অনুজ সোহম একবার প্রশ্ন করেছিল। নীলকণ্ঠ পাখির ইংরেজি নাম 'রোলার' কেন? 'অ্যাক্রোবেটিক' শব্দটির সঙ্গে পরিচিত সকলেই। যার বাংলা অর্থ 'বায়বীয়'। সহজ করে বলি। পনেরো আগস্ট বা ছাব্বিশে জানুয়ারি বায়ুসেনা তাদের যুদ্ধবিমানের মহড়া করে। আকাশে বৃত্তাকারে উড়তে দেখা যায় বিমান। আশা করি শব্দটার অর্থ বায়বীয় কেন, তা বোঝাতে পেরেছি। তবে, সোহমের করা প্রশ্নটার উত্তর কিন্তু এখনও দিইনি। পুরুষ নীলকণ্ঠ প্রজনন মরশুমে আকাশে এইভাবে বৃত্তাকারে উড়ে বেড়ায়। আসলে নারী নীলকণ্ঠকে আকৃষ্ট করার অন্যতম উপায় এটি বলে মনে হয়। সুতরাং নীলকণ্ঠ এমনভাবে ওড়ে যেন মনে হয়, বায়ুসেনার বিমান অ্যাক্রোবেটিক প্রদর্শন করছে।
একটা তথ্য দিই। বইটার নাম 'বিস্ট অ্যান্ড ম্যান ইন ইন্ডিয়া'। লেখক জন লকউড কিপলিং। ১৯০৪ সালে লন্ডন থেকে বইটা প্রকাশিত হয়েছিল। বইটার ৩৩ পৃষ্ঠায় লেখা আছে, দশেরার দিনই হল প্রকৃত বিজয়া দশমীর দিন। শরৎকালের দুর্গাপুজো কিন্তু আসল দুর্গাপুজো নয়। রাজা কংসনারায়ণ চালু করার আগে দুর্গাপুজো হত বসন্তকালে। নীলকণ্ঠ ওড়াবার রীতি ছিল আসলে দশেরাতেই। দশেরার সঙ্গে নীলকণ্ঠ বা শিবের কী সম্পর্ক নেই। 'বিস্ট অ্যান্ড ম্যান ইন ইন্ডিয়া' অনুসারে, নীলকণ্ঠ আসলে বিষ্ণুর প্রতীক। আপনারা ভাবছেন হয়তো বিষ্ণু তো ‘নীলকান্ত’, তিনি নীলকণ্ঠ কীভাবে হলেন! আসলে এটি মহারাষ্ট্রের প্রথা। তাঁদের সঙ্গে দক্ষিণীদের দারুণ যোগাযোগ ছিল এককালে। দক্ষিণীরা তো ‘ত’ লেখেন টি+এইচ দিয়ে। জয়ললিতা বানান Jaylalitha। তো নীলকান্ত তো Neelkantha— এভাবেই লেখার কথা। এবার স্থানভেদে, বানানভেদে, রূপভেদে যে যে নামে ডাকে সেই নামেই মজে যাই আমরা প্রত্যেকে।
'নীলকণ্ঠ তুম নীল রাহিও, দুধ ভাত কা ভোজ করিয়ো, হামরি বাত রাম সে কহিও'। উত্তর ভারতের মানুষের মুখে এমন কথা শোনা যায়। অর্থাৎ নীলকান্ত তুমি নীল থাকো, দুধভাত খাও এবং রামকে আমাদের সম্মান জানিও। বলা হয়, শ্রীরামচন্দ্র এবং তাঁর বাহিনীকে রাবণ বধের আগে পথ দেখিয়েছিল এই পাখি। তাই এ-পাখির দর্শন পাওয়াকে শুভ মনে করা হয়। বর্ষা শেষে এ-পাখির আগমন ঘটে। ধানক্ষেতে পোকা খায়। কিন্তু জমিতে প্রচুর পরিমাণে কীটনাশক ব্যবহার হয়। যার ফলে সংখ্যায় কমছে নীলকণ্ঠ। অথচ ক্ষেতের কীটপতঙ্গ খায় নীলকণ্ঠ। তাই এই পাখিকে কৃষকবন্ধু হয়। এই পাখির সংখ্যায় হ্রাস পাওয়া নিয়ে বিশেষজ্ঞরা আরও একটি কারণ দর্শিয়েছেন। তাঁরা জানিয়েছেন, পুরনো গাছ কাটাও একটি নীলকণ্ঠ হ্রাসের কারণ। নীলকণ্ঠরা পুরনো লম্বা গাছে বাসা বেঁধে। ডিম দেওয়ার জন্য গাছের কাণ্ডে একটি গহ্বর চয়ন করে। গাছই যদি না থাকে, পাখিও বা থাকবে কোথায়?
