ইতিহাসের পাতা থেকে আজও চুঁয়ে চুঁয়ে পড়ে রক্তের টুপটাপ। সুদীর্ঘ বঞ্চনার নিরবিচ্ছিন্ন কান্নার স্রোত আজও চলকে পড়ে ভূগোলের রক্তমাখা মানচিত্রের চরাচরে। দেশের স্বাধীনতার পরে নির্মম রাজনৈতিক রসিকতার তিরে বিদ্ধ হয়ে যাদের জীবনের ৬৭টা শারদীয়া কেটে গেছে স্বাধিকার বিহীন ‘দেশহীন দেশে’। অথচ এমনটি তো হওয়ার কথা ছিল না! কোচবিহার ও রংপুরের দুই রাজার খেয়ালি আমুদেপনা আর ভূগোলের মানচিত্র চিরে ভারত বিভাজন— ইতিহাসের এই দুই নির্মম বিদ্রূপের নিষ্ঠুর ফসল ভারতের পূর্ব প্রান্তে এবং অধুনা বাংলাদেশের উত্তর প্রান্তে স্বাধীনতা উত্তর কালে মোট ১৬২টি ছিটমহলের আত্মপ্রকাশ। আর এই ছিটমহলের আত্মপ্রকাশের হাত ধরে পঞ্চাশ হাজাররেরও বেশি ছিন্নমূল ‘ছিটমহলবাসীর’ করুণ সৃষ্টি এবং স্বাধীনতা উত্তর প্রায় ৬৭ বছর ধরে ন্যূনতম নাগরিক পরিষেবাবিহীন ও নিরাপত্তাবিহীন তাঁদের দুঃসহ জীবনের বারোমাস্যা। এমন বুকফাটা হাহাকার চিরেই গড়িয়ে গেল ছিটমহলবাসীর রংহীন স্বপ্ন দিয়ে তিল তিল করে বোনা ছিটমহলের ৬৭টি শারদ উৎসব।
৬৭ বছরের অসহনীয় যন্ত্রণা এবং অপরিসীম বঞ্চনার অবসানে অবশেষে ২০১৫ সালের মে মাসে প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে বিনিময় হয় ১৬২টি ছিটমহল। যার ফলস্বরূপ, ভারতীয় ভূখণ্ডে অবস্থিত মোট ৫১টি বাংলাদেশি ছিটমহল ভারতবর্ষের মানচিত্রে অন্তর্ভুক্তি হয়। অন্যদিকে, বাংলাদেশ ভূখণ্ডে অবস্থিত মোট ১১১টি ভারতীয় ছিটমহল বাংলাদেশের সীমানায় জুড়ে যায়। ৫১টি বাংলাদেশি ছিটমহলে বসবাসকারী মোট ১৪,৮৬৩ জন মানুষের মধ্যে একজনও কিন্তু ফিরে গেলেন না তাঁদের মাতৃভূমি বাংলাদেশে। কিন্তু ১১১টি ভারতীয় ছিটমহলে বসবাসকারী মোট ৩৮,৫২১ জন মানুষের মধ্যে ৯৮৯ জন ফিরে এলেন তাঁদের স্বদেশভূমি ভারতে। বল্গাহীন বঞ্চনার নিকষ কালো রাতের সকল গ্লানি মুছে ফেলে নতুন দিনের নতুন সূর্যালোক গায়ে মেখে নতুন আশার ঝিলিকে বিভোর হলেনভারত-বাংলাদেশের সীমান্তের প্রান্তে পড়ে থাকা এই প্রান্তিক মানুষেরা।
ছিটমহল তো হস্তান্তর হল। সরকারি সিলমোহরও পড়লো ছিটমহল হস্তান্তর সংক্রান্ত গুচ্ছ গুচ্ছ কাগজের পাতায়। সরকারি প্রতিশ্রুতির কোথাও এতটুকুও খামতি ছিল না। ছিটমহল হস্তান্তর-উত্তর ছয় বছরেরও বেশি সময় আজ অতিক্রান্ত। আরও একটা শারদ উৎসব এসে গেল সাবেক ছিটমহলবাসীর হৃদয়ের শরৎকালে। কিন্তু এতকালের ‘দেশহীন’ মানুষজন কেমনই বা আছেন সদ্য ‘দেশবাসী’ হয়ে? শরতের বাঁশি কোন সপ্তসুরেই বা বেজে উঠল নব্য নাগরিকদের চরাচরে?
