‘অবাঙালি’ দুর্গার খোঁজে

দুর্গাকে অভিশাপ থেকে বাঁচিয়েছিলেন কনিষ্ঠ পাণ্ডব সহদেব! অনেকেই এই গল্পটা জানেন না।

জাভা-ইন্দোনেশিয়ার মহাভারত, সেখানকার বিখ্যাত পুতুলনাচ ‘ওয়াইয়্যাং’-এ দেবী দুর্গার এই আজব কাহিনি বর্ণিত আছে। সেই কাহিনিতে সহদেবকে 'শুদ্ধমালা' বলা হয়। বলা ভালো এটা তাঁর উপাধি। এর অর্থ 'অভিশাপ কিংবা পাপ থেকে মুক্তি।' 

ইন্দোনেশিয়ায় 'বাতারা গুরু' (Batara Guru) হলেন রুদ্র শিব। তাঁর অভিশাপ থেকে পত্নী দুর্গাকে(Betari Durga) উদ্ধার করেছিলেন সহদেব।

'শুদ্ধমালা' শব্দটার আরেক অর্থ 'যেতে দেওয়া।' পুতুলনাচে একে 'রুয়াত' বলে।

আরও পড়ুন
শ্রীরামপুরের ‘ডাচ দুর্গা’ ও গণেশ-যিশুর গল্প

একবার শিবের অভিশাপে দুর্গা এক রাক্ষসীতে পরিণত হয়েছিলেন। দুর্গার মুখশ্রী অপরূপ। এক অপরাহ্নে ষাঁড়ে চড়ে তাঁরা স্বামী-স্ত্রী মিলে যাচ্ছিলেন। সমুদ্রের কাছাকাছি আসায় হাওয়ার প্রবল দাপটে উমার বস্ত্র সরে গেলে তাঁর পা দেখে শিবের কামভাব জেগে ওঠে। কিন্তু উমা স্বামীকে সেই সময় বিরত হতে বললে শিবের বীর্য স্খলিত হয়ে সমুদ্রে পড়ে। এতে শিব প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হন এবং অভিশাপ দেন। কিছু কিছু জায়গায় বলা আছে দুর্গা স্বামীর সঙ্গে ছলনা করেছিলেন।

আরও পড়ুন
অর্ধনারীশ্বর-আরাধনা ও রূপান্তরকামী-বৃহন্নলাদের শারদীয়া

ষোড়শ শতকের জাভানীয় জনশ্রুতি, মৌখিক নাটক থেকে প্রফেসর জোটমুল্ডার এই গল্পগুলো সংগ্রহ করে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। কেদিরি(kediri)র তেগোয়াঙ্গি(Tegowangi) মন্দির, সুকু(Sukuh) এবং সেটো(Ceto) মন্দিরে এই গল্পগুলো পাওয়া যায়।  

আরও পড়ুন
শিখ ধর্মগ্রন্থে চণ্ডী-মাহাত্ম্য

শিবের অভিশাপে দুর্গা রাক্ষসীরূপে গন্দমায়ু (Gandamayu, এর অর্থ মৃত্যুর বন) নামক স্থানে বসবাস শুরু করলেন। শিব বলেছিলেন ১২ বছর পর সহদেবের দ্বারা দুর্গার শাপমুক্তি ঘটবে। বহু পথ পেরিয়ে কুন্তীর কাছে গিয়ে দুর্গা সহদেবকে চাইলেন। কুন্তী রাজি হলেন না। পরিবর্তে তিনি যুধিষ্ঠির, ভীম কিংবা অর্জুনকে 'অফার' করলেন। বলাই বাহুল্য দুর্গা তা পত্রপাঠ নাকচ করে দিলেন কারণ সহদেবকে দিয়েই তাঁর শাপমুক্তি হওয়ার কথা। দুর্গা তখন তাঁর অনুগত প্রেতদল এবং কালিকাকে আদেশ করলেন কুন্তীকে মোহাবিষ্ট করে সহদেবকে হস্তান্তর করতে। কালিকার দ্বারা মোহাবিষ্ট কুন্তী সহদেবকে নিয়ে গন্দামায়ুতে প্রায় পৌঁছে গেছেন, এমন সময় কালিকা কুন্তীর শরীর থেকে বেরিয়ে আসায় কুন্তীর মোহজাল ভেঙে গেল।

