কবিতার দেশে ‘শক্তি-সাধনা’

২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দেশ ছাড়া ইস্তক বিশ্বের যে কয়েকটি শহরে ছড়িয়েছিটিয়ে বিগত দশ বছরের প্রবাস যাপন কাটিয়েছি বা এখনও কাটাচ্ছি, তার একটিতেও আমার কপালে আশ্বিনের শারদপ্রাতের পুষ্পাঞ্জলির ছিটেফোঁটাও জোটেনি; এমনই পোড়া কপাল। আসলে গোটা তুরস্ক দেশে দুর্গাপুজো তো দূরের কথা, দেওয়ালির নামে ইন্ডিয়ান এ্যাসোশিয়ানের বিপুল নিরামিষ খাওয়াদাওয়া ও সান্ধ্য ঝাকানাকা এবং স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ভারতীয় দূতাবাসের একচিলতে অফিসে ফরাসের মতো একটা পতাকা উত্তলন ছাড়া অন্তত আমার আবাসকালে আর কিছুই ঘটত না, এখন কী হয়েছে জানা নেই। এরপর জার্মানিতে প্রচুর বাঙালি বন্ধুবান্ধব সমেত চেষ্টা চরিত্র সত্ত্বেও আমি বেরিয়ে আসার পর  সবে বছরখানেক হল দুর্গাপুজোর উত্তলন হয়েছে। এর মাঝে মার্কিন দেশে মাত্র মাস পাঁচেক ছিলাম, কাজেই সে-কথা বাদ দেওয়াই ভালো। আর সব শেষে এই দক্ষিণ ফ্রান্সের নিস মুলুকে বাঙালি তো দূরে থাক, ভারতীয়ের দেখা মেলাই ভার। সুতরাং পুজো এলেই প্রবাসী মনে মেলামকলির সন্ধে নামে, আর সে একাকিত্বে রেট্রোস্পেক্টই একমাত্র ভরসা। 

যে প্রসঙ্গে এত কথার চর্বিতচর্বণ করলাম এইবার সেই প্রসঙ্গে আসি। পুজোর রেট্রোস্পেকশানে বসলে ছোটোবেলার নতুন জামার গুনতি, অষ্টমীর অঞ্জলির প্যান্ডেলে হলুদ শাড়ির আড়চোখে রোদ-ঝলমলে প্রেম, কুমড়োর সসমাখা এগরোল, ফুটবল বিশ্বকাপের দু’দশক আগে থেকেই কলকাতা কাপানো ভুভুজেলার কানফাটানো আর্তনাদ, বন্ধুদের সঙ্গে প্রথম রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়া, টিউশানির টাকায় আধো-প্রেমের ক্যান্ডেললাইট ইত্যদির মতো আর অনেক কিছু মনে পড়বে সে কথা তো বলাই বাহুল্য, আর স্বাভাবিকভাবেই তেমন স্মৃতির পরিমাণই বেশি। তবে সে ছাড়াও আমাদের কলকাতা তথা বঙ্গের সামাজিক আঙিনার কিছু দ্বন্দ্বমূলক প্রশ্ন পুজো এলেই আমার মাথায় চাড়া দেয় বেশি। যখন ছোটো ছিলাম, বা নেহাতই পড়াশোনায় ব্যস্ত, তখনও প্রশ্নগুলো মাথায় চাগাড় দিয়েছে বটে তবে কথাগুলো গুছিয়ে বলে ওঠার পদ্ধতিটা আওতায় এনে উঠতে পারিনি। এখন বয়স বেড়েছে, ভাববার অভ্যেস বেড়েছে তাই সে সুযোগটাই নিচ্ছি বলতে পারেন। যেমন ধরুন—

    দেবীকে ‘মা’ বলে না ডাকলে বাঙালির পুজো পরিপূর্ণ হয় না কেন? পৃথিবীর প্রায় সমস্ত সভ্যতাতেই ‘উর্বরা’ লিঙ্গ হিসাবে মেয়েদের একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা ছিল এবং থাকবে সে কথা অবশ্যই সত্যি, তা সে সভ্যতা পিতৃতান্ত্রিক হোক অথবা না হোক। তবে ভারতবর্ষের অনুষঙ্গে এবং মূলত বঙ্গ আঙিনায় পূজিতা দেবীকে মাতৃরূপিণী হতেই হবে কেন? ‘উর্বরা’ না হলে কি দেবীত্বে পৌছনো যায় না? একা দশ হাতে অস্ত্রচালনা করার ক্ষমতা যাঁর রয়েছে, তাঁকে কেবল স্নেহময়ী মা অথবা নিরীহ গোবেচারা মিষ্টি বাড়ির মেয়ে হিসাবে পুজো করতে হবে কেন?