আরও পড়ুন
রুখা দেশের দুর্গাপুজো— শৈশবস্মৃতি
ভারতে অন্তর্ভুক্ত ৫১টি সাবেক বাংলাদেশি ছিটমহলের ১৪,৮৬৩ জন মানুষদের কাছে প্রাপ্তি বলতে আজ তাঁরা ভারতের নাগরিক, আর তাঁরা ‘দেশহীন ছিটমহলবাসী’ নন। সরকারের কাছ থেকে তাঁদের মিলেছে ভারতীয় ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, রেশন কার্ড এবং জব কার্ড। এতগুলো বছরের অন্যায্য ও অমানবিক বঞ্চনার পরেও এই হতভাগ্য মানুষগুলোর জন্য কোনো নির্দিষ্ট কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা সরকারের তরফ থেকে এখনও অবধি গ্রহণ করা হয়নি। এই নিপীড়িত মানুষগুলোর জন্য সরকারী ক্ষেত্রে চাকরির নিশ্চয়তার স্বার্থে কোন সংরক্ষণেরও ব্যবস্থা করা হয়নি। এই প্রান্তিক মানুষগুলোর কাছে আবাদি জমিই প্রধানতম আয়ের উৎস।
আরও পড়ুন
‘অশরীরী’ দুর্গা ও যামিনী রায়ের বাড়ির ‘মুণ্ড পুজো’
ভারতীয় ভূখণ্ডে ঘেরা ৫১টি সাবেক বাংলাদেশি ছিটমহলের কোনো ছিটেই এতকাল পর্যন্ত দুর্গাপূজা হত না। ছিটমহলের বাইরে ভারতীয় অঞ্চলে আবির্ভূতা দেবী দর্শন করেই ছিটমহলবাসীদের এতকাল সন্তুষ্ট থাকতে হত। ছিটমহল বিনিময়ের পরে ভারতীয় ভূখণ্ডে অন্তর্ভুক্ত ৫১টি ছিটমহলের বাসিন্দারাই ভারতীয় নাগরিকত্ব পেয়েছেন। তাই তাঁদের ভাষায় ‘ছিটমহল স্বাধীন’ হয়েছে। ‘ছিট স্বাধীন’ হওয়ার পরে হিন্দু প্রধান কয়েকটি বড় সাবেক ছিটমহলে দুর্গাপূজার আয়োজন শুরু হয়। পার্শ্ববর্তী গাঁ থেকে মা দুর্গা বাঁশের মাচায় চেপে এসে জৌলুসহীন মণ্ডপে অধিষ্ঠিতা হতেই উৎসবের আবহে মাতোয়ারা হয়ে ওঠেন ‘স্বাধীন ছিটের’ আবালবৃদ্ধবনিতারা। ঢাকের বাদ্দির ছন্দে যেন সকল প্রাণে উচ্ছল নদী বয়ে যায়। পুরুষেরা শশব্যস্ত হয়ে পড়েন মণ্ডপের সাজসজ্জা, আলোকসজ্জা, পূজার খুঁটিনাটির আয়োজনে। মহিলা মহলে ধুম পড়ে যায় পূজার উপকরণ সংস্থানে। যুবক-যুবতীদের কাছে পুজোর কটা দিন যেন মুক্ত বিহঙ্গের অবারিত নীলাকাশ। কচিকাঁচাদের কাছে গোটা পৃথিবীটা যেন হয়ে ওঠে মুক্তপ্রাঙ্গণ। পূজা মণ্ডপকে ভরকেন্দ্র করে আবালবৃদ্ধবনিতার ঢল নামে সাবেক ছিটের পাড়ায়-পাড়ায়, মহল্লায়-মহল্লায়। যে ছিটে দুর্গাপূজা হয় না, সেখানকার মানুষজনও এসে ভিড় জমায় প্রতিবেশী ছিটের পূজা মণ্ডপে। সকল গ্লানির ক্লিষ্টটা ভুলে দুর্গোৎসবের মহামিলন প্রাঙ্গণে অতীত জীবনের ছেঁড়া ছেঁড়া সব পথগুলো ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে শুধুই রৌদ্রকরজ্জ্বল রাজপথের দিশা সমুখপানে এসে আদিগন্তে মিশে যায়।
আরও পড়ুন
বেদাঙ্গ জ্যোতিষের নববর্ষ উদযাপন থেকেই শুরু দুর্গাপুজো?