ক্রুদ্ধ দুর্গার আদেশে কালিকা ফের কুন্তীর শরীরে প্রবেশ করলেন এবং মোহাচ্ছন্ন কুন্তী সহদেবকে একটা গাছে বেঁধে ফেললেন। সেই সময় সহদেবের সঙ্গী সেমার (জাভা ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন পপুলার কালচার এবং কিংবদন্তির বিখ্যাত এক বিদূষক চরিত্র) কালিকাকে অনুরোধ করলেন কুন্তীর শরীর থেকে বেরিয়ে সহদেবের বন্ধন মুক্ত করার জন্য। কালিকা সেই অনুরোধ রাখলেন কিন্তু সহদেবকে তাঁর স্বামী হওয়ার প্রস্তাব দিয়ে বসলেন। সহদেব প্রত্যাখ্যান করায় ক্রুদ্ধ কালিকা সেই মৃত্যুর জঙ্গল থেকে প্রেত এবং ভয়ানক সব জানোয়ার লেলিয়ে দিলেন। 

সব দেখে ভীষণ ক্ষেপে গিয়ে দুর্গা বললেন তাঁর অভিশাপ থেকে মুক্তির সময় এগিয়ে এসেছে, সহদেব যেন  তাঁকে তুষ্ট করে মুক্ত করেন। অধৈর্য হয়ে তাঁর তরবারি বাগিয়ে সহদেবকে তিনি হুমকিও দিলেন। সহদেব তাঁর ইচ্ছাপূরণে ব্যর্থ হলে দুর্গা যখন তাঁকে প্রায় মারতে উদ্যত, সব দেখে নারদ গিয়ে জানালেন শিবকে।

বিপদ আসন্ন দেখে তড়িঘড়ি শিব নিজে সহদেবের শরীরে প্রবেশ করলেন। সহদেবের শরীর আশ্রয় করে শিব নিজে তুষ্ট করলেন দুর্গাকে। দুর্গার শাপমুক্তি ঘটল। তিনি স্বর্গে ফিরে গেলেন। গন্দামায়ু সুন্দর ফুলের বাগানে পরিণত হল।

কিন্তু কুন্তীর শরীরে প্রবেশ করেছিলেন বলে কালিকার পাপমোচন হল না, সেই বাগানের রক্ষী হয়েই থাকতে হল তাঁকে।

শুধু ভারতের বাইরেই নয়, ভারতের বিভিন্ন স্থানেও দুর্গাকে নিয়ে বহু ইন্টারেস্টিং কাহিনি ছড়িয়ে আছে। বিশেষত দক্ষিণ ভারতে দেবীপূজার সুদীর্ঘ ঐতিহ্য বর্তমান। তিনিই একমাত্র যাঁকে তিনভাবে পুজো করা হয়— মন্ত্র, তন্ত্র এবং যন্ত্র। দক্ষিণ ভারতের অজস্র কবিতা, ভাস্কর্য, সঙ্গীত, নৃত্যে দেবী বিদ্যমান। রাজা নরসিংহ বর্মন কর্তৃক নির্মিত বিশ্বখ্যাত মহাবলীপুরম-এর মন্দিরে মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গার মূর্তি পাওয়া যায়। অনেক স্থানে শুধু মহিষের দেহ এবং অসুরের মুণ্ডই মেলে। দেবী এখানে অষ্টভুজা। অস্ত্রে সুসজ্জিতা। আকর্ণ ধনুকের গুণ টেনে রয়েছেন দেবী। সেই যুদ্ধের সাক্ষী অনেক গণ এবং যোগিনীরা।

তামিলনাড়ু জুড়ে দেবীকে উৎসর্গ করা কয়েকটা বড় মন্দির দেখা যায়। তাঁকে মাদুরাইয়ে মীনাক্ষী, কাঞ্চিপুরমে কামাক্ষী এবং আরও অনেক রূপে পুজো করা হয়।

অষ্টম শতাব্দীর বিখ্যাত দার্শনিক আদি শঙ্করের ভূমি কেরালায়। সাড়ে তিন দশকের সংক্ষিপ্ত জীবদ্দশায়, শঙ্কর বৈদিক দর্শনের কিছু প্রধান ভাষ্য লিখেছিলেন। তিনি ব্যাপকভাবে দেশভ্রমণ করেছিলেন। তিনি যে পবিত্র স্থান বা ক্ষেত্র পরিদর্শন করেছেন, সেই ক্ষেত্রের সংশ্লিষ্ট দেবতার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নতুন গান রচনা করেছেন।

 আদি শঙ্কর রচিত শত শত রচনার মধ্যে মহিষাসুরমর্দিনী স্তোত্রম অন্যতম।

শঙ্কর কখন এবং কোথায় তা রচনা করেছিলেন, কেউ জানে না। অত্যন্ত জটিল সংস্কৃত ভাষায় গূঢ় অর্থে ভরা, ‘বীজা অক্ষরাস’ নামে পরিচিত শব্দগুলোর মধ্যে এই রচনা নবরাত্রি উৎসবের বেশ জনপ্রিয়।