    দেবীত্ব স্থাপনের ক্ষেত্রেও আমাদের দেশে কামিনী ও মাতৃত্বের যে বাইনারি ফ্লিপফ্লপের মধ্যে স্ত্রীলিঙ্গকে আটকে রাখা হয়েছে, তার কারণ কী? যে দুর্গা শক্তিরূপিণী দুষ্ট বিনাশিনী হিসাবেই পুরাণে ধরা দেন, তিনি ওড়িশা অঞ্চলের লোকতত্ত্বে কামিনী রূপে রূপান্তরিত হচ্ছেন(যেখানে দেবীকে নগ্ন হয়ে শারীরিক মায়ায় ভুলিয়ে অসুরকে বধ করতে হয়েছে), আবার অন্যদিকে আমাদের বঙ্গে সেই দুর্গাই কেবলমাত্র সুজলা-সুফলা-উর্বরা ঘরের মেয়ে হয়ে থেকে গেলেন। এ-প্রসঙ্গে পুরাণের শরণার্থী না হয়ে উপায় নেই। দক্ষিণ ভারতের কোনো গ্রামে গঞ্জে গিয়ে যদি বলেন দুর্গার চার ছেলে-মেয়ে, অনেকেই রে রে করে তেড়ে আসলে অবাক হবেন না। পুরাণে কিন্তু লক্ষ্মী, সরস্বতী, এবং কার্তিক কেউই দুর্গা ও শিবের আপন সন্তান নন। আর যদি তর্কপ্রসঙ্গে লৌকিক তত্ত্ব মেনে নিয়েও থাকি, তবে সে পুজোয় মেয়েদের স্থান আজও এই ২০২১ সালে দাঁড়িয়েও কেবলই পার্শ্ববর্তী কেন? দেবীপূজায় আজও ‘দ্বিতীয় জন্মপ্রাপ্ত’ ব্রাহ্মণের প্রয়োজন পড়ে কেন? মণ্ডপে যে মাতৃরূপ তথাকথিত ভক্তিভরে পূজিত হন, তারই গর্ভ থেকে জন্মপ্রাপ্ত দুই লিঙ্গের এক রূপ ব্রাহ্মণ্যের পুণ্যলাভ করে তাঁকে আরতি করার অধিকার পান, আর অপরজন কেবল ফল কাটা, প্রদীপের সলতে পাকানো ইত্যাদির মতো পারিপার্শ্বিক কাজেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম আটকে থাকেন।  নারীমূর্তির আরাধনায় নারীরই কোনো অধিকার নেই— এ কেমন দ্বিচারিতা? আর তাছাড়া পূজিতা গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া যে-কোনো লিঙ্গেরই ‘দ্বিতীয় জন্মের’ প্রয়োজন পড়বে কেন?

আরও পড়ুন
বাংলায় বর্গি আক্রমণ ও ভাস্কর পণ্ডিতের দুর্গাপুজো

    কালী-আরাধনার ক্ষেত্রে যখন আমরা তবু এক প্রকারে এই কামিনী-মাতৃ বাইনারি থেকে বেরিয়ে স্বাধীনভাবে কেবল শক্তির পূজায় উপনীত হতে পেরে ভাবলাম, ‘ওহ! এই তো বাঙালির লিঙ্গসাম্য!’, ঠিক তখনই শঙ্কিত ‘উত্তম পুরুষ’কে তার পায়ের তলায় শুয়ে তাকে শান্ত(পড়ুন ইমোশানাল ব্ল্যাকমেইল) করতেই হত! 

