পুজোর খেলা, ভাঙার খেলা

'যে খেলায় জিতে যাওয়ার ক্ষীণ সম্ভাবনা আছে, আমি সে খেলা খেলি না।’ বছর তিনেক আগে এরকম অবিন্যস্ত কয়েকটা শব্দ ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল বিলেদা। বাগবাজার ঘাটে আমাদের মাথার ওপর তখন থার্মোকলের চাঁদ, ঘাটের দেয়ালে ঘেমো শার্ট মেলে রাখা। বিপ্র গান ধরেছিল- 'যেও না নবমী নিশি...'; অথচ স্কুলজীবন থেকে আজ অবধি কখনোই তাকে আটকে রাখা যায়নি। কিন্তু বিপ্র প্রতিবার খালিগায়ে জড়ানো চোয়ালে গেয়েছে ঐ বেসুরো কলি। বিলেদার চলে যাওয়াও আটকে রাখতে পারিনি আমরা। নেশার ঘোরে টলতে টলতে একটা আস্ত লোক চলে গেল, চলে গেল এমন একটা খেলায় যেখানে নিশ্চিত পরাজয় জেনেও লোকটা খেলে যেতে পারবে। হাল ছাড়বে না। সামান্য জয়ের প্রত্যাশা যেখানে একটা দুর্বলতা হিসেবে খোঁচা দেবে রোজ, বিলেদা তাই দুহাতে উপড়ে দিতে চায় সেই সম্ভাবনাটুকু। আমরা দেখি আলোয় ঢাকা শহর থেকে অন্ধকার গলির দিকে চলে যায় বিলেদা। আমরা বুঝতে পারি আলোর ঝলকানিতে বে-আব্রু হয়ে যাওয়া শহরের কোনো গোপন কুঠুরিতে ঢুকে যেতে চাইছে উদাস মাতাল। সুমনের সেই গানের মতো কোনো অন্ধকার ছায়া চলে যায় দূরে— 'সাপলুডো খেলছে বিধাতার সঙ্গে...'

খেলা। কত খেলা চারিদিকে। আমার ক্যাপবন্দুকের শব্দে লুকিয়ে পড়ত মিলি। দেয়ালের আড়াল থেকে উড়ে আসত ওর খয়েরি চুল। আমি ট্রিগারে চাপ দিতে গিয়ে ভাবতাম ওর কথা, আমি কি ওকে গুলি মেরে দিতে চেয়েছি কখনো? তবে কি এ খেলায় আমার হেরে যাওয়াই ভবিতব্য?  ওর পিছনে অনেক বড় মাঠ, যেখানে একটু পর ম্যারাপ বাঁধা হবে। মই বেয়ে উঠে তারের সঙ্গে তার, প্লায়ার্সের প্যাঁচ আর বিড়ির ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে একটা গোটা উঠান আলো আলো করে দেবে কেউ। সেখানে মিলি আবার আসবে সন্ধ্যায়, আমি ওর সামনে দাঁড়াব না কিছুতেই। পালিয়ে যাব। ময়দান ছেড়ে পালানোও একটা খেলা, খেলা ভাঙার খেলা। আমি ক্যাপ বন্দুক ফেলে ছুটে চলে যাব ইশকুলের দিকে, নেতাজি ক্লাবের পাশ থেকে সাইকেল নিয়ে আমরা ছুটে যাব ঝিলপাড়ে। আস্ত অজগরের মতো মানুষের স্রোত গুটিগুটি পায়ে এগোতে থাকবে আলোর দিকে। 

কয়েক বছর পর আমার এমন সপ্তমীর সন্ধ্যা এলে কান্না পাবে খুব। পাশে বসা তিন বন্ধুর বিচ্ছেদ হয়ে গেছে কদিন আগে। কাঠবিড়ালির মতো ওরা লাফিয়ে পড়ছে আমার গায়ে। অথচ আমি ঝিলের ওপর দেখছি শিবাজী সংঘের আলো। রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েটের গোড়ায় শেক্সপিয়ার কেন বললেন প্রেম আসলে দীর্ঘশ্বাস দিয়ে তৈরি কোনো ধোঁয়া? Love is a smoke and is made with the fume of sighs? তবে কি ভ্রূ-চন্দনে ডাক দিলে আর দেখা হয়ে যাবে না আমাদের, দেখা হবে না একাকী চন্দনের বনে? সবটাই আসলে খেলা? স্মৃতির কিংবা মায়ার?

