উনিশ শতকের গোড়ার দিকে কলকেতা, চুঁচড়ো আর চন্দননগরের বাবুদের বাড়ির ঠাকুরঘরে এক নতুন দুর্গা ঠাঁই পেলেন। এক অর্থে এঁদের ‘সাহেব দুর্গা’ বলা চলে। অষ্টাদশ শতকে বাংলার ইউরোপিয় কলোনিগুলো ভরে যেতে থাকে বিদেশি আঁকিয়েতে। তাঁরা রীতিমতো স্টুডিয়ো খুলে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে ছবি আঁকার বায়না নিতেন। তাঁদের দামও ছিল বেশ চড়া। ১৭৯৮ সালের এপ্রিল মাসে কলকাতা গেজেটে মিস্টার মরিস নামে এক শিল্পীর বিজ্ঞাপন থেকে জানতে পারি, শুধু মাথা আঁকাতে খরচ ১৫ সোনার মুদ্রা, আর ফুল লেন্থের বেলায় সেটাই বেড়ে হয় ৮০ স্বর্ণমুদ্রা। কিন্তু টাকা নিয়ে বাবুরা কবে আর ভেবেছে? কিছুদিন নিজেদের ছবি আঁকানোর পর বাবুদের শখ জাগে ইউরোপিয়দের দিয়ে দেশি দেবদেবীর ছবি আঁকানোর। এটাও সত্যি, তেল রঙে তখন তাঁদের জুড়ি ছিল না। এদিকে কলকাতার ইংরেজ শিল্পীদের তখন বেজায় দেমাক। মাটিতে পা পড়ে না। আবার চুঁচুড়া, চন্দননগর, শ্রীরামপুরের মতো ছোটো ছোটো ইউরোপিয় কলোনির আঁকিয়েরা এদিক থেকে অনেক বেশি সহজলভ্য ছিলেন, তাঁরা প্রথম কমিশন নিয়ে হিন্দু দেবদেবীর ছবি আঁকতে শুরু করেন। এ এক অদ্ভুত ব্যাপার। ভারতীয় পুরাণের সঙ্গে ফিউশান ঘটল ইউরোপিয় শৈলীর। পরে এই ঘরানার নাম ‘ডাচ বেঙ্গল আর্ট’ বলা হলেও এতে ফরাসি, ওলন্দাজ এমনকি ইংরেজ আর ভারতীয়দের অবদানও ছিল।
কেমন ছিল এই ডাচ বেঙ্গল পেইন্টিং? প্রায় সব ছবিই তেলরঙে আঁকা। দেবদেবীদের ভাবভঙ্গি সবই পুরাণ থেকে নেওয়া হলেও রঙের ব্যবহার, অ্যানাটমি ইত্যাদিতে ইউরোপিয় পোর্টেট বা ল্যান্ডস্কেপ আর্টের প্রভাব স্পষ্ট। অনেকসময় কোনো ঘটনাকেও ধরা হত এই ধরনের ছবিতে। কালীঘাটের পট বা মিনিয়েচারের চেনা ছক থেকে বেরিয়ে এইসব ছবি অনেক বেশি নাটকীয়। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ, বিষ্ণুর অনন্তশয্যা থেকে শুরু করে কৃষ্ণলীলা বা যশোদা জননী, সবই ঠাঁই পেত এইসব ছবিতে। যেহেতু ছবি আঁকতেন ইউরোপীয়রা, তাই অনেকসময় রেফারেন্স হিসেবে সরাসরি ইউরোপীয় ছবিকেই আশ্রয় করা হত। সবচেয়ে ভালো উদাহরণ ডাচ বেঙ্গল পেইন্টিং এর দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, শিল্পী সরাসরি এফ সি লুইসের আঁকা মহীশূরের মহারাজার দরবারের ছবিটাকে একটু বদলে হস্তিনাপুরের রাজসভা বানিয়ে দিয়েছেন।
আরও পড়ুন
অর্ধনারীশ্বর-আরাধনা ও রূপান্তরকামী-বৃহন্নলাদের শারদীয়া
আরও পড়ুন
শিখ ধর্মগ্রন্থে চণ্ডী-মাহাত্ম্য
