পুজো-প্যান্ডেলের গান ও মফস্বলি বৃত্তান্ত

আশির দশকের মাঝামাঝি।
তখনও ডানা গজায়নি অতটা। তবে মহাবিচ্ছু বলে দুর্নামের ঘনঘটা একটু একটু করে ঘনাচ্ছে। মায়ের সঙ্গে, বাবার হাত ধরাধরি পাড়ার পুজো-প্যান্ডেলে পা রাখা।
এদিক ওদিক বন্ধুদের সঙ্গে ছোটাছুটি ও ধুলো-মাখা আছাড়ি পিছাড়ি, নৈবেদ্য, খিচুড়ি-ভোগ, হুল্লোড় আর হ্যাঁ, গান— প্যান্ডেলের গান শোনা। সে এক বিস্ময়কর জগৎ...

ইঁট সিমেন্টের নাটমন্দির গড়ে ওঠেনি তখনও। এক চিলতে মাঝারি মাপের কাঠের পাটাতন দিয়ে তৈরি হত মঞ্চ৷ কাপড় কেটে বসানো হত। তার উপরে ছানাপোনা নিয়ে সপরিবারে বিরাজমান 'দশভুজা'।

মফস্বলি ভদ্রেশ্বর এতটা আধুনিক হয়ে ওঠেনি। তখন ক্যাসেটের স্বর্ণযুগ। সিডি বা পেনড্রাইভে সুর মূর্চ্ছনা ভাবার বাইরে। 

আজও মনে আছে, মণ্ডপের দু'পাশে একজোড়া জাম গাছের মাথায় লাগানো থাকত চোঙা। সেখান থেকে নামত তার। ঢুকে যেত মণ্ডপের পিছনে ছোট্ট ক্লাবঘরে। ব্রিফকেস সাইজের রেকর্ডারে ক্ষুদ্র ছিদ্রের মধ্যে হারিয়ে যেত। অনেকগুলো আলোর একসঙ্গে ওঠানামা, ক্যাসেটের মৃদু ঘড়ঘড় শব্দ আর ফিতে জড়িয়ে যাওয়ার মাঝে একটু একটু করে বেরিয়ে আসতেন হেমন্ত, মান্না, মানবেন্দ্র, কিশোর, লতা, আশা, আর ডি আরও কতজন...

মনে আছে, পাড়ার পুজো-প্যান্ডেলে ক্যাসেট চালানোর দায়িত্ব নিতেন শম্ভুকাকু। গানপাগল এক কড়া ধাতের মানুষ। দীর্ঘদিন সে দায়িত্ব সামলেছেন তিনি৷ বেয়াদপ ছোকরাদের বিদঘুটে 'অনুরোধের আসর' পাশ কাটিয়ে কড়া নজরে চালাতেন গান। চার বেলা, চার রকম। সকালে পুজোর আরতি বা অঞ্জলির সময় হালকা সুরে ভেসে আসত রবীন্দ্র সংগীত বা আধুনিক। 

পাড়ার পুজো-প্যান্ডেলেই প্রথম রবি ঠাকুরের গান শোনা। হেমন্ত মুখার্জির কণ্ঠে 'আমি তোমায় যত শুনিয়ে ছিলেম গান' বা 'কেন পান্থ এ চঞ্চলতা'। বয়স্করা খুশি হতেন। মাঝেমধ্যে স্বাদবদল। মানবেন্দ্র-র 'আমি এত যে তোমায় ভালোবেসেছি', অখিলবন্ধু ঘোষ, জগন্ময় মিত্র, মান্না'র 'যদি কাগজে লেখো নাম' বা সলিল চৌধুরীর 'অবাক পৃথিবী'। দুপুরের দিকে চলত সফট ইন্সট্রুমেন্টাল। মণ্ডপ খালি হয়ে এসেছে। ঢাকিরা ব্যানার্জি জেঠুদের বাড়ি খেতে গেছে। সজলকাকু প্রসাদের ফল ঢেকে রেখে সাইকেলের লক খুলছে। আমরা যাব কি যাব না করে একটু একটু বাড়িমুখো। পাড়ার কাকুরা তাসের আসর গোটাচ্ছে। পাড়ার কুকুরগুলো একটু একটু করে ভিড় জমাচ্ছে দূরে। তখনই কানে ভেসে এসেছে জলতরঙ্গ বা পিয়ানোর সুর। অনেক পরে জেনেছি শিল্পীর নাম— ভি বালসারা। 