এবার ব্যাপার হল, ওপরের প্রশ্নগুলো আমার-আপনার জীবনকালে যেমন প্রাসঙ্গিক, আজ থেকে ২০০ বছর আগেও ঠিক তেমনই ছিল, এবং আমাদের পোড়া কপাল খুব ভুল না বললে পরবর্তী ১০০ বছরে তেমন কিছু পাল্টাবে বলে আমার তো ঠাওর হয় না। কিন্তু সমস্যাটার গোড়ায় পৌছতে হলে এক্কেবারে শুরুতে একটা কাজ করা যাতেই পারে। আমাদের বঙ্গদেশ তথা ভারতবর্ষের তুলনায় কোনো এক অন্যরকম সভ্যতার ধর্মীয় অনুষঙ্গে নারীর সামাজিক বিবর্তনের ইতিহাসকে আয়না হিসাবে ব্যবহার করে একটা সমসাময়িক তুলনামূলক চালচিত্র তৈরি করার চেষ্টা আমরা করতেই পারি। আর বিগত তিন বছর ধরে যখন ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’রই বাসিন্দা হয়ে রয়েছি, তখন ফ্রান্সের সামাযিক ধারার নিরিখে ‘ধর্মের অনুষঙ্গে ফরাসি শক্তি-সাধনা’— এই ইতিহাসকে সে পেডেস্টালে তোলা আমার পক্ষে খানিকটা সুবিধার হয়। নারী আর শক্তি যে সমার্থক, সেই শিক্ষা তো প্রাথমিকভাবে ভারতই দিয়েছে আমাদের। কিন্তু ফ্রান্সে তার প্রতিফলন কেমন? সে কাজটাই এই সীমিত প্রাঙ্গণে স্বল্প পরিসরে জানার চেষ্টা করব। 

আরও পড়ুন
‘অবাঙালি’ দুর্গার খোঁজে

ফরাসি ধর্মীয় ইতিহাসকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যে সালটির উপর দিয়ে সেই লাইন অফ কন্ট্রোল গড়িয়েছে সেটি ১৭৯০, অর্থাৎ ফরাসি বিপ্লব এবং তাকে ঘিরে দোলাচল শুরুর দিন। সে কথায় আসব ঠিকই, কারণ ১৭৯০ ফরাসি খ্রিস্টিয় ধর্মাবলম্বীদের কাছে বিপ্লবের দশক। একই সঙ্গে যেমন দুঃস্বপ্নের, তেমনই নব-অবলোকনেরও বটে। তবে তার আগে জানা দরকার, এই ১৭৯০ সালের আগে মূলত ৩৪টি স্বাধীন রাজ্যে বিভক্ত ফ্রান্স রোমান সাম্রাজ্যের আমলে সম্রাট থেকে প্রজা নির্বিশেষে সকলের কাছে ‘গল’ নামে পরিচিত ছিল। গল অঞ্চলের লোককথা ও নানান আঞ্চলিক ধর্মই বর্তমান ফ্রান্সের মিথোলজি এবং বহু আধুনিক লৌকিক ও ধার্মিক আচারের ভিত্তি। সে-সমস্ত আঞ্চলিক ধর্মের ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলে একাধিক দেবীর খোঁজ মেলে। 

ধরা যাক ‘আবনোবা’-র কথা। শিকারের দেবী। কেবল ফ্রান্সের ভৌগলিক অবস্থানেই নয়, একেবারে বর্তমান জার্মানির ব্ল্যাক ফরেস্ট অবধি তার প্রভাব ও পূজার প্রমাণ পাওয়া যায়। আবনোবা, রোমান দেবী ডায়ানার-ই সমতুল্য প্রতীক। অথবা ভালুকদের দেবী ‘আরটিও’ অথবা পশুদের দেবী ‘দামোনা’র কথাও ধরা যাতে পারে। আমাদের দেশীয় মাতৃবন্দনার কথা দিয়েই যখন এ আলোচনার সূত্রপাত করেছি, তখন এক্ষেত্রে ‘ডিয়া মাত্রোনা’র কথা একবার উল্লেখ করতেই হয়। এই গলিশ মাতৃদেবীর আরেক নাম অবশ্য ‘ডিয়া মাত্রেস’। ডিয়া মাত্রোনার ঐতিহাসিক ছবিতে আমরা তিনজন রমণীকে (হাতে ফল ও ফুলের ঝুরি ইত্যাদি) একইসঙ্গে দেখতে পাই— যার ইংরেজি নাম ‘দা থ্রি মাদারস’। একই ধরনের ত্রিমাত্রিক মাতৃদেবীর উল্লেখ আমরা রোমান, গ্রিক এনং নর্স পুরাণেও দেখতে পাই। রোমান আগ্রাসন-উত্তর শতাব্দীগুলিতে ধীরে ধীরে খ্রিস্টিয় অনুপ্রবেশের পর ৪৯৬ সালে ফ্রান্সের মাটিতে প্রথম রাজকীয় ব্যাপ্টিজমের (রাজা ক্লোভিস) ঐতিহাসিক উল্লেখ পাওয়া যায়। ক্লোভিস-এর ব্যাপ্টিজমের সময়ে নাকি পাদ্রি রেমিজিয়াস ভবিষ্যৎবাণী করে বলেন—

