর্ণনা অনুযায়ী প্রথম দুই বছরই বর্গিদের নেতৃত্বে ছিলেন ভাস্কর পণ্ডিত। এই ১৭৪২ সালের আক্রমণের সময় নবাব আলিবর্দি খাঁ গিয়েছিলেন ওড়িশার কর আদায় করতে। তাঁর অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে বর্গিরা একেবারে মুর্শিদাবাদ পর্যন্ত লুঠ করে ফেলেছিল। ফেরার সময় দাঁইহাটে খালি পড়ে থাকা সমাজবাড়ি দেখে সেখানেই ঘাঁটি গাড়লেন ভাস্কর। তাঁর সৈন্যদল তখন বিজয়ের আনন্দে ফুটছে। ঠিক হল এই দাঁইহাটেই হবে দুর্গাপুজোর আয়োজন।
আরও পড়ুন
‘অবাঙালি’ দুর্গার খোঁজে
অভিজিৎ বাবু বলছিলেন, ‘ভাস্কর পণ্ডিত একজন শাক্ত ধর্মাবলম্বী ছিলেন। মারাঠা রীতি মেনে তিনি অষ্টভূজা দেবীর আরাধনা করতেন। তিনি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন সোনার প্রতিমা।’ এই সোনার প্রতিমার কথাই সবচেয়ে বেশি শোনা যায় এলাকাবাসীর কাছে। অবশ্য কেউ কেউ মনে করেন, বাংলা আক্রমণে বেরিয়ে পড়ার কারণে মহারাষ্ট্রের গণেশ পুজোর অনুষ্ঠানে থাকতে পারেননি ভাস্কর পণ্ডিত। আর তাই বাংলার রীতি মেনেই দুর্গাপুজোর আয়োজন করেছিলেন। ভাস্কর পণ্ডিত নিজে হাতে প্রতিমায় মাটি দিয়েছিলেন। তবে সে যাই হোক। পুজোর খবর ঠিকই পৌঁছাল নবাবের কানে। তিনিও সৈন্যদল নিয়ে এগিয়ে এলেন দাঁইহাটের দিকে। তাই অষ্টমীর সন্ধিপুজো অসমাপ্ত রেখেই পালিয়ে গেলেন ভাস্কর পণ্ডিত। কথিত সোনার মূর্তিটি ডুবিয়ে দিয়েছিলেন গঙ্গার জলে। ‘শেষপর্যন্ত কোশিগ্রামের কাছে সন্দীপে নবাবের সেনাদলের হাতে ধরা পড়েন ভাস্কর পণ্ডিত। সেখানেই হত্যা করা হয় তাঁকে।’ বলছিলেন অভিজিৎবাবু। অবশ্য গঙ্গারাম লিখেছিলেন মেদিনীপুর পর্যন্ত ভাস্কর পণ্ডিতের বাহিনীর পিছু ধাওয়া করেছিলেন নবাব। তারপর ব্যর্থমনোরথ হয়ে ফিরে এসেছিলেন। ভাস্কর চলে গিয়েছিলেন মহারাষ্ট্রে।
আরও পড়ুন
শ্রীরামপুরের ‘ডাচ দুর্গা’ ও গণেশ-যিশুর গল্প
তবে ইতিহাস ও লোকশ্রুতি মিলিয়ে এই হল প্রথম বছরের কাহিনি। ষষ্ঠীর বোধন দিয়ে পুজো শুরু হলেও অষ্টমীর সন্ধিপুজো অসমাপ্ত রেখে পালালেন ভাস্কর পণ্ডিত। যাওয়ার আগে সমাজবাড়ি প্রায় গুঁড়িয়ে দিয়ে গেলেন। কেবল একটিমাত্র পাঁচিল দাঁড়িয়ে রয়েছে আজও। বাংলায় বর্গি আক্রমণের সেটাই একমাত্র প্রত্যক্ষ নিদর্শন। বর্তমানে রাজ্য হেরিটেজ কমিশন থেকে স্বীকৃতিও পেয়েছে দেয়ালটি। এই দেয়াল ঘেঁষেই প্যান্ডেল টাঙিয়ে আজও পুজোর আয়োজন করেন দাঁইহাটবাসী। ভাস্কর পণ্ডিতের পুজো নামেই তা পরিচিত। তবে পুজোর নিয়মকানুনে কোথাও মারাঠা প্রভাব নেই। একেবারে বাঙালি মতে একচালা দশভুজা মূর্তির পুজো করা হয়। এমনকি অবাক করা বিষয় হল, এই পুজোতে পশুবলির নিয়ম নেই। অথচ গঙ্গারাম লিখেছিলেন, পশুবলির উদ্দেশ্যেই পুজোর আয়োজন করেছিলেন ভাস্কর পণ্ডিত।
আরও পড়ুন
অর্ধনারীশ্বর-আরাধনা ও রূপান্তরকামী-বৃহন্নলাদের শারদীয়া
বিশ শতকে বারবার পুজোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন দাঁইহাটবাসী। ১৯৬৭ সালে একবার কমিটিও তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু নানা কারণে কয়েক বছর পুজোর পর আবার তা বন্ধ হয়ে যায়। এইভাবে বিক্ষিপ্তভাবে কয়েকবছর পুজো হওয়ার পর ১৯৯৭ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে পুজো হয়ে আসছে। এলাকার পুরুষরা পুজোর কাজে সাহায্য করলেও মূল দায়িত্বে থাকেন মহিলারাই। তাঁদের উদ্যোগেই নবমীতে কুমারীপুজোর আয়োজন হয় প্রতিবছর। এটাই উৎসবের সবচেয়ে বড়ো দিন বলে মনে করেন দাঁইহাটবাসীরা। ভাস্কর পণ্ডিত লুটেরা দস্যু হতে পারেন, কিন্তু এই পুজো ক্রমশ বাঙালির নিজস্ব অনুষ্ঠানেই পরিণত হয়ে গিয়েছে। শুধু তার সঙ্গে বয়ে নিয়ে চলেছে একটুকরো ইতিহাস।
Powered by Froala Editor