আরও পড়ুন
সেলুলার জেলে প্রথম দুর্গাপুজো

বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হতেই আসরে দখল নিতেন লতা, আশা, গীতা না কিশোর। বাংলা ছেড়ে এবার হিন্দি বলয়ে প্রবেশ। হালকা সুরে 'আজিব দাস্তান হ্যায় ইয়ে', 'আইয়ে মেহেরবান', 'সিসা হো ইয়া দিল হো' বা 'তেরে জ্যয়সা ইয়ার কঁহা'র মত গানগুলি গমগম করত মণ্ডপ জুড়ে। সন্ধ্যে আরতির সময় সাময়িক বিরতি। তার পর আবার ফুল ভল্যুমে। রাত যত ঘনাত, ততই বাড়ত হৃদস্পন্দন। 

জামগাছের মাথা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়তেন বাপি লাহিড়ী, নদীম শ্রবন, আনন্দ মিলিন্দরা। 'আই এম আ ডিস্কো ডান্সার', 'জিমি জিমি আজা আজা' বা 'ইয়াঁদ আ রহা হ্যায়' করতে করতে মফস্বলি পাড়া কাঁপাতেন মিঠুন চক্রবর্তী। এর পাশাপাশি কিশোর কুমার, মহেন্দ্র কাপুর বা মহম্মদ আজিজ। 

আহা কীসব গান! 'দেখা না হায় রে সোচা না', 'ইয়ে জওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি' বা কখনো পাড়ার মহিলা মহলের তীব্র প্রতিবাদের মুখে দৈবদুর্বিপাকে পড়ে যেসুদাসের 'গোরি তেরা গাঁও বড়া প্যায়ারা', সুরেশ ওয়াডেকরের 'অ্যায় জিন্দেগি গলে লগা লে' বা কিশোরের 'উহ শাম কুছ আজিব থি'-র সঙ্গে এভাবেই আলাপচারিতা আমার, আমার বন্ধুদের। 

আরও পড়ুন
বাংলায় বর্গি আক্রমণ ও ভাস্কর পণ্ডিতের দুর্গাপুজো

নয়ের দশকে পা রাখতে না রাখতেই হইহই করে পুজো মণ্ডপে ঢুকে পড়লেন অজয় দাস। সুরকার অজয় দাস। অভিনেতা সুখেন দাসের ভাই। তিনি একা নন। সঙ্গে পুলকবাবু (বন্দ্যোপাধ্যায়) এবং কিশোর কুমার। তখন গোটা মফস্বল জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন এই 'ত্রয়ী'। দুর্গাপূজার মণ্ডপ প্রায় ভেসে যাচ্ছে একের পর এক কালজয়ী গানে। অজয়বাবুর সুরে 'মিলন তিথির পূর্ণিমা চাঁদ', 'হয়তো আমাকে কারো মনে নেই' বা 'এপারে থাকব আমি', 'আমার এই কণ্ঠ ভরে'-র মত একের পর এক গানে তখন আমরা মশগুল। হাফ প্যান্ট থেকে ফুল প্যান্ট হওয়ার অনুমতি না পেলেও এসব গান শুনেই সে-বয়সে ভালোবেসে ফেলেছি সুখেন দাস-কে। সেই তুমুল 'মেলোড্রামাটিক ম্যানারিজম'-ই ভীষণ ভালো লেগেছে শুধুমাত্র অসামান্য কিছু গানের দৌলতে। হাঁ করে গিলতাম সেই সব গান।

