দুর্গাপুজোর ইতিহাস অনুসন্ধানের বিষয়ে আজকাল অনেকেই উৎসুক। বিশেষ করে আঠেরো ও উনিশ শতকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে কীভাবে এই উৎসবের বাড়বাড়ন্ত শুরু হল, তা এখন সবারই জানা। কিন্তু উৎসব যে তেমন অর্বাচীন নয়। বরং বহু প্রাচীনকাল থেকেই এই সময়পর্বে উৎসবে মেতেছেন ভারতীয়রা। সময়ভেদে, স্থানভেদে সেই উৎসবের নাম বদলে বদলে গিয়েছে। ঠিক যেমন বাঙালিরা যখন দুর্গাপুজোয় মেতে উঠেছেন, উত্তরভারতে চলছে নবরাত্রের উদযাপন। আবার আরও কিছুদিন পেরিয়ে গেলেই আসবে শ্যামাপূজা এবং লক্ষীপূজা। তারপরদিনই গুজরাট অঞ্চলে পালিত হত দ্যূতক্রীড়া।
এই সমস্তই আসলে নববর্ষের উদযাপন। পৃথিবীর কোন জাতি নববর্ষের আনন্দে মেতে ওঠে না? ভারতবর্ষেও একইভাবে দীর্ঘদিন ধরে পালিত হয়ে আসছে সেই উদযাপন। এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, কোন বছরের কথা বলা হচ্ছে? কারণ আমাদের প্রচলিত কোনো পঞ্জিকার বছর গণনাই শরৎকালে শুরু হয় না। তবে সময়ের সিঁড়ি বেয়ে যদি মোটামুটি ৩ হাজার বছর পিছিয়ে যাওয়া যায়, তাহলেই উত্তর পাওয়া যাবে। তখন সবে বৈদিক যুগের শুরু হয়েছে। কৃষ্ণ যজুর্বেদের পাঠে দেখা যায় সময়গণনার ক্ষেত্রে শরৎবর্ষের উল্লেখ রয়েছে। এই কৃষ্ণ যজুর্বেদ থেকেই আর্যদের যাবতীয় লৌকিক আচারের শুরু। এর আগে অনুষ্ঠান ও পূজা আয়োজনকে হীন চোখেই দেখত আর্যরা।
বেদের ঋতুগণনাও এতটা সহজ ছিল না। সেকালে প্রত্যেক ঋতুকে সমান দুই ভাগে ভাগ করা হত। যেমন বসন্ত ছিল মধু ও মাধব। তেমনই শরৎ ঋতুর দুই অর্ধের নাম ছিল ইষ ও উর্জ। ইষ শরৎঋতুর প্রথম মাস। তবে আশ্বিন মাস যেমন অশ্বিনী নক্ষত্রের গতিবিধির সঙ্গে যুক্ত থাকায় নির্দিষ্ট, ইষ মাস তেমন নয়। বেদের যুগে ঋতুগণনা হত তিনি গণনা এবং সূর্যের ভোগ দেখে। সেই হিসাবে ঋতু পিছোতে থাকে। পিছোতে থাকে ইষ মাসও। সূর্যের উত্তরায়ণের সঙ্গে সঙ্গে হিমঋতুর শুরু হয়। এই সময় থেকে আটমাস পরে শরৎ ঋতুর আরম্ভ। প্রত্যেক মাসে এক তিথির বৃদ্ধি ধরলে দেখা যায় আশ্বিন মাসের শুক্ল অষ্টমী এবং শুক্ল নবমীর মাঝামাঝি সময়ে শরৎবর্ষের শুরু হচ্ছে। সম্ভবত এই কারণেই সন্ধিপুজোর প্রচলন হয়েছিল।
