রুখা দেশের দুর্গাপুজো— শৈশবস্মৃতি

পুজো     অনেকদিনের হারিয়ে যাওয়া হাসি
পুজো     আম-আঁটি আর তালপাতারই বাঁশি
পুজো     মালগোদামে পোটোর ঠাকুর গড়া
পুজো     ছুটির শেষে অ্যানুয়ালের পড়া
পুজো     মেঘের দলের হঠাৎই রংবদল
পুজো     মায়ের মুখে মা দুগ্গার আদল
পুজো     গ্রাম-বাংলার খেতে আউশ ধান
পুজো     ঠামার গলায় আগমনীর গান
পুজো     কিশোর হাতে শারদ সংকলন
পুজো     সেই বই হাতে হাঁটা তো নয়, চলন
পুজো    কয়েকটা দিন স্বর্গ হাতে পাওয়া
পুজো    হ্যাজাক কাঁধে বিসর্জনে যাওয়া
পুজো    এই আসে আর এই তো চলে যায়
আবার একটি বছর কাটে অপেক্ষায়!

এই তো মোটামুটি আমাদের শৈশবের দুর্গাপুজো। কিন্তু ঐ যে বলেছে ‘রুখা দেশের’! সে দেশ তো ‘শ্যামলে শ্যামল নয়…’ তবে অবশ্যই ‘নীলিমায় নীল…’।

আমাদের শৈশব। ১৯৬০ থেকে ১৯৭২-৭৩ সাল। দুই মেরু পৃথিবী। আমেরিকান ব্লক আর রুশ ব্লক-এ ভাগ করে তারা দুনিয়ার দখলদারি নিচ্ছে। বিশ্বের ষাট শতাংশেরও বেশি মানুষ সমাজতন্ত্রের ছত্রছায়ায়। আর তাই বোধ হয় দখলদারির ব্যাপারটি একটু প্রচ্ছন্ন। প্রকট নয়। ‘স্পেস রেস’ চলছে পুরোদমে। ইউরি গ্যাগারিন মহাকাশ ঘুরে এসেছেন, আমেরিকানরা চাঁদে নামার অপেক্ষায়!

দু’টুকরো কোরিয়া উত্তর ও দক্ষিণ, দু’টুকরো জার্মানি পূর্ব ও পশ্চিম, দু’টুকরো ভিয়েতনাম উত্তর ও দক্ষিণ। আর তিন টুকরো বাংলার পশ্চিম খণ্ডটির পশ্চিমতম অংশে আমার দেশ— রুখা-সুখা পুরুলিয়া। 

পাহাড় যেথায় আকাশ ঠেকায়
        পছিম দিকে
সফেন মেঘের দল নিয়েছে
        আকাশ ঠিকেয়
তিন দিকেতে পাহাড় ঘেরা
        উপত্যকা
লালমাটি আর সান্থালদের
        ল্যাংটা খোকা
অর্জুন আর শাল পলাশে
        দেয় পাহারা
দুপুরবেলায় ঘুঘুর ডাক
        আর কাঠঠোকরা
সেই স্বর্গের মধ্যিখানে
        আমার বাড়ি
আজও সেথায় টিপলে পাবে
        আমার নাড়ি!

পুজোর ছুটি পড়ার অপেক্ষা কেবল। ছুটি পড়লেই হাওড়া স্টেশন থেকে ৩১৫ আপ হাওড়া-আদ্রা-চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জারে সওয়ারি হয়ে রাতের ট্রেনে বাবা-মা ও আমরা দু-ভাই রওয়ানা হতাম দেশের বাড়ির উদ্দেশে। একই ট্রেনে ডগ বক্স-এ যেত পরিবারের আরেক সদস্য ‘টিঙ্কু’। আমাদের ডবল কোট অ্যালসেশিয়ান। বাবা সারারাত খড়গপুর, বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়ার মতো বড়ো স্টেশনগুলিতে নেমে তার সঙ্গে দেখা করে আসতেন।