এই শিল্পীরাই যখন দুর্গা আঁকেন, তখন তিনিও কিছুটা সাহেবি রূপ নেন। চুঁচুড়া থেকে পাওয়া তিনটি দুর্গার কথা আলোচনা করা যাক। তিনটি তিন রকম। প্রথমটিতে দেবীকে ত্রিশূল হাতে মহিষাসুরকে বধ করতে দেখা যাচ্ছে। দেবীর চোখেমুখে কালীঘাটের পট-সদৃশ কোমলতার বদলে ইউরোপিয় কাঠিন্য। পিছনে চালচিত্রের পরিবর্তে পর্বত, জঙ্গল, যেমন পশ্চিমা ছবিতে থাকে। দ্বিতীয়টি গণেশজননী দুর্গার। দুর্গার মুখ থেকে শুরু করে গণেশের ভাব, সবেতেই অবিকল ম্যাডোনা আর যিশু যেন ফুটে উঠেছেন। আসলে ভারতীয় সংস্কৃতির নানা গল্পের মধ্যে তাঁরা চেনা রূপকে খুঁজে পেতে চাইতেন, আর তাঁরই প্রকাশ ঘটত তাঁদের এই ছবিগুলোতে। চুঁচুড়াতে পাওয়া একটা অদ্ভুত তৈলচিত্রের কথা বলে শেষ করি। ছবিটি উনিশ শতকের শেষ দিক বা বিশ শতকের একেবারে শুরুতে আঁকা। এখানে দুর্গার সঙ্গে একই ফ্রেমে কল্কি অবতারকে দেখা যাচ্ছে। শুধু দেখাই যাচ্ছে না, তলায় লেখা ‘দুর্গাস্বাৎ কল্কিঅবতার’ বা কল্কিরূপী দুর্গা। এই ছবিটি অনন্য। কারণ অন্য কোথাও এভাবে দুর্গার সঙ্গে কলির শ্রেষ্ঠ অবতারকে জুড়ে দিতে দেখা যায়নি। খুব সম্ভব এটি কমিশনড কাজ। কোন খেয়ালি জমিদার বা বাবুর ফরমায়েসমাফিক আঁকা। কিন্তু ভাগ্যিস আঁকা হয়েছিল! নইলে এমন ক্রস ইউনিভার্স আমরা পেতাম কোথায়? আবার অন্য এক ছবিতে দুর্গার বিসর্জনে ইউরোপের ট্যাপেস্ট্রির ভাব একটু খেয়াল করলেই দেখতে অসুবিধে হয় না।
আরও পড়ুন
শরৎ আসে শরৎ যায়, কীভাবে দিন কাটে সাবেক ছিটমহলবাসীদের?
সাহেবি দুর্গার কথা এখানেই শেষ করা যেত। একটা কথা এখানে বলা প্রয়োজন। ডাচ বেঙ্গল ঘরানার প্রভাব কিন্তু সুদূরপ্রসারী। এইসব ইউরোপিয়দের কাছে বেশ কিছু বাঙালি শিক্ষা নিতেন। কালে কালে তাঁরাও একই পদ্ধতিতে এমনভাবে আঁকতে শুরু করলেন যে, খুব ভালো চোখ ছাড়া তফাৎ করা মুশকিল হত। এঁদের মধ্যে একমাত্র বামাপদ বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া কারও নাম বিশেষ জানা যায় না। দুঃখের বিষয়, এইসব অমূল্য ছবির বেশিরভাগই যেহেতু বাবুদের খেয়ালে আঁকানো, বাবুয়ানির পতনের সঙ্গে সঙ্গে ছবিতে পোকায় কেটেছে, নষ্ট হয়েছে, এখনও আমাদের জানার বাইরে রয়ে গেছে কত ছবি। যখন থেকে ক্রিস্টি বা সদবিতে এইসব ছবি কোটি কোটি টাকায় বিক্রি হতে শুরু করল, তখনই বাঙালি ঘর থেকে ঝেড়ে মুছে এইসব ছবি বার করতে গিয়ে দেখল বড্ড দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু এসব কিচ্ছু না। ডাচ বেঙ্গল দেবীদের নিয়ে খাঁটি কথাটা বলেছেন রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়—‘ইউরোপীয়দের থেকে তেলরঙের কৌশল শিখিয়া বাঙালী তাঁহাকে নিজস্ব ঢঙে, নিজস্ব বিষয়ে প্রয়োগ করে। মিথ্যা বলিব না, ইউরোপীয়রাই ভারতীয়দের তেলরঙে আঁকা শিখাইয়াছে।’
Powered by Froala Editor