আরও পড়ুন
শ্রীরামপুরের ‘ডাচ দুর্গা’ ও গণেশ-যিশুর গল্প

‘…the Kingdom of France is predestined by God for the defense of the Roman Church, which is the only true Church of Christ.  This kingdom shall one day be great among the kingdoms of the earth, and shall embrace all the limits of the Roman Empire, and shall submit all other kingdoms to its own scepter…’

খ্রিস্টধর্মের বিবর্তন ও জনপ্রিয়তার হাত ধরেই গলিশ ধর্মগুলি কেবলই পুরাণে ও লোককথায় রূপান্তরিত হতে শুরু করে এবং এক সময়ে তুরস্কের এফেসাসে যুদ্ধের দেবী আর্টেমিসের মতই ডিয়া মাত্রেসের স্থান মা মেরীর হাতে প্রতিস্থাপিত হয়; এবং সেই ট্র্যাডিশান সমানে চলেছে। এ তো গেল পূজিত দেবীর কথা। এই পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে ফ্রান্সের ধর্মীয় ইতিহাসের বিশেষ পার্থক্য নেই, আমাদের মতোই ফ্র্যাংকোফোনদের ক্ষেত্রেও দেবীত্বে মাতৃত্বের স্থান বেশ উজ্জ্বল।

কিন্তু বাধ সাধলেন উপাসিকারা, আর সেখানেই আমাদের দুই দেশের ইতিহাসের মাঝে বিরাট এক পার্থক্যের দেওয়াল উঠে গেল। ফ্রান্সের ক্ষেত্রে সমস্ত রকম ধর্মীয় অনুষঙ্গেই মহিলাদের জায়গা বরাবরই সক্রিয়, তা সে নারী বন্দনায় হোক বা নারীহস্তে বন্দনার ক্ষেত্রবিশেষে। একদিকে হিব্রু বাইবেলে যেমন জুডিথ, রুথ, মিরিয়াম ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ পথপ্রদর্শিকাদের নাম আমাদের চোখে পড়ে, তেমনই খ্রিস্টিয় বাইবেল এবং ক্যাথোলিক আইকোনোগ্রাফির অনুষঙ্গে মেরী(মা মেরী নন) এবং অন্যান্য পরিচারিকাদের নাম একাধিকবার ইতিহাসের পাতায় উঠে আসে। বর্তমান উত্তরাধুনিকতার যুগেও, ফ্রান্সের ক্ষেত্রে, ধর্মীয় প্রচারিকা ও নারী প্রবর্তকদের পোশাক-পরিচ্ছেদ, জনসাধারণের মাঝে তাদের উপস্থিতি, নানান সামাজিক কর্মকাণ্ডে মেয়েদের উপস্থিতি ইত্যাদির মতো ধর্মানুবর্তী সামাজিক পেডেস্টালে একটি নির্দিষ্ট ধর্মের জনপ্রিয়তা, এমনকি তার পতনের সম্ভাবনাকেও মাপা হয়ে এসেছে। এছাড়াও অবশ্যই ধর্মীয় নেতৃত্বে নারীর জায়গা ও সাধারণ মহিলা কর্মীদের প্রতি নেতৃত্বের মানসিকতা ও ব্যবহারের উপরও জোর দেওয়ার উজ্জ্বল নিদর্শন গোটা ইতিহাস জুড়েই বিদ্যমান। এই সীমিত পরিসরে গোটা ফরাসী ধর্মীয় ইতিহাসে নারীর স্থান নিয়ে আলোচনা করা কেবলই দুরূহই নয়, অসম্ভবও। তাই আমরা ফ্রান্সের ইতিহাসের দুটি গুরুত্বপূর্ণ সময় বা শতাব্দীর কিছুটা সময় মধ্যেই আনাগোনা করব। 