আরও পড়ুন
১৯৪৭: ভাঙা বাংলার প্রথম দুর্গাপুজো
‘কাশ্মীর রোলার’ নামে এক পাখি আছে। প্রকৃত অর্থে যা নীলকণ্ঠই, অর্থাৎ গলাটাই নীল। এখানে যে নীলকণ্ঠ পাখিকে দেখা যায়, তার স্থানভেদে এমন রূপ। একে তাই কাশ্মীর রোলারের জাতভাই বলাই যায়। মহাদেবকে কেন নীলকণ্ঠ বলা হয়, তা প্রায় সবাই জানেন। দেবতা আর অসুরের সেই সমুদ্রমন্থনের কাহিনি আমাদের সকলেরই জানা। পুরাণ জানাচ্ছে, শিব বিষপান করার পর পার্বতী এসে শিবের গলা চেপে ধরেছিলেন, যাতে সারা শরীরে বিষ ছড়িয়ে না পড়তে পারে। গলা চেপে ধরার ফলে শিবের গলা নীল হয়ে গিয়েছিল, সেই থেকে শিব 'নীলকণ্ঠ'। পৌরাণিক মতানুসারে, নীলকণ্ঠ শিবের বাস কৈলাসে। আর কাশ্মীরি নীলকণ্ঠ পাখির আবাসও হল কৈলাস। হিমালয়ের কাছে তার দেখা মেলে। দেখা পাওয়া যায় লাদাখ অঞ্চলে। অর্থাৎ কৈলাস বেশ কাছে লাদাখ থেকে। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, এখন ভারতের মূল ভূখণ্ডে এরা লুপ্তপ্রায়। মাইগ্রেশনের অঞ্চলে এদের মেরে খুন করে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে। শিব বিষপান করেছিল। আর এই সরল পাখিটিও মনুষ্যত্বের বিষ কোনোরকম দায় ছাড়াই আপন কণ্ঠে ধারণ করে নিশ্চিহ্ন হতে বসেছে। ঠিক এই কারণেই এরা নীলকণ্ঠ।
আরও পড়ুন
সেলুলার জেলে প্রথম দুর্গাপুজো
এ-পাখির নামকরণ নিয়ে সুধীন্দ্রলাল রায়ও লিখেছেন। 'বাঙ্গলার পরিচিত পাখী' বইয়ে সুন্দর এক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, “দেবাসুরের সম্মিলিত চেষ্টায় সমুদ্রগর্ভ হইতে যে হলাহল উঠিয়াছিল তাহা সন্ন্যাসী ভোলানাথ কণ্ঠে ধারণ করিয়া নাম পাইয়াছিলেন নীলকণ্ঠ। কিন্তু আমাদের দেশে শহরে ও গ্রামে, কাননপ্রান্তে ও মাঠের মধ্যে, রেললাইনের ধারে টেলিগ্রাফের তারে যে খেচরটিকে দেখা যায়, তার নাম কেন নীলকণ্ঠ হইল? যখন সে চুপ করিয়া বসিয়া থাকে তখন তার দেহবর্ণে কোনও বিশিষ্টতা লক্ষিত হয় না। চোখের পাশ ও স্কন্ধদেশ নীলাভ হইলেও তাহা দৃষ্টি আকর্ষণ করে না। বাকী দেহটি সামান্য গোলাপী আভাযুক্ত বাদামী রঙের। শরীরের