অন্যদিকে, বাংলাদেশ ভূখণ্ড থেকে আগত সাবেক ভারতীয় ছিটমহলের ৯৮৯ জন মানুষ... যারা স্বদেশভূমির অমোঘ টানে ছলছল চোখে ছেড়ে এসেছেন বাপ-ঠাকুরদার ভিটেমাটি, আশৈশব কাল থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা বন্ধু-পরিজন, ধোঁয়া ধোঁয়া প্রান্তর, গোবর নিকানো উঠোন, আঁকাবাঁকা নদীতীরের আদিগন্ত আকাশের মায়াজাল। তাঁরাই বা কেমন আছেন তাঁদের মাতৃভূমি ভারতে? কাশফুলের উচ্ছ্বাসে কতটুকুই বা শিহরণ জাগে তাঁদের শারদ প্রান্তরে? সরকারের দেওয়া প্রতিশ্রুতি মতো গণপ্রজাতন্ত্রী ভারতবর্ষে তাঁদের স্থায়ী পুনর্বাসন এখনও পর্যন্ত না মিললেও, অস্থায়ীভাবে তাঁদের ঠাই হয়েছে কোচবিহার জেলার মেখলিগঞ্জ, হলদিবাড়ি এবং দিনহাটার ‘ছিটমহল পুনর্বাসন ক্যাম্পের’ দুই কামরার টিনের ঘরে। সরকারি বদান্যতায় ঐ একচিলতে ঘরগুলিতে নিখরচায় জ্বলেছে বিদ্যুতের আলো। মাথার ওপর ঘুরছে পাখাও। কোন কোন ঘরে ঝিকিমিকি দিচ্ছে টেলিভিশনের রঙিন স্বপ্নও। সঙ্গে নিখরচায় মিলেছে পরিবার পিছু একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ চাল, ডাল, ভোজ্য তেল, জ্বালানি তেল, নুন ও দুধ। যা কিনা একটা সংসার চালানোর পক্ষে নিতান্তই অপ্রতুল বলে ক্যাম্পের অধিবাসীদের দারি। সরকারি ব্যবস্থাপনায় ছিটমহল পুনর্বাসন ক্যাম্পের মধ্যে তৈরি করা হয়েছে বটে একটি অস্থায়ী স্বাস্থ্যকেন্দ্র, কিন্তু তাতে ডাক্তার এবং ওষুধ যথেষ্ট অপ্রতুল বলে ক্যাম্পের অধিবাসীদের অভিযোগ। বাংলাদেশ ভূখণ্ড থেকে আগত সাবেক ভারতীয় ছিটমহলের ৯৮৯ জন মানুষদের ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণের স্বপক্ষে মিলেছে ভারতীয় ভোটার কার্ড ও আধার কার্ড। তাঁরা পেয়েছেন রেশন কার্ড এবং জব কার্ড। ভিটেমাটি ছেড়ে আসা এই হতভাগ্য মানুষগুলোর জন্য কোন নির্দিষ্ট কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা সরকারের তরফ থেকে এখনও পর্যন্ত করা হয়নি। এতগুলো বছরের দুঃসহ বঞ্চনার পরেও সরকারি ক্ষেত্রে এই প্রান্তিক মানুষগুলোর চাকরির সুযোগ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে কোন সংরক্ষণের পদক্ষেপও এখনো পর্যন্ত গ্রহণ করা হয়নি। উপরন্তু, বাংলাদেশ ভূখণ্ডের অন্তর্গত সাবেক ভারতীয় ছিটমহলে তাঁদের ফেলে আসা সম্পত্তি কিছু মানুষ জলের দরে বিক্রি করে দিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন। অধিকাংশ পুনর্বাসিত মানুষই তাঁদের সম্পত্তি আদৌ বিক্রি করেও আসতে পারেননি। ফেলে আসা সেই অবিক্রিত সম্পত্তি তাঁরা যাতে ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করে অর্থমূল্য পেতে পারেন, সেই বিষয়ে ভারত বা বাংলাদেশ সরকার নির্দিষ্ট কোনো পদক্ষেপ নিতে এখনও পর্যন্ত আগ্রহ দেখায়নি। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত ভারতীয় ছিটমহলে হাজার অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও তাঁদের মাথা গোঁজার ঠাই ছিল, চাষের জমি ছিল, গবাদি পশু ছিল। কিন্তু ভারতীয় মূল ভূখণ্ডে এসে বর্তমানে তাঁরা শুধু গৃহহীনই নন, কর্মহীনও বটে।
আরও পড়ুন
পুজোর খেলা, ভাঙার খেলা
বাংলাদেশ বেষ্টিত ভারতীয় ছিটমহল থেকে মূল ভারতে পুনর্বাসিত মানুষগুলোর শারদীয়াকে ঘিরে আজন্মের আবেগ বিলক্ষণ আছে। বাঙালি মনন থেকে শিশির ভেজা শিউলির উত্তাল উন্মনা চাপা দিয়ে রাখা যায় নাকি মানব সৃষ্ট বিভাজনের আড়ালে! শরতের মন কেমনের হাওয়ায় পদ্মা, মেঘনা, মধুমতীর দেশেও আদিগন্ত দুলে ওঠে কাশবনের বল্গাহীন উচ্ছ্বাসে। উপচে পরে শিশির ভেজা শিউলির আকুতি। কিন্তু বাংলাদেশী ভূখণ্ডে আবৃত কোনো ভারতীয় ছিটমহলেই দুর্গাপূজার আয়োজন হত না। তবে নিকটবর্তী হিন্দু প্রধান বাংলাদেশি গ্রামগুলোতে অনাড়ম্বর দুর্গাপূজা হত বৈকি। আর তা নিয়েই মেতে থাকত ভারতীয় ছিটমহলের ‘পরদেশীরা’। এক আকাশ বিষাদকে বুকে বয়ে আজন্মের ভিটেমাটি ত্যাগ করে আজ তাঁরা চলে এসেছে ‘নিজ মূলভূমে’। এখানে এখন আর তাঁরা পরদেশি নন। স্বদেশের বদান্যতায় ক্যাম্পের বর্তমান আশ্রয়স্থলেও দুর্গাপূজা হয় না। শারদ উৎসবের দিনগুলিতে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের দুর্গা দর্শন করে বুক ভরা অব্যক্ত ব্যাথার মোচড় বয়ে আবার ফিরে আসতে হয় পুনর্বাসন ক্যাম্পে।
সাবেক ছিটমহলের হৃদয় থেকে ছিটকে ওঠা রক্তের দাগ এখনো লেগে রয়েছে ইতিহাসের পাতায়, ভূগোলের মানচিত্রের ক্ষতে। ৬৭ বছরের নিদারুণ বঞ্চনার ক্ষতগুলো এখনো জমাট বেঁধে রয়েছে সাবেক ছিটের অন্তঃপুরে। বঞ্চিত, অসহায়, বুভুক্ষু মানুষগুলো এখনো চোখ বুজলে শিউড়ে উঠে প্রতিদিন প্রত্যক্ষ করে জীবনের সুদীর্ঘ ৬৭টা বছরের অসহায় মুহূর্তগুলোকে। ৬৭টা শারদ সকালের বুক ফাটা হাহাকারের অন্তঃসলিলা আর্তনাদ। ছিটমহল হস্তান্তর হওয়ার ছয় বছরেরও বেশি সময় পরেও তাঁদের জীবনে এখনো দুর্ভাগ্যের শাপমুক্তি ঘটেনি। এমনি করেই কাশবনে কাঁপন ধরিয়ে আরও একটা শারদ উৎসব ঠিক এসে হাজির হয় সাবেক ছিটমহলবাসীর ভঙ্গুর হৃদয়ের শরৎকালে।
Powered by Froala Editor