আরও পড়ুন
‘অশরীরী’ দুর্গা ও যামিনী রায়ের বাড়ির ‘মুণ্ড পুজো’

ভোরে ট্রেন আদ্রা ঢুকত। রেল-শহর আদ্রা জংশন স্টেশন। সেখানে কয়লার ইঞ্জিন বদলে ইলেকট্রিক ইঞ্জিন লাগানো হত ট্রেনে। আমরা দু’ভাইও বাবার সঙ্গে প্ল্যাটফর্মে নেমে দাঁত মেজে মুখ ধুয়ে নিতাম। তারপর সবাই মিলে গরম অমৃতি খেতাম। আমরা নিচে দাঁড়িয়ে আর মা ট্রেনে বসেই।

ট্রেন আদ্রা ছাড়লে, পৌঁছাতে আরও দু’ঘণ্টা। গড়ধ্রুবেশ্বর, আনাড়া, কুশটাঁঢ়, বাগালিয়া, ছররা-র পর পুরুলিয়া জংশন— একঘণ্টা। আর সেখান থেকে ছেড়ে টামনা, কাঁটাডি আর উরমা পার করলেই হাওড়া থেকে ২৩৪ কিলোমিটার দূরে, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৮৭ মিটার উচ্চতায় বিহার সীমান্তের ঠিক আগে দক্ষিণ-পূর্ব রেলের সে এক প্রান্তিক স্টেশান ‘বরাভূম’। নিচু প্ল্যাটফর্ম, লাল টালির ‘বিভেল শেড’ অফিসবাড়ি। শেডের একেবারে নিচে উল্টো বল্লম ডিজাইনের কাঠের নক্সা— সবুজ রং করা। বাড়ির একদিকে এস.এম. (স্টেশন মাস্টার)-এর ঘর আর টিকিট কাউন্টার। আর একদিকে একপাশ খোলা বেশ বড়ো ওয়েটিং রুম— ভিতরে দেওয়াল ঘেঁষে পাকাপোক্ত সিমেন্টের চওড়া বেঞ্চ। অনেক দূর গ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে বা গরুর গাড়ি চেপে যারা বড়ো শহরে যাবার জন্য ট্রেন ধরতে আসেন, সময় থাকতে পৌঁছে তাঁরা শুয়ে বসে থাকেন ঐসব বেঞ্চে। কারণ, সারাদিনে কেবল ২টি আপ এবং ২টি ডাউন ট্রেন যায়। বাকি সবই মালগাড়ি। কখনো খনিজ নিয়ে কখনো উলটোপথে ঢালাই ইস্পাত বয়ে।

আরও পড়ুন
বেদাঙ্গ জ্যোতিষের নববর্ষ উদযাপন থেকেই শুরু দুর্গাপুজো?

বাঁদিকে স্টেশন মাস্টারের ঘরের দিকে যেতে দেওয়াল ঘেঁষে রাখা ওয়েয়িং মেশিন। টমাটো, বেগুন, ফুলকপি, বাঁধাকপি ইত্যাদি ওজন করে গুডস্ ক্যারেজে বুক করার জন্য। 

নিজের বিরাট অফিসের একদিকে বেশ বড়ো টেবিলে বসেন স্টেশান মাস্টারমশাই— ছোটকুদার বাবা। তাঁর টেবিলেই ফোন, টরেটক্কা যন্ত্রটি, একদিকে রাখা কাপড়ের লাল ও সবুজ পতাকা। ট্রেন পাস করাবার জন্য। রাতে ঐ কাজই করতে হয় লাল এবং সবুজ ল্যান্টার্ন জ্বেলে। সেগুলি টাঙানো থাকে ঘরের একদিকে— দেওয়ালে। স্টেশান মাস্টারমশাই ছোটোখাটো চেহারার। কিন্তু দারুণ দাপট তাঁর। কেউ কেউ তাঁকে এস.এম. সাহেবও বলে। গুডস্ বা প্যাসেঞ্জার ট্রেন তাঁর স্টাফরা পাস করালেও এক্সপ্রেস ট্রেন তিনি নিজে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে পতাকা নেড়ে পাস করেন।