প্রথম প্রেমের সঙ্গেই আমার ভেতর এসেছিল একখানা অপার্থিব মুখ, এ ও বুঝেছিলাম পুজোয় প্রথম প্রেম ষষ্ঠীতেই হয়, কিংবা অষ্টমীর সকালে। সপ্তমীর চড়াদাগের সঙ্গে শিউলির প্রথম ঘ্রাণ মিশতে পারে না। এ যেন আর্বানিটির অদ্ভুত শর্ত। পুজোর চারদিনের এমন বিন্যাস দেখে মনে হয়, জীবনানন্দের ভেতর কেউ যেন অল্টারনেট করে ভরে দিয়েছে ভাস্করের গদ্য। শিউলির পাশে গোলাপ। প্রথম প্রেম আসলে সেই অবয়ব যার দিকে তাকিয়ে থাকাই জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য মেনেছি সব্বাই, দুটো আশ্চর্য ঠোঁট যারা শৈশব-কৈশোর কিংবা জড়তার সারেগামা পেরিয়ে প্রথমবার ভালোবাসি বলতে পেরেছিল, যার মুঠোর ভেতরে পৃথিবীর সমস্ত নিশ্চয়তাকে আমরা জোর জবরদস্তি ঠুসে দিতে চেয়েছিলাম, আর প্রথম প্রেম আর পুজোর অদ্ভুত সমাপতনের সাক্ষী হতে লুকিয়ে রেখেছিলাম হলুদ পাঞ্জাবি, লাল পেড়ে শাড়ি, আলগা লেপটে যাওয়া কাজল, অতর্কিতে ছুঁয়ে যাওয়া দুটো কড়ে আঙুল। খেলার ভেতর খেলা, মনের সরলরৈখিক সুতো এলোমেলো করে জেগে উঠছে হরমোনের দোলাচল, চুম্বন কিংবা গোপন স্পর্শকে বৈধতা দেবে না মধ্যবিত্ত পাড়া, এ আমাদের শিখিয়ে দেয়নি কেউ। আড়চোখে দেখেছি শুধু গলির এক প্রান্তকে, যেখান থেকে আমাদের স্পর্শ অবধি একটা শিরশিরে ভয় বিছিয়ে দিয়েছে কেউ। আচমকা সাইকেলের ক্রিং কিংবা ক্যাপ বন্দুকের শব্দে পাখির মতো ডানা ঝাপটিয়ে ওঠে প্রেম। তবু প্রতি পুজোয় চেয়েছি সাইকেলের পিছন থেকে আমাদের মধ্যবিত্ত প্রেম পুজোর চারদিন শুধু ভেসে থাক, হাওয়ায়, মায়ায়। এ পাড়ায় সবাই এমন ভীতু ছিল না কোনোকালেই। কেউ কেউ বাইকের পিছনে বসাত মেয়েদের। প্রতিদিন আলাদা আলাদা ছোঁয়া উপভোগের দিকে আমরা চেয়ে থাকতাম বোকার মতো। ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড কিংবা পুজো প্রেমের এই ফর্মটাকে আমার মনে হত বীরুর ব্যাটিং, বেপরোয়া, আমাদের দ্রাবিড়ীয় সংযমের ধার ধারছে না ওরা, সাদাকালো ছোটো পত্রিকার ভেতর চকচকে পৃষ্ঠায় ছাপা বিজ্ঞাপন। সবাই দেখছে, কিছু বলতে গেলে সামনে এসে পড়ছি আমরা, প্রবন্ধ কিংবা ছোটোগল্প— কিছু একটা। 