গড়ন মোটাসোটা ঢ্যাপসা গোছের, দোয়েল, শালিক ফিঙ্গে প্রভৃতির মত সুঠাম নহে। কিন্তু যখন সে পক্ষ-বিস্তার করিয়া শূন্যপথে আপনাকে নিক্ষেপ করে, তখন তার পক্ষপতত্রের নিম্নভাগের ঘন নীল বর্ণচ্ছটা ডানার উত্থান পতনের সঙ্গে বিচিত্র দৃশ্যের সৃষ্টি করে— তাহার দেহের রূপ প্রজাপতির মত বর্ণচ্ছটাসমম্বিত হইয়া আমাদের অবাক করিয়া দেয়। মার্কিন দেশের লোক সেইজন্য ইহার নাম দিয়াছে— সারপ্রাইজ বার্ড। ইংরেজ ইহাকে 'দি ব্লু জে' এবং 'দি ইণ্ডিয়ান রোলার' বলে।”
আরও পড়ুন
বাংলায় বর্গি আক্রমণ ও ভাস্কর পণ্ডিতের দুর্গাপুজো
আরও জানা যায় যে, ইউরোপিয় সুন্দরীদের শিরোশোভা বাড়াতে বিভিন্ন পাখির পালক ব্যবহার করত। সেই হতভাগ্য পাখিদের মধ্যে নীলকণ্ঠ একটি। সুধীন্দ্রলাল লিখছেন, “বিলাতী সভ্যতার বিলাসের সামগ্রী যোগাইবার জন্য মানুষ অজ্ঞাতে নিজের অনেক ক্ষতি করে। ইউরোপীয় অঙ্গনাদের শিরোভূষণের জন্য সুন্দর পালকবিশিষ্ট কৃষির উপকারী এরূপ কত পাখীকে যে হত্যা করা হয় তাহার ইয়ত্তা নাই। এইরূপ পাখীদের মধ্যে নীলকণ্ঠ একটি। ইহার পক্ষের উজ্জ্বল নীল পালক শ্বেতাঙ্গিণীদের পোষাকের জন্য বহুল ব্যবহৃত হয়। এই পাখী কৃষির উপকারী বলিয়া আমাদের দেশে আইন অনুসারে ইহা অবধ্য। এমন কি, ইহাকে বন্দী করিলেও জরিমানা হয়। এদেশে বন্দুকের লাইসেন্সের সঙ্গে অবধ্য পাখীর ফিরিস্তি দেওয়া হয়। তাহাতে নীলকণ্ঠের নাম আছে। ভারতের বন্দরে বন্দরে কাষ্টম বিভাগ হইতে কড়া পাহারার বন্দোবস্ত আছে, যাহাতে উপকারী পাখীর পালক রপ্তানী না হয়। কিন্তু উৎকোচের লীলাভূমি ভারতবর্ষে নিষেধ ও পাহারা বজ্রআঁটুনীর ফস্কা গেরোমাত্র। কৃষির পক্ষে হলাহলসম কীটাদি উদরে ধারণ করে বলিয়া হিন্দুরা বোধ হয় একে নীলকণ্ঠ নাম দিয়াছেন। হিন্দুর শাস্ত্রেও এ পাখী অবধ্য।” এই ব্যাখ্যা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, শস্যের যম পোকাদের খেয়ে উদরপূর্তি ঘটায় এ-পাখি। এই কারণে উঠে আসে তার নাম 'নীলকণ্ঠ' কেন, এর উত্তরও।
আলোকচিত্র: কল্যাণ আচার্য
Powered by Froala Editor