আরও পড়ুন
পুজোর খেলা, ভাঙার খেলা

তাঁর অফিসঘরের ঠিক বাইরেটাতেই ঝোলানো থাকে ফুট তিনেকের একটি রেললাইনের টুকরো। তাতে বিরাট বড়ো এক নাটবল্টু দিয়ে মেরে— ফার্স্ট বেল, সেকেণ্ড বেল ও থার্ড বেল বাজানো হয়। ট্রেন আগের স্টেশন ছাড়লে ফার্স্ট বেল, স্টেশনে ঢোকার আগে সেকেন্ড বেল। আর থার্ড বেলে ট্রেন বরাভূম স্টেশন ছেড়ে রওয়ানা দেয়।

টিকিট কাউন্টার এবং ওয়েটিং রুমের মাঝ বরারবর একটা করিডর প্ল্যাটফর্ম থেকে সোজা বেরিয়ে যাচ্ছে শহরের দিকে।

শহরের নাম কিন্তু আলাদা— বলরামপুর। আচ্ছা শহর বলা যায় তো বলরামপুরকে? ইলেকট্রিসিটি আসেনি তখনও। মোটে দুটি পাকা রাস্তা। একটি স্টেশান থেকে চক বাজার যাচ্ছে আর অন্যটি টাটা-পুরুলিয়া রোড— যে শহর চিরে বেরিয়ে যাচ্ছে উত্তর-দক্ষিণে। স্টেশান চত্বর থেকে বেরোলেই রিক্সা স্ট্যান্ড। নিচে স্প্রিং লাগানো নিচু এবং চওড়া সিটের এক বিশেষ নক্সায় তৈরি রিক্সা। বেশ কয়েকটি। এখান থেকে বাঁদিকে একটি রাস্তা সোজা গিয়ে বাঘমুণ্ডি রোডে মিশেছে। রেলের জমির উপর দিয়ে বানানো সেই রাস্তা টুকরো চকমকি পাথর ঢেলে রোলার চালিয়ে তৈরি। তার বামদিকে রেলের ছোটো মাঠ, কোয়ার্টার ও মালগোদাম। আর ডানদিকে আমাদের বাড়ি। ঠাকুরদার করা ১৪ কাঠা জমির উপর ভিলা ডিজাইনের ইমারত। গোয়াল, আউট-হাউস এবং বিরাট ও গভীর ইঁদারাসহ পুরোটাই ৬ ফুট পাঁচিল দিয়ে ঘেরা।

সে-বাড়ির তিন পাশ দিয়ে রাস্তা গেছে। গোলসিঁড়ির চার ধাপ উঠে সদর দরজা। তার আগে একটি চওড়া বারান্দা চলে গেছে পুব থেকে পশ্চিমে। সেই বারান্দায় তিনটি জানলা (জানলা না বলে গবাক্ষ বলাই বোধ হয় ভালো, কারণ সেগুলিতে ফ্রেম বা পাল্লা নেই)। বাড়ির দেওয়ালই তিরিশ ইঞ্চির হওয়ায় আমরা দু’ভাই জানলাগুলিতে বসে দেখতাম আর গুনতাম সারাদিন ধরে চলতে থাকা মালগাড়ির বগির সংখ্যা। পশ্চিমে বরাভূম স্টেশানের প্ল্যাটফর্ম ও রাঙ্গাডির বন এবং উত্তর-পশ্চিমে ছোটো কানা, বড়ো কানা ও বুড়া-বুড়ি পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকতাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