১৭৯০ সালে শুরু হওয়া ফরাসি বিপ্লবের সমগ্র দশক জুড়েই খ্রিস্টিয় চার্চ ও ধর্মাবলম্বীদের উপর আক্রমণ ও অত্যাচারের কথা সকলেরই কমবেশি জানা। বিপ্লবপূর্ব ধর্মীয় দুর্নীতি যে ‘ডিখ্রিশ্চানাইজেশান’ কর্মকাণ্ডের (১৭৯৩-৯৪)জন্ম দিয়েছিল, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাসের পথেই নানান বেনোজলে দূষিত হতে থাকা সেই এ্যাক্টিভিজম অনেক ক্ষেত্রেই এক অত্যাচার বা টর্চার মেশিনে রূপান্তরিত হয়। প্রায় ৩০০০০-এর বেশি ধর্মীয় পাদ্রি আটক হন, বহু চার্চের সম্পত্তি পুড়িয়ে দেওয়া বা ধ্বংস করা হয়। যেখানেই অত্যাচার মাথাচাড়া দেবে সেখানেই মানুষের স্বাধীন প্রবৃত্তি মাথা তুলে দাঁড়াবে। সুখের কথা, এই মানবিক প্রবৃত্তির সঙ্গে ধর্ম বা পন্থা কোনো কিছুরই বিশেষ সংযোগ নেই। ধর্মের নামে অত্যাচার হলে মানুষ ধর্মের বিপরীতে গেছে, কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক পন্থার নামে শাসক শোষকে রূপান্তরিত হলে তখনকার মতো সেই পন্থার বিপরীতেই স্বাধীনচেতা মানুষের জায়গা হবে, সে-কথা ঐতিহাসিক সত্য। 