আটের দশকে এই রচনা কর্ণাটকি কণ্ঠশিল্পী সি ললিতা এবং সি সরোজা যাঁরা ‘বোম্বে সিস্টার্স’ নামে পরিচিত, তাঁদের রেকর্ডিংয়ের মাধ্যমে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। 

এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে এমনকি ভারতের বিভিন্ন জায়গায় দেবী দুর্গা কিংবা কালীর মতোই কিংবা তাঁদের অবতার হিসাবে দ্রৌপদী শক্তি-দেবী হিসেবে পূজিত হয়ে থাকেন। তাঁর ক্ষমতা সাংঘাতিক এবং ধ্বংসাত্মক। এমনকি তা তাঁর পঞ্চস্বামীর থেকেও বেশি।একবার এক রাত্রে ভীমের হাতে নিশাচর দ্রৌপদীর নখের আঁচড় লেগে রক্তপাত হতে থাকলে তাঁর সন্তানদের জন্ম হয়। দক্ষিণ ভারতে পূজিত দেবী আঙ্কালাম্মানকে(Ankalamman) নিয়ে কিংবদন্তি কিংবা আঞ্চলিক গাথাগুলোর সঙ্গে এই দ্রৌপদীর অনেক মিল আছে। কালীর মতোই এই দ্রৌপদী বন এবং শ্মশানে অধিষ্ঠান করেন। তেলুগু ঐতিহ্য অনুযায়ী শ্রীকৃষ্ণ ভীমকে ব্যখ্যা করেছেন দ্রৌপদী আসলে শক্তির আদিরূপ। তিনি তাঁকে নরমাংস দ্বারা তুষ্ট করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সেজন্যই এত কসরত করে তাঁর এই কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের আয়োজন! মৃতদেহ ভক্ষণ করতে করতে দ্রৌপদী যখন যুদ্ধক্ষেত্রে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, ভীম তাঁকে যৌনসঙ্গমে তৃপ্ত করে তাঁর সমস্যার সমাধান করতে পারেন না টের পেয়ে কৃষ্ণ নিজের শক্তির একটা অংশ ভীমকে দান করলেন। ফলস্বরূপ দ্রৌপদী কৃষ্ণকে তাঁকে বিয়ে করতে বললেন। কৃষ্ণ প্রতিশ্রুতি দিলেন পুরীর জগন্নাথরূপে তিনি সেই কথা রাখবেন। গবেষক হিল্টেবিটেল বলেছেন, এই প্রতিজ্ঞা আদৌ রাখা হয়েছিল কিনা সে এক রহস্য। তবে ১৯৮২ সালে লেখা  গবেষক শার্লট ভডেভিলের 'কৃষ্ণ অ্যান্ড দ্য গ্রেট গডেস' গবেষণাপত্রে কিছু মন্তব্য পাওয়া যায়। তিনি দেখিয়েছেন, পুরীর বিমলা দেবী মন্দিরে জগন্নাথের বাম পার্শ্বে মা দুর্গা অবস্থান করছেন। 

বিমলা দেবীকে নিয়ে অনেক রকমের মত পাওয়া যায়। শাক্তদের বিশ্বাস অনুযায়ী, বিমলা হলেন পুরুষোত্তম  শক্তিপীঠের প্রধান দেবী। বিষ্ণু বা কৃষ্ণের  রূপ জগন্নাথকে বিমলার ভৈরব মনে করা হয়। ভৈরব সাধারণভাবে শিবের একটা রূপ হলেও, এখানে ব্যতিক্রম দেখা যায়। তাই এই মন্দিরে বিষ্ণু ও শিবকে অভিন্ন মনে করা হয়। একইভাবে শিবের পত্নী বিমলা ও বিষ্ণুর পত্নী লক্ষ্মীও এখানে এক। তান্ত্রিক মতে, জগন্নাথকে বিষ্ণুর রূপ মনে করা হয় না। এই মতে তিনি শিব-ভৈরব।