শহরে তখন তিনটি বড়ো পুকুর: ধোপা বাঁধ, বড়ো বাঁধ আর মাইতি বাঁধ। ধোপা বাঁধ বাঘমুণ্ডি রোড ও ডাকবাংলো পেরিয়ে ডান হাতে। এটি আমাদের ছিল। বড়ো বাঁধ ছিল গোসালা রোডে লালীমতী বিদ্যালয়ের কাছে। আর মাইতি বাঁধ ছিল বরাবাজার রোড ধরে এগিয়ে এগ্রিকালচারাল ফার্ম পার করে, শহরের একেবারে বাইরের দিকে। তবে সেটিই সবচেয়ে বড়ো বাঁধ হওয়ায় বিসর্জন সেখানেই হত। অবাক লাগছে নিশ্চয়ই, ঠাকুর বিসর্জনের জন্য শহরে একটাও নদী নেই ভেবে? নদী একটা আমাদেরও ছিল এবং এখনও আছে— হনুমাতা। পুরুলিয়ার দিক থেকে বলরামপুরে ঢোকার মুখে। কিন্তু ছোটো–বড়ো পাথরদের পাশ কাটিয়ে বয়ে যাওয়া পাহাড়ি সেই নদীতে বর্ষা ছাড়া সারাবছরই কেবল গোড়ালি ডোবা জল। অগত্যা বাঁধেই। 

সন্ধ্যার আগেই লণ্ঠনের সলতে ছেঁটে, কেরোসিন তেল ভরে, কাচ মুছে জ্বালিয়ে ফেলা হত। হ্যাজাক কেবল রামদা আর শ্রীপতি জেঠু জ্বালাতে পারতেন। আর পারতেন আমার বাবা।

বেশ জোরে পাম্প করে তারপর সিল্কের নেটের তৈরি ‘ম্যান্টল্'-এ আগুন দেওয়া হত। আর একবার দপ করে জ্বলে উঠেই সে আগুন নিভে গিয়ে ম্যান্টল্ থেকে এক অপূর্ব স্নিগ্ধ নীল আলো ছড়িয়ে পড়ত ঘরময়। কেমন যেন স্বপ্নের মতো ছিল সে মায়াবি নীল আলো। ঘর ভরে যেত সে আলোয়। মন আজও ভরে আছে।

বলরামপুরে তখন তিনটি পুজো। একটি দুর্গামেলায়, পাকা মণ্ডপে। সেটিই প্রাচীনতম। ষোলোআনা দুর্গাপুজো। স্টেশান থেকে বাজার যাবার পথে কবিরাজ মশাইয়ের বাড়ির গা দিয়ে বাঁদিকে যে রাস্তা নেমে গেছে, সেই পথে একটু এগোলেই দুর্গামেলা।

এখানে উল্লেখ থাক যে মানভূম অঞ্চলে দুর্গামণ্ডপকে দুর্গামেলা এবং কালীমন্দির ও লাগোয়া প্রাঙ্গণকে কালীমেলা নামেই চিহ্নিত করা হয়। কারণ বোধহয় এই যে পুজোর সময় এইসব জায়গায় বেশ বড়ো করে মেলা বসে। কি না পাওয়া যায় সেখানে— বঁটি, খুন্তি, কাঠের ডাল ঘুরুনি, প্লাস্টিকের রঙিন চুলের ক্লিপ, নানা রঙের চুল বাঁধার ফিতে, কাঠের চিরুনি, কোদাল, গাঁইতি, শাবল, সিঁদুর, আলতা, কুমকুম, সস্তার হাওয়াই চটি, শনের দড়ি, কাঁড় বাঁশ (ধনুক), পাটন ও ঠুঁটি (তীর)-এর ফলা, মাটির হাঁড়ি, কলসি, কুঁজো। আর আসতো পোড়ামাটির উপর রঙ করা নানারকম ‘দেওয়ালি পুতুল’। আর মেলারই এক কোনে এক দুজন মাটির কলসিতে করে মহুয়া নিয়ে আসত আর কচি শালপাতার ‘খালা’-য় (এক রকম বাটি) ঢেলে বিক্রি করত। তবে সেদিকে বাবুছা’রা অর্থাৎ ভদ্রসন্তানরা তখন যেত না।

আরেকটি পুজো হত রেললাইনের ওপারে রাঙ্গাডিতে, বাঘমুণ্ডি রোডের গায়েই। এটিরও পাকা মণ্ডপ ছিল সেই সময়েও।