ফরাসি বিপ্লবের সেই ‘ডিখ্রিশ্চানাইজেশান’-এর বিরুদ্ধে আমরা কিন্তু ক্যাথলিক মহিলাদেরই অগ্রণী ভূমিকা নিতে দেখি। তৎকালীন মহিলাদের হাতে ভোটাধিকারের শক্তি না থাকায়, ক্যাথলিক পুরুষ এ্যাক্টিভিস্টরা মূলত গ্রামীণ এ্যাসেম্বলি, ভোটাধিকার, নৈতিক পেটিশানের কাজগুলির দায়িত্বে ছিলেন। অন্যদিকে গেরিলা এ্যাক্টিভিজমের মতো সহিংস গুরুদায়িত্বগুলি কিন্তু মহিলা ক্যাথলিকদের ওপরই বর্তেছিল। ১৭৯৪ সালের একটি ঘটনা এই প্রসঙ্গে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কুর্সঁ কমিউনের পাদ্রি বিহীন একটি নির্দিষ্ট চার্চকে ১০৬ জন পুরুষ এ্যাক্টিভিস্ট ‘ক্যাথলিক রিপাবলিক সেন্টার’ হিসাবে ব্যবহার করার আর্জি জানিয়ে তৎকালীন বিপ্লবীদের একটি পিটিশান দেন। স্বভাবতই আর্জি খারিজ হয়। এই ঘটনার দু একদিনের মধ্যেই সেই কমিউনের ক্যাথলিক মহিলাদের নেতৃত্বে শিশু, বৃদ্ধ নির্বিশেষে গ্রামের মানুষ গায়ের জোরে চার্চ অধিকার করেন। এছাড়াও ১৭৯৭ সালের আরেকটি ঘটনায় লা ফের্তে কমিউনের খ্রিস্টিয় পুরুষ কর্মীরা যখন নতুন মিউনিসিপালিটি অফিসের অন্দরমহলে জোর করে আটকে রাখা দুই পাদ্রির নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে পিটিশান জমা দিতে ঢোকেন, গোটা কমিউনের ক্যাথলিক মহিলা সমর্থকরা অফিস ঘেরাও এবং তার সঙ্গে বেশ কিছু সহিংস কার্যকলাপের মাধমে সেই দাবিকে সাফল্য এনে দেন। এই ঘটনা দুটিতে নারীশক্তির কার্যপদ্ধতির সঙ্গে আপনি বা আমি একাত্ম নাই হতে পারি, তবে মনে রাখতে হবে সময়টা অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দশক; যিশুর ক্রুশে ভর দিয়ে মধ্যযুগীয় ও ডার্ক এজের বর্বরতার অন্ধকার থেকে ইউরোপ সবে রেনেসাঁসের হাত ধরে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। তাই বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে তাদের কার্যপদ্ধতি নিয়ে জাজমেন্টাল হয়ে পড়াটা বোধহয় বিশেষ অবজেক্টিভ হবে না। কাজেই এমন ঘটনার একাধিক উদাহরণ ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসে ইতিউতি খুঁজলেই পাওয়া যাবে। তেমনই এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, বারগান্ডির ইয়োন কমিউন এবং প্যারিস বেসিন এই দুই অঞ্চল, যেখানে বিপ্লবের তীব্রতম ছায়া পড়েছিল, সেখানকার ক্যাথলিক নারী সাধিকারা মুক্তহস্তে বিপ্লবীদের সমর্থন করলেও, কেবলমাত্র ডিক্রিশ্চানাইজেশান পদ্ধতির ব্যাপারে কঠিন আপত্তি প্রকাশ করেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল, একাধারে তাঁরা যেমন মোনার্কি মানছেন না এবং বিপ্লবীদের কাজকে সম্মান জানাচ্ছেন, তেমনই নতুন প্রজাতন্ত্রের আইন অনুযায়ী ধর্মীয় স্বাধীনতা তাঁদের ব্যক্তিগত অধিকার— সুতরাং ডিক্রিশ্চানাইজেশান এ্যাক্টিভিজম চললে তাঁরা সশস্ত্র বিপ্লবের রাস্তাতেই হাঁটবেন। 

ফরাসি বিপ্লব সমসাময়িক মহিলাদের তাই কখনোই ধর্মের নামে মুখচোরা ঘরকুনো নারীত্বের ধার ধারতে দেখা যায়নি। তার একটি প্রধান কারণ অবশ্যই এই যে, তৎকালীন ক্যাথলিক অগ্রণী নারী নেতৃত্বের কাছে পরিবার ও কমিউনিটির অনুষঙ্গেই ধর্মের গুরুত্ব ধরা দিয়েছিল। ডার্ক এজ ও বিউবোনিক প্লেগ থেকে বেরিয়ে আসা এবং সদ্য ১৭৯০ সালের দুর্ভিক্ষ কাটিয়ে ওঠা ফরাসি পারিবারিক নারীশক্তি যিশুর হাত ধরেই ছেলেবুড়ো নির্বিশেষে মানুষকে একাত্ম করতে পেরেছিলেন। পরিবারতান্ত্রিক ফরাসি সভ্যতার মধ্যমণি ক্যাথলিক নারী তখন খ্রিস্টকেই কমিউনের খাদ্য ও রাজনৈতিক স্থায়িত্বের কাণ্ডারি ভেবেছেন— যেখানে নরম্যান্ডির নায়েক্স কমিউনে তাকে বলতে শোনা যায়, ‘When God was there, we had bread!’ 