এরই মাঝে, আবারও 'সিংহাসন' দখল করলেন মান্না দে। ১৯৮৩ সালে মুক্তি পেল 'কফিহাউসের সেই আড্ডা' গানটি। সুপর্ণকান্তি ঘোষের সুরে, গৌরীপ্রসন্নের কথায় সেই গান মফস্বলি বৃত্তে আলোড়ন ফেলতে দেরি করেনি। তখন পাড়ায় পাড়ায়, প্রায় সব পুজো প্যান্ডেলে বাজছে এই গান। লোকেরা দুর্গাপ্রতিমার দর্শন করতে এসে থমকে যাচ্ছেন। গোটা গান শুনে তারপর ছাড়ছেন মণ্ডপ৷ এ আমার নিজের চোখে দেখা। পরে একই চিত্র উঠে এসেছে 'আমায় একটু জায়গা দাও মায়ের মন্দিরে বসি' শোনার সময়েও। হেমন্ত-মান্নার পাশাপাশি আরও এক শিল্পীর গান শোনা যেত। তিনি ভূপেন হাজারিকা। যার গাওয়া 'ও গঙ্গা বইছ কেন' শুনে পুজো মণ্ডপ আন্দোলিত হয়েছে।

বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গানের বহুমুখিতাও ক্রমশ ধরা পড়ছিল পুজো প্যান্ডেলের অ্যাম্পলিফায়ারে। বাংলা গান সেদিনও ছিল। কিন্তু আস্তে আস্তে ডানা ছড়াচ্ছিল বলিউড। অনিবার্য নিয়মে ঢুকে পড়ছিল হিন্দি পপ। আলিশা চিনয়ের 'মেড ইন ইন্ডিয়া' সেই সময় খুব হিট হয়েছিল। প্রথম পুজো মণ্ডপেই শুনি সেই গান। পাশাপাশি সেই প্রথমবার র্যাবপ শোনার অভিজ্ঞতা বাবা সেহগলের কণ্ঠে 'ঠাণ্ডা ঠান্ডা পানি'। এছাড়া বিড্ডু, বালি সাগু, আরইয়ান, ইউফোরিয়া, সন্দেশ শাণ্ডিল্য, সুলতান খানের 'পিয়া বসন্তি রে' বা সন্দীপ চৌটার 'মিট্টি'ও দেখেছি কী হারে প্রভাব বিস্তর করেছিল মফস্বলি ক্লাব-সংস্কৃতিতে। 

আরও পড়ুন
‘অবাঙালি’ দুর্গার খোঁজে

বাংলা গান কিন্তু সম্পূর্ণ হারিয়ে যায়নি সেই বিরুদ্ধ গতিধারায়। সুমন চট্টোপাধ্যায়ের 'তোমাকে চাই' কুড়িয়ে ছিল বিপুল জনপ্রিয়তা। মনে আছে, সেই প্রথম সুমনের গানে এক অদ্ভুত স্পর্শ রেখে যাওয়া ভীষণ কাজ করেছিল। 'অকালবোধনে আমি তোমাকে চাই' শুনে দেবীপ্রতিমা নয়, মণ্ডপের এককোনে মহিলা মহলে আড্ডারত কিশোরীর দিকে তাকিয়ে থেকেছি অমোঘ টানে। 

সুমনের পিঠোপিঠি অন্দর মহলে ঢুকে পড়েছেন নচিকেতা ও অঞ্জন দত্ত। বন্ধুরা মিলেমিশে 'সে প্রথম প্রেম আমার নীলাঞ্জনা' গাইতে গাইতে মহামিলনে খিচুড়ি পরিবেশন করেছি। অঞ্জনকে পেয়েছিলাম মনের নিভৃত কোণে। 'চুপ করে কেন একি বেলা তুমি কাঁদছ?' শুনে অন্য সবার মত চোখে জল এসেছে আমারও। পরবর্তী কালে পুজো প্যান্ডেল কাঁপিয়েছে ভূমি, ক্যাকটাস, চন্দ্রবিন্দু, ফসিলস, এলআরবি... শ্রীকান্ত আচার্যের 'মনের জানালা' তেমনই এক সুরেলা বিস্ময়।