তৃতীয় পুজোটি হত আমাদের রেলমাঠে— খোলা আকাশের নিচে প্যান্ডেল বেঁধে। সেটিই নবীনতম। আমাদের বাড়ির খিড়কি দরজা থেকে, পশ্চিমের সবকটি জানলা থেকে এবং ছাদ থেকে সে পুজো দেখা যেতো। তবে আমরা ছোটরা ঘর থেকে দেখার অপেক্ষায় থাকতাম না। প্রায় সারাদিন মণ্ডপেই পড়ে থাকতাম। আমরা অর্থাৎ আমরা দু’ভাই ছাড়াও আমাদের পিসতুতো দাদা-দিদি এবং ভাই-বোনেরা। মোট তেরোজন। কারণ আমাদের যাবার খবর হলেই ঠাকুরদা পিসিদের খবর পাঠিয়ে সবাইকে আনিয়ে নিতেন দেশের বাড়িতে। সে এক হইহই ব্যাপার। বাড়িতে তখন কাজের লোকেদের ধরে গোটা তিরিশ পাত পড়ে— এবেলা-ওবেলা।

বাড়ি থেকে রেলমাঠ দূরত্বে পঞ্চাশ মিটারও নয়। দরজা খুলে বেরিয়ে পড়লেই হল।

পাথুরে রাস্তাটি কোনাকুনি পার হলেই আমাদের পুজো। বরাভূম স্টেশানের আপ প্ল্যাটফর্ম যেখানে শুরু হচ্ছে সেখানেই ডানহাতে রেলের মালগোদাম। সম্পূর্ণ করোগেটেড টিনের তৈরি সেই বিরাট মালগোদামের ছাদটা ছিল নৌকার ছই বা গলুইয়ের মতো। সেখানে আমাদের ঠাকুর তৈরি হত। সেও স্টেশন মাস্টারমশাইয়ের বদান্যতায়।

পোটো (পটুয়া) মাস তিনেক আগেই এসে ওখানেই থাকতে লেগে যেতেন। আর একটু একটু করে সেখানেই ঠাকুরের কাঠামো তৈরি, পরতে পরতে মাটি লেপে মা দুগ্গার অবয়ব তৈরি, তাতে রং ধরানো এবং শেষ পর্যন্ত তুলির টানে মায়ের চক্ষুদান। শিশুর চোখে সে এক বিপুল বিস্ময়।

আমরা যেহেতু মহালয়ার সময়েই পৌঁছে যেতাম, তাই পুরোটা না হলেও এই প্রক্রিয়ার বেশ কিছুটা দেখতে পেতাম।

তারপর আর কি, বাঁশ ও শাল বল্লার জোগান করে সবাই মিলে রাস্তাটা পার করে মাকে প্যান্ডেলে এনে ফেলা।

ষষ্ঠীর ভোরে ঢাকে কাঠি। ডিজেল জেনারেটার চালিয়ে সারাদিন মাইকে সেই ঢাকের বাদ্যি, ঠাকুরমশাইয়ের মন্ত্রপাঠ, সমবেত পুষ্পাঞ্জলি।

ক্যাপ ফাটানো বন্দুক তখন এসে গিয়ে থাকবে হয়তো। কিন্তু আমাদের কাছে তা খুব সহজলভ্য ছিল না। তাছাড়া রিল ক্যাপ তখনও আসেনি বাজারে। ফাটাতে হলে একটি একটি করে ক্যাপ ফাটাতে হত। তা বলে কি আমরা ক্যাপ ফাটাতাম না! অবশ্যই ফাটাতাম! তবে আমাদের ব্যবস্থাটি ছিল বেশ অন্যরকম। একটি নাট-বল্টুর নাট ও বোল্টের মধ্যে দুটি স্টিলের ওয়াশার থাকত। ঐ ওয়াশার দুটির মধ্যে আমরা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ৩টি বা ৪টি ক্যাপ বসিয়ে নাট টাইট করে দিতাম। তারপর সেই নাটবল্টু ছুঁড়ে মারতাম মাটিতে। তিন-চারটি ক্যাপ একসঙ্গে ফেটে বেশ জোরেই আওয়াজ করত। তারপর? তারপর আবার ওই একই প্রক্রিয়া। বারবার নিচু হয়ে যাতে কুড়োতে না হয় এজন্য আমরা ওই নাট-বল্টুর সঙ্গে টোন-সুতো বেঁধে হাতে ধরে রাখতাম। অনেকটা লেত্তির মতো।