আরও পড়ুন
দুর্গাপুজো, বটতলার পুস্তিকা ও প্রথম শারদীয়া পত্রিকা

কান্নার সঙ্গে খেলার একটা অদ্ভুত সম্পর্ক আমি দেখে এসেছি বহুকাল। কে যেন বলেছিল সে-ই বড়ো খেলোয়াড় যে এক ভুল দুবার করে না। আমি মনে মনে বিশ্বাস করতাম, একই কষ্টে দুবার কাঁদতে নেই। দ্বিতীয় কান্নার সময় না কষ্ট এক থাকে না কান্নার ওজন। খেলার শেষে মানুষ কেঁদে ফেলতে পারে আনন্দে, দুঃখে, ক্লান্তিতে কিংবা সবটুকু নিঃস্ব করে ভালোবাসার পর ময়দান থেকে কিছু নিয়ে ফিরতে না পারার যন্ত্রণায়। অষ্টমীর সন্ধেয় হাঁকডাক পড়ে গিয়েছিল আমাদের। ঠাকুরমশাই পদ্ম সাজিয়ে বসবেন সন্ধিপুজোয়। আমাদের মুড়ে যাওয়া পাঞ্জাবি আর ক্লান্তি ছুটে যাবে প্যান্ডেলের কাছে, বড়দিদা এই একদিন নেমে আসেন নিচে, ওঁর শীর্ণ হাত দিয়ে কিছু অপরাজিতার পাপড়ি জমা হয় মায়ের পায়ে। ওই চোখে আমি দেখেছি শুকিয়ে যাওয়া কান্নার রঙ, ঈষৎ সাদা, আমি তো চাইতাম প্রথম দ্বিতীয় কিংবা সিরিজ প্রেমের শেষ মেঘটা একবার অন্তত ঝরে পড়ুক এই সাদা দাগের ওপর, যে কান্না একবারও কেঁদে উঠতে পারেনি কেউ তারা একবার ভাষা পাক। আরেকটু রাত বাড়লেই ও-পাড়া থেকে আচমকা নিখোঁজ হয়ে যাবে ফুলি, কারখানার ছেলের সঙ্গে পালাবে নবমীর ভোররাত হলে, শোরগোল পড়ে যাবে পাড়া জুড়ে। বিজয়াতে আমাদের মিষ্টিমুখে আসবে না ফুলির মা, ফুলিদের ট্রেন ছেড়ে যাবে এই শহরটাকে, পিছনে পড়ে থাকবে আলোর মালা, ওরা জানতেও পারবে না, চারদিনের একটা খেলায় ওরা ঘুঁটি মাত্র। কত দূর পালাতে পারে মানুষ? কত দূরে গেলে সে চাইলেই হারিয়ে যেতে পারবে প্রতিদিন? আমাদের আসল ঠিকানা লেখা ছিল মিত্তির বাড়ির দেওয়ালে, চক দিয়ে, ১০/১০, সুমনীয় পৃথিবীর দশফুট বাই দশফুট!

আরও পড়ুন
দুর্গা-আরাধনার সঙ্গে যেভাবে মিশে গেল নবপত্রিকা-পুজোও

নবমী এলেই আমরা বারবার খুঁজতে বেরোব বিলেদাকে। কিন্তু জানি, পাব না কোনোদিন। গোটা শহরের সমস্ত ট্রাফিকে নিরুদ্দেশের সম্পর্কে ঘোষণা হবে। আমরা কজন বন্ধু একে অপরের বুকে কান পেতে শুনতে চাইব বিলেদার নাম। বিলেদা বলে কোনোকালেই কেউ ছিল না। আবার ছিল ও বটে। বিপ্রর গানের সঙ্গে সঙ্গে পুজো চলে যাবে একটু পর, 'যেও না নবমী নিশি' বলে আসলে আমরা ধরে রাখতে চাইছিলাম আমাদের যাবতীয় অপ্রাপ্তিকে, অপরিণত ভুলকে, সপ্তমীর শুকিয়ে যাওয়া গোলাপকে,আমরা আঁকড়ে থাকতে চেয়েছি মিহি রোদ্দুরে হেঁটে আসা কোনো প্রেমকে, বিচ্ছেদকে। প্রাণপণে দুহাতে আটকে দিতে চেয়েছি প্রিয় স্কোরবোর্ড, চেয়েছি খেলাটা এখানেই থেমে যাক— আসলে তো আমরা চেয়েছি শুধুই ফলাফল— খেলা হলে জয়, প্রেম হলে পরিণতি, বিচ্ছেদ হলে বিস্মরণ! 

আরও পড়ুন
দুর্গাপুজো করে দ্বিগুণ মুনাফা, আমৃত্যু দেবী-আরাধনা ‘বিধর্মী’ চিকবাহাদুরের

আমাদের আঙুলের ফাঁক বেয়ে চলে গেছে কত পুজো, কত প্রেম, কত বিচ্ছেদ, অন্ধকারে আলোর বিন্দুর মতো দুলে দুলে মিলিয়ে গেছে বিলেদা। পুজোর মায়া জুড়ে ফেলে গেছে ওর শেষ কথাটা—

'যে খেলায় জিতে যাওয়ার ক্ষীণ সম্ভাবনা আছে, আমি সে খেলা খেলি না...'

Powered by Froala Editor