অষ্টাদশ শতাব্দীর পর বিংশ শতাব্দী গোটা পৃথিবী এবং মূলত ফ্রান্সের ইতিহাসে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। রাজনৈতিক দিক থেকে এই শতাব্দী বিশ্বযুদ্ধ, দক্ষিণী মৌলবাদ, নারীবাদের প্রথম দুটি তরঙ্গ— এই তিন ক্ষেত্রেই আন্তর্জাতিক আঙিনায় ফ্রান্সের অগ্রণী ভূমিকা ছিল। আবার অন্যদিকে ধর্মীয় অনুষঙ্গে এ-শতাব্দীই এ-দেশের ক্যাথলিক, প্রোটেস্ট্যান্ট এবং নব ইহুদি ধর্মীয় অবলম্বনকারী যুযুধান নারী নেতৃত্বের মধ্যেকার মতাদর্শগত লড়াইয়ের শতাব্দী। সেই প্রসঙ্গে কখনও ঢুকে পড়ে নারীবাদের রাজনীতি, আবার কখনও বা অস্তিত্ববাদের তাত্ত্বিক প্রকোপ; গোটা শতাব্দী জুড়ে নিজেদের মধ্যেকার তাত্ত্বিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিভেদের মাধ্যমেই ম্যাডেলিন বারো, সুজান দে ডিয়েট্রিক, সিমন দে বাভোয়া, ইয়ং ওমেন’স ক্রিশ্চিয়ান অ্যাসোসিয়েশন(Unions Chrétiennes de Jeune Filles), মউভমেন্ট দে লিবেরেশন দেস ফেম্মেস(MLF) ইত্যাদিরা নিজেদের অজান্তেই এক নিদারুণ দ্বন্দ্বমূলক একান্নবর্তী নারীত্ব-উদযাপন-যজ্ঞে শরিক হন। ধর্মীয় পরিসরে সে-লড়াইয়ের প্রমাণ অবশ্যই ১৮৯৯ সালে নারীবাদী (প্রথম তরঙ্গ) পত্রিকা ‘লা ফ্রন্সে’র মুখ্য সম্পাদক জেন মিসমের মুখে উচ্চারিত প্রোটেস্ট্যান্ট মডারেট-ফেমিনিস্ট এ্যাক্টিভিস্ট সারা মোনোদ সম্পর্কে সেই বিখ্যাত উক্তি—

‘She is called the Papesse of Protestantinism. She is very small…[and] dresses like a Quaker always with a black bonnet, a long jacket and a round skirt…She protests when people call her a feminist, but without thinking she fights the arguments of anti-feminists…She alone possesses the means to assemble and govern… feminism in its entirety.’

আবার অন্যদিকে আমরা যখন প্রথম দশকে যখন ফ্রান্স নারীবাদের প্রথম তরঙ্গের আলোয় তার ঘরের মেয়েদের ভোটাধিকার ছিনিয়ে নিতে দেখি, একই সময়ে দেশের ধর্মীয় নেতৃত্বে থাকা মহিলারা ক্যাথলিক, প্রোটেসট্যান্ট, ইহুদি নির্বিশেষে ‘men make laws and women create morals’ এই শতাব্দী প্রাচীন উক্তিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে প্যারিস কমিউনিটির কনস্টিটিউশান তৈরিতে ব্রতী হচ্ছেন, তাও দেখতে পাই। একই শতাব্দীর পরবর্তী দশকে তৈরি হওয়া ধর্মীয় নারী সংগঠন ‘দ্য ফ্রেঞ্চ ফেডারেশন অফ গার্লস স্কাউটস’(FFE)-এর মহিলা স্বেচ্ছাসেবকদের প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সামাজিক ও পারিবারিক কর্মযজ্ঞের কথাই বা কে ভুলতে পারে? পরিবারতান্ত্রিক যুদ্ধবিব্রত ফরাসি কমিউনগুলোয় বিগত শতাব্দীর মতোই ধর্মীয় নারীশক্তি তার পরিবার ও লোকালয়ের রক্ষার্থে অনেক ক্ষেত্রেই আবারও যিশুকেই বেছে নিয়েছিল। আবার পরবর্তীকালে সিমন দে বাভোয়া এবং তার পিয়ারদের হাতে তৈরি হওয়া মিলিট্যান্ট নারীবাদ তথা সার্ত্রের অনুসরণে এথিক্সের মৃত্যু তথা ‘ওম্যান ইজ দি ফিউচার অফ ওম্যান’কে ব্রাত্য রেখে বহু ধর্মাবলম্বী মহিলা এ্যাক্টিভিস্ট নিজের সংসারের নিশ্ছিদ্র শান্তিকে শিকেয় তুলে নিজেদের মত করেই ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট ধারায় নারীবাদী লড়াইয়েও পা মিলিয়েছেন।