সন্ধ্যায় প্যাণ্ডেলে টুনি বাল্ব এবং অন্যান্য আলোও জ্বলত ঐ জেনারেটার চালিয়েই। রাতে ভাড়া করা হ্যাজাক ও লণ্ঠন জ্বালিয়ে জেনারেটার বন্ধ রাখা হত।

একবার বড়ো শহর থেকে ভাড়া করে আনা হল রেকর্ড প্লেয়ার। সম্ভবত এইচ.এম.ভি. ক্যালিপ্সো। আর তার সঙ্গে বাজাবার জন্য মাত্র একটি এস.পি.(শর্ট প্লে) রেকর্ড। সেবার পুজোর প্যান্ডেলে পাঁচদিন ধরে বাজল শুধু একটি গান—

 ‘ভুল সবই ভু-উ-উ-ল
এই জীবনের পাতায় পাতায় যা লেখা সে ভুল’

পুজোর সময় এসবের বাইরে খুব বেশি সময় পাওয়া যেত না। তবে যখনই একটু ফাঁক পেতাম আমরা দু’ভাই (একজন ৫ বছরের, অন্যজন ৮) পাথুরে রাস্তাটা ধরে ডাকবাংলো পেরিয়ে চলে যেতাম চকমকি পাথর (কোয়ার্টজ) কুড়াতে। আর অনর্থকই টাঢ়, খেত, আল পেরিয়ে ছুটে যেতাম দিগন্তের দিকে। কখনো কানাপাহাড়মুখো, কখনো রাঙ্গাডির বনের পথে।

কোনো-কোনো দিন বাবাও থাকতেন সঙ্গে। থাকলে ঐ পাথরের রাস্তাটি দেখিয়ে একটি ইংরেজি বাক্য আওড়াতেন বাবা; ‘Zigzag paths of juts and pointed rocks.’ আমরা ভাবতাম ঐ রাস্তাটির বর্ণনা করছেন। এখন বুঝি উনি ইংরেজি অলঙ্কার (alliteration) শেখাচ্ছিলেন।

পুজোরই মধ্যে কোনো একদিন ট্রেনে চেপে পুরুলিয়া যাওয়া হত সদর শহরের পুজো দেখতে। নডিহা, আমডিহা, কুকস্ কম্পাউন্ড, চকবাজার, ভাগাবান্ধ পাড়া, নামোপাড়া, নীলকুঠি ডাঙ্গায় তখনই বড়ো বড়ো সব পুজো হত। সে সমস্ত পুজো দেখে রাতের ট্রেনে আবার বরাভূম ফিরে আসতাম আমরা।

অষ্টমীর দিন ঠাকুরদা-ঠাকুমা, বাবা ও মায়ের সঙ্গে সবাই মিলে গিয়ে ষোলোআনা দুর্গামেলায় আমরা অঞ্জলি দিতাম। গুরুজনদের বক্তব্য ছিল ওটাই পুরনো পুজো, কাজেই অষ্টমীর অঞ্জলি ওখানেই দিতে হবে। ওদিন ভালো করে মেলা ঘুরেই আমরা ফিরতাম। ফেরার জন্য আমাদের বিশেষ তাড়া থাকত না। কারণ সেদিন সারাদিনই নিরামিষ খাওয়া।

নবমীর দিন জাল দেওয়া হত আমাদের পুকুর ‘ধোপা বাঁধ’-এ। জনা চারেক জেলে আসত। খেলিয়ে জাল ছুঁড়ত তারা। তারপর আসতে আসতে টেনে আনত ডাঙায়। সে এক শিল্প। আমরা বাঁধের পাড় ঘিরে দাঁড়িয়ে দেখতাম সবাই। আর আমাদের টিঙ্কু, জলে নেমে তাণ্ডব চালাতো নিজের মতো করে।

জেলেরা জালের সঙ্গে পাড়ে টেনে আনত ইয়াব্বড়ো-বড়ো রুই, কাতলা। ছোটো মাছগুলো আবার ছেড়ে দেওয়া হত জলে। তারপর সেই মাছ নিয়ে বাড়ি ফিরে প্রতিবেশীদের বাড়িতে এক এক করে পাঠানো হত সেই মাছ। পাঠানো হত ঠাকুরদার বন্ধু হোমিওপ্যাথ যমুনা ডাক্তারের বাড়ি, কবিরাজ মশাইয়ের বাড়ি এবং অ্যালোপ্যাথ ও বলরামপুরের প্রথম এমবিবিএস ডাক্তার সুকুমার কাকুর (ব্যানার্জি) বাড়ি।

দশমীর দিন বিকেলে ঠাকুর বরণ করে মায়েদের সিঁদুরখেলা। তারপর সন্ধ্যাবেলায় কাঠ ও লোহা দিয়ে তৈরি ট্রলিতে মা দুগ্গাকে তুলে টানতে টানতে যাওয়া হত এক কিলোমিটার দূরের মাইতি বাঁধে। যেহেতু সেটাই সব থেকে বড় পুকুর ছিল। আর এই গোটা পথটা হ্যাজাক জ্বালিয়ে মিছিল করে যাওয়া হত। কারণ এত বড়ো জেনারেটার মিছিলে নিয়ে যাওয়া যেত না। সে ছিল এক অদ্ভুত শোভাযাত্রা, কলকাতা থেকে প্রায় আড়াইশো কিলোমিটার দূরের বিদ্যুৎহীন এক আধাশহরের অন্ধকার রাস্তা কাঁধে ঝোলানো হ্যাজাকের নরম নীল আলোয় আলোকিত করে!

এমনই একবার, বিসর্জন সেরে সবাই মিলে বাড়ি ফিরেছি। বৈঠকখানা অন্ধকার। অন্ধকার দেখে ভাই কাঁদছে। সেই আওয়াজ শুনে রামদা ভিতর থেকে দৌড়ে এসেছে লণ্ঠন নিয়ে। রেখেছে দাদুর সেক্রেটারিয়েট টেবল্-এর উপর ভাই যেখানে বসেছে তার ঠিক সামনে। আলো দেখে শিশুর কান্না থেমে যায় মুহূর্তে এবং মহানন্দে সে চুমু খেয়ে বসে লণ্ঠনের কাচে। ব্যস পর মুহূর্তেই ঠাঠা চিৎকার— নরম ঠোঁটে ছ্যাঁকা লেগেছে গরম কাচের। সঙ্গে সঙ্গে দৌড়োদৌড়ি, জল, বোরোলিন, বার্নল। বহুদিন লেগেছিল সেই ক্ষত সারতে।

মনে হয় এইতো সেদিন! কিন্তু না, তা তো নয়। পেরিয়ে গেছে পাঁচটি দশক, অর্ধ শতাব্দীকাল। ফিরে তাকালে এক এক সময় মনে হয়, আগের জন্মের কথা নয়তো এসব!

কিন্তু সবই কি হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে? না না যায়নি। 

জানি,
“হে পূর্ণ তব চরণের কাছে
যাহা কিছু সব আছে আছে আছে—’

আর তাই তো আজও ভোরের আলোয় অকারণেই দিগন্তের দিকে ছুটে যায় দুই শিশু। একজন পাঁচ বছরের, অন্যজন আট। পুজো প্যান্ডেলে সারাদিন মাইকে বাজতে থাকে ‘ভুল সবই ভু-উ-উ-ল—’

শেষ রাতে স্ত্রী ডেকে দিয়ে বলেন পাশ ফিরে শুতে।

Powered by Froala Editor