তবে প্রতি মাসে এক তিথির বৃদ্ধি স্থূল গণনা। এই গণনা শুরু হয়েছে পৌরাণিক যুগে। সূক্ষ্ম হিসাবে দেখা যায় শরৎ ঋতুর আরম্ভ হচ্ছে শুক্ল দশমীর শুরুতে। কালিকাপুরাণের উল্লেখ অনুযায়ী, আশ্বিন মাসের কৃষ্ণ চতুর্দশী তিথিতে দেবীর আবির্ভাব। সেই থেকে নয়টি তিথি গণনা করলে তবে শুরু হয় শরৎবর্ষ। আর এই ৯ তিথিই নবরাত্রের উদযাপন। আমাদের দেবীপক্ষের শুরুও হয় অমাবস্যা থেকেই।
আরও পড়ুন
পুজোর খেলা, ভাঙার খেলা
তবে এইসমস্ত গণনাতেই ধরে নেওয়া হয়েছে সূর্যের উত্তরায়ণের শুরু মাঘ মাসের শুক্ল প্রতিপদ তিথিতে। কিন্তু যজুর্বেদ ও অথর্ববেদের সময় উত্তরায়ণের সময় ধরা হত মাঘ মাসের কৃষ্ণাষ্টমী তিথিকে। সেই হিসাব মতে পিছিয়ে যায় শরৎবর্ষের আরম্ভও। মাঘ কৃষ্ণাষ্টমী থেকে ৮ মাস ৮ তিথি গণনা করলে যে তিথি আসে তা আশ্বিনের অমাবস্যা। পরেরদিন কার্তিক শুক্লপ্রতিপদ থেকে শুরু হয় শরৎবর্ষ। আশ্বিন অমাবস্যার দিনেই তাই সকালে লক্ষীপূজা এবং রাত্রে শ্যামাপূজার আয়োজন দেখা যায়। এইদিনেই অবশ্য দীপাবলির আয়োজনও হয়। তবে তার সূত্রপাত সম্ভবত আরও অনেক পরে। পরেরদিন নববর্ষের সূচনায় দ্যূতক্রীড়ায় মাতেন গুজরাটের মানুষ।
আরও পড়ুন
দুর্গাপুজো, বটতলার পুস্তিকা ও প্রথম শারদীয়া পত্রিকা
শাস্ত্রমতে বৎসর শেষের আরাধ্যা লক্ষ্মী এবং বছর শুরু হয় সূর্যের আশীর্বাদ নিয়ে। লক্ষ্মীকেই তাই নানারূপে দেখা যায়। কোথাও নবরাত্রে নয়টি রূপে পূজিতা হন তিনি। আবার বঙ্গদেশে তিনিই হয়ে উঠেছেন দশভূজা দেবী দুর্গা। তবে দশভূজার আরাধনায় বোধন হয় আশ্বিন মাসের শুক্লষষ্ঠী তিথিতে। এর সঙ্গেও যুগগণনার সম্বন্ধ রয়েছে। শাস্ত্রমতে একটি যুগ শেষ হত ষষ্ঠী তিথিতে আর শুরু হত সপ্তমীতে। এই কারণেই আবার ষষ্ঠীকে লক্ষ্মীর তিথি এবং সপ্তমীকে রবির তিথি ধরা হয়। আবার সূর্যের সামনে পশুবলি নিষিদ্ধ। তাই সপ্তমীর পুজোতেও পশুবলি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন
দুর্গা-আরাধনার সঙ্গে যেভাবে মিশে গেল নবপত্রিকা-পুজোও
ভারতের বেদাঙ্গ জ্যোতিষের সেই গোড়ার সময়ের পঞ্জিকা এখন প্রচলিত নয়। এমনকি তা বিস্মৃত বললেও মিথ্যা হয় না। কিন্তু উৎসব আজও জীবিত। আজও সেই নববর্ষের উদযাপনে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে সারা দেশ। শুধু তাকে নববর্ষ বলে চিহ্নিত করা হয় না আর।
তথ্যসূত্রঃ পূজা-পার্বণ, শ্রী যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি, বিশ্বভারতী
Powered by Froala Editor