পুজো প্যান্ডেলের গান নিয়ে লিখতে বসলে এক পৃথিবী লেখা হয়েও, হয় না৷ এত গান, এতগুলি বছর, এত স্মৃতি... কাকে ছেড়ে কাকে নিয়ে লিখি। না বললে অবিচার হবে, এই পাড়ার পুজো মণ্ডপেই আলতাফ রাজার 'তুম তো ঠহরে পরদেশি' নিয়ে পাড়ার বড়োদের বকুনির খেতে হয় কচিকাঁচাদের। কিন্তু ওই গানের সুর অগ্রাহ্য করতে পারিনি। পুজো মণ্ডপে বাজানো তাৎক্ষণিক নিষিদ্ধ হলেও 'তুম তো ঠ্যহরে' জায়গা করে নেয় দশমীর উল্লাস মিছিলে। অন্যদিকে এ আর রহমান নামের জনৈক দক্ষিণের সংগীত পরিচালক 'বম্বে' আর 'রোজা' সিনেমায় সুর দিয়ে গোটা দেশে তোলপাড় ফেলেছেন। সেই তরঙ্গ ছুঁয়ে গেছিল আমাদেরও। মণ্ডপে কাজের ফাঁকে ফাঁকে দীর্ঘ সময় ধ্বনিত হয়েছে 'ইয়ে হাসিন ওয়াদিয়া' বা 'ক্যহনা হি কেয়া'র মত গানগুলি। 

আরও পড়ুন
শ্রীরামপুরের ‘ডাচ দুর্গা’ ও গণেশ-যিশুর গল্প

সময় বয়ে চলে দ্রুত৷ কালের নিয়মে। 

মফস্বল ছেড়ে কলকাতা, পরে দিল্লিবাসী হয়েছি। পাড়ায় এখন পাকাপোক্ত নাটমন্দির৷ ক্যাসেটের মৌরসিপাট্টা শেষ হয়েছে বহুদিন। শম্ভু কাকার মতো লোক হারিয়ে গেছেন চিরতরে৷ কিন্তু পুজো এখনো হয় ওই অঞ্চলে। হয় পুজোর গানও। পরিবর্তন এসেছে সুরে, শিল্পীদের আসরে। মাঝেমধ্যেই ঢুকে পড়ে বেনোজল। ঘোলাটে হয় চারপাশ। আবারও আসে স্রোত, ভাঙে নতুন ঢেউ। আবারও লেখা হয় ইতিহাস। মফস্বলি বৃত্তান্তে গানের সুরে। 

ইতিহাস ভাঙে, ইতিহাস গড়ে ওঠে অনুচ্চস্বরে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বদলে যায়। বদলায় সুরের স্বাদও। তবু গানগুলি রয়ে যায়। আজও গমগম করে পুজো মণ্ডপ। 

আমি তার অগোছালো সুরেলা ইতিহাস তুলে ধরার দুঃসাহসিক চেষ্টা করি। প্রতিটি সুরের গায়ে আমার অস্তিত্ব, আমার পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু, ক্লাসফ্রেন্ড ও সর্বোপরি সেই ফেলে আসা একচিলতে নাটমন্দির ও দশপ্রহরণধারিণীর কাঠামোয় আমার বেঁচে থাকার চিহ্ন লেগে থাকে। অবিনশ্বর, অনিঃশেষ। 

'কোলাহল তো বারণ হল, 

এবার কথা কানে কানে।

এখন হবে প্রাণের আলাপ 

কেবলমাত্র গানে গানে।'

Powered by Froala Editor