জগন্নাথ মন্দিরের মূল গর্ভগৃহে জগন্নাথ, বলভদ্র (কৃষ্ণের দাদা, যাঁকে শিব মনে করা হয়) ও সুভদ্রার (কৃষ্ণ ও বলভদ্রের ছোটো বোন) মূর্তি আছে। জগন্নাথ-কেন্দ্রিক ধর্মবিশ্বাসে, লক্ষ্মী জগন্নাথের পত্নী। অন্যদিকে বিমলাকে জগন্নাথের তান্ত্রিকা পত্নী ও মন্দির চত্বরের রক্ষয়িত্রী মনে করা হয়। বিদ্যাসাগরকে নিয়ে লেখা মাইকেল মধুসূদন দত্তের বিখ্যাত কবিতার 'বিমলা কিংকরী' এই প্রসঙ্গে এসেছে কিনা, তা আমরা জানি না। বিমলাকে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে কাত্যায়নী, দুর্গা, ভৈরবী, ভুবনেশ্বরী অর্থাৎ দেবী পার্বতী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। জগন্নাথ মন্দিরের দুর্গাপূজায় তাঁকে একাধারে শিব ও বিষ্ণুর শক্তি মনে করা হয়। নতুন দিল্লির জাতীয় সংগ্রহালয়ে রক্ষিত কোণার্ক সূর্যমন্দিরের এক পাথরে (খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দী) বিমলাকে মহিষাসুরমর্দিনী বা বিজয়লক্ষ্মী রূপে আঁকা হয়েছে।

বিমলা মন্দির জগন্নাথ মন্দির চত্বরের একটা ছোটো মন্দির হলেও শাক্ত ও তান্ত্রিকদের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ তীর্থ। তাঁরা মূল জগন্নাথ মন্দিরের চেয়েও এই মন্দিরকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। তান্ত্রিক মতে, বিমলা জগন্নাথের শক্তি এবং মন্দির চত্বরের রক্ষয়িত্রী। ভক্তেরা মূল মন্দিরে জগন্নাথকে পুজো করার আগে বিমলাকে পুজো করেন। জগন্নাথের প্রসাদ বিমলাকে নিবেদন করার পরেই মহাপ্রসাদ হিসেবে গণ্য হয়।

 দ্রৌপদীর শক্তির দিকটা বিখ্যাত তামিল 'তেরুকুট্টু' অর্থাৎ পথনাটিকায় (মূলত এই তেরুকুট্টুগুলোয় দ্রৌপদীর উপরে সবচেয়ে বেশি আলো ফেলা হয়। কুশীলবরা রংচঙে পোশাক পরে নৃত্যগীত সহযোগে পরিবেশন করেন। হারমোনিয়াম, ঢোল প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র বাজে।) মহা সমারোহে দেখানো হয়। তেরুকুট্টুতে ১৮ দিনের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সমাপ্তির পর দেখানো হয় দ্রৌপদী দুর্যোধনের ঊরু অথবা বুকের উপর উঠে দাঁড়াচ্ছেন, ঠিক দুর্গা মহিষাসুরকে যেভাবে পদদলিত করেন। দ্রৌপদী এরপর দুর্যোধনের অন্ত্র টেনে বার করে আনেন এবং শ্রীকৃষ্ণ তাঁর চুল বেঁধে দেন। এই উৎসবের শেষটা অনেকটাই নবরাত্রি কিংবা আমাদের বিজয়া দশমীর মতো।

দক্ষিণ ভারতের বিখ্যাত জনশ্রুতি এবং কিংবদন্তিগুলোয় পোত্তু রাজা কিংবা পরমান্নানের কাহিনি পাওয়া যায়। তিনিও ছিলেন আরও এক মহিষাসুর। 

দক্ষিণ ভারতের প্রচলিত কাহিনি অনুযায়ী দুর্যোধনের দ্বারা প্রকাশ্যে নিগৃহীত হয়ে দ্রৌপদী প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যতদিন না পর্যন্ত দুর্যোধনের ঊরুর হাড় দিয়ে তাঁর চিরুনি তৈরি হবে, ততদিন তিনি চুলই বাঁধবেন না। তিনি বললেন তাঁর পঞ্চস্বামী যতদিন না পর্যন্ত গুরুলিঙ্গম নামক এক যুদ্ধবাজ ব্যক্তির পঞ্চযন্ত্র ভিরাপ্পাম্পাই, ভিরাক্কাট্টি, ভিরাক্কান্তাকাম, ভিরামাল্লারি, উতুক্কাই - অর্থাৎ পবিত্র চাবুক, তরবারি, ঢাক, তোরঙ্গ এবং প্রদীপের অধিকারী না হচ্ছেন, ততদিন অবধি দুর্যোধনকে হারানো অসম্ভব। এই জিনিসগুলো সংগ্রহ করার জন্য অর্জুন বিজয়মপাল নাম্নী এক সুন্দরী নারীর ছদ্মবেশ ধরে গুরুলিঙ্গমের পুত্র পরমান্নানকে প্রলুব্ধ করলেন। মায়ায় ভুলে পরমান্নান তাঁর পিতাকে হত্যা করে অর্জুনকে পঞ্চযন্ত্র এনে দিলেন। তাঁর ভালবাসার নারী আসলে নারী নন— এই সত্য প্রকাশ হয়ে পড়ার পর ভয়ংকর ক্ষেপে গেলেন পরমান্নান। দাবি করলেন পাণ্ডবদের তাঁকে একজন স্ত্রী দিতেই হবে। পরিস্থিতি ঠান্ডা করার জন্য পাণ্ডবরা তাঁদের ছোটবোন শঙ্কুবতীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে দিলেন।