কাজেই বেশ বোঝা যায়, ধর্মীয় ইতিহাসে এবং মূলত আধুনিক খ্রিস্টান ধারায় পুজোর বেদিতে মায়ের স্থান হলেও কেবলমাত্র কামিনী-মাতৃ বাইনারি ডুয়ালিটিতে ফরাসি নারীকে বিভক্ত করা যায়নি। তাঁরা একাধারে যেমন ধর্মকে হাতিয়ার করে নিজের পরিবার ও কমিউনকে যুদ্ধ নামক দুষ্টচক্রের হাত থেকে রক্ষায় অস্ত্র হাতে নিয়েছেন, আবার অন্যদিকে ধর্ম বনাম নাস্তিকতার লড়াইকে দূরে সরিয়ে প্যারিসের রাস্তায় হাতে হাত রেখে মেতেছেন বিশ্বনারীত্বের উৎসবে। এইখানেই আমাদের সঙ্গে এ দেশের পার্থক্য। ধর্ম অনুষঙ্গের সমস্ত ক্ষেত্রেই পুরুষের থেকে কোনো অংশের ফরাসি মেয়েরা পিছিয়ে ছিলেন না, উপরন্তু অনেক ক্ষেত্রে তাঁরাই এদেশে মিলিট্যান্ট ধর্মের কাণ্ডারি হয়েছেন। তবে কি ফরাসি দেশে পুরুষতন্ত্রের সম্পূর্ণ ইতি ঘটেছে? মোটেই না। তেমন হলে এই ২০১৮ সালে এসেও নারীবাদের চতুর্থ তরঙ্গের প্রয়োজন পড়বে কেন? নারীবাদের প্রথম তরঙ্গে পাওয়া ভোটাধিকার, দ্বিতীয় তরঙ্গ ছিনিয়ে নেওয়া গর্ভপাত অধিকার এবং ১৯৯৫ সালে শুরু হওয়া তৃতীয় তরঙ্গে ধীরে ধীরে এক সম্পূর্ণ লিঙ্গবিপ্লব হয়ে ওঠার ক্ষেত্রবিশেষে কখনই ধর্ম-অবলম্বনকারী মেয়েদের পিছিয়ে পড়তে দেখেনি ফ্রান্স। বরং আমাদের দেবী দুর্গার মতো তাঁরাও সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্ত্র ব্যবহারে দশভুজা হয়েই ধরা দিয়েছেন, সংসারী ও গৃহিণীর বেশে কেবল পুরুষতন্ত্রের নামে অভিযোগ করে জীবনটা কাটিয়ে ফেলেননি। কোনো সন্দেহ নেই, আমাদের বঙ্গসমাজে পুরুষতন্ত্র এখনও বিদ্যমান, হয়তো আরো কয়েক শতাব্দী গলার কাটার মতোই সে আমাদের ফ্যাব্রিকে আটকেই থাকবে— তবে আজ অন্তত—

‘…মাতৃপূজার নামে শক্তিবন্দনার নামে বছরের পর বছর ‘মাতৃগর্ভের’ এই অবমাননা বন্ধ হোক। …সহধর্মিণী নয়, মেয়েরা হয়ে উঠুক স্বয়ং যাজক ও যজমান।’ (মল্লিকা সেনগুপ্ত)।

এ গুরুদায়িত্বের এক বিরাট অংশের গুরুভার যেমন সমাজের পুরুষের হাতে বর্তায়, তেমনই অন্যদিকে আমার-আপনার বাড়ির মেয়েদের কামিনী-মাতৃ ডুয়ালিটি ছাড়িয়ে প্রায় জোর করেই ভালোয়-মন্দে শুধুমাত্র মানুষ হয়ে ওঠার সময় এসেছে। আমার সহনাগরিকাদের বলছি— এই সুযোগ! সিমনের সেই ‘হাফ ভিক্টিমস হাফ এ্যাকমপ্লিসেস’ থিয়োরিকে তুড়ি মেড়ে উড়িয়ে দিন দেখি! ভারতবর্ষের মতো পৌরাণিক দেশে ধর্মীয় অনুষঙ্গেই সে লড়াই আরো দীর্ঘজীবী হোক।

‘হাস্তা লা ভিক্টোরিয়া সিয়েম্প্রে’ (এর্নেস্তো ‘চে’ গেভারা)

Powered by Froala Editor

More From Author See More