দক্ষিণ ভারতীয় কিংবদন্তিগুলোয় পোত্তু রাজা এরপর দ্রৌপদীর ভীষণ অনুগত এবং সেবকে পরিণত হন।

এই পরমান্নান যেন অনেকটাই মহিষাসুরের অল্টারইগো। মহিষাসুর দুর্গার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাঁকে বিবাহ করতে চান(অথবা শুম্ভ-নিশুম্ভ, কৌষিকী কালিকার গল্পের মতো)। পরমান্নান বিজয়মপালকে বিয়ে করতে চান। তাঁকে প্রলুব্ধ করে তাঁর বিনাশের জন্য দুর্গা মহিষাসুরকে বলেছিলেন তাঁকে যুদ্ধে পরাজিত করতে পারলে তিনি তবেই তিনি তাঁকে বিয়ে করবেন। পঞ্চযন্ত্র হরণ করার জন্য কৃষ্ণ পরমান্নানকে বলেছিলেন বাবাকে হত্যা করলে তবেই তিনি বিজয়মপালকে লাভ করতে পারবেন। মহিষের শিরশ্ছেদ করা হয়েছিল৷ 

পরমান্নানের বাবারও শিরশ্ছেদ করা হয়েছিল। মহিষাসুরের মতো পরমান্নানও দ্রৌপদীর ভক্ত এবং সেবকে পরিণত হন।

এই আশ্চর্য মহাভারতে ছিলেন এক শতানন। তাঁর নাম রোকাকান(Rocakan) কিংবা আকালাম্মান(Acalamman)। জন্মেজয়ের নাতি সুনীথা তখন হস্তিনাপুর শাসন করছেন। বক রাক্ষসের বংশধর ছিলেন এই আকালাম্মান। বকের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবেন বলে সুনীথাকে যুদ্ধের জন্য তৈরি হতে বলে তিনি  একটা চিঠি পাঠান। এই শতানন আকালাম্মানের উপর ব্রহ্মার বর ছিল তাঁর মূল মাথা যে কেটে মাটিতে ফেলবে সে ধ্বংস হয়ে যাবে (ঠিক যেন জয়দ্রথের কাহিনি)।

সুনীথা প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেলেন। প্রাজ্ঞ মানুষরা তাঁকে পরামর্শ দিলেন একমাত্র দ্রৌপদীই পারেন সেই শতাননকে বধ করতে। তিনি পরাশক্তি। কিন্তু তিনি তখন আর ধরাধামে নেই! তাঁকে পুনর্জন্ম নিতে হবে। এখানে আরও একটা বিষয় আছে। যে দুই ঋষির দ্বারা যজ্ঞাগ্নি থেকে দ্রৌপদীর পিতা তাঁকে লাভ করেছিলেন, সেই উপায়ন(Upayan) এবং যশন(Yacan) কেই সেই যজ্ঞ করতে হবে। সারা ভারত ঢুঁড়ে জিঞ্জিতে নদীর তীরে সুনীথা সেই দুই তাপসকে পেলেন। তাঁদের চেষ্টায় সেই নদীর তীরে যজ্ঞানল থেকে কলিযুগে দ্বিতীয়বার জন্ম নিলেন পরাশক্তি। 

এইবার সুনীথা কলিঙ্গদেশে গেলেন পোত্তুরাজার কাছে। তিনি চরম শিবভক্ত। শিবলিঙ্গকে মাথায় করে বহন করেন তিনি। দ্রৌপদী বললেন পোত্তুরাজাই সঠিক লোক।

এরপর শতাননের সঙ্গে ঘোরতর যুদ্ধ হল দ্রৌপদীর। একে একে তাঁর নিরানব্বইটা মাথা কেটে ফেললেন। মূল মাথাটা কেটে ফেলার পর সেটা মাটিতে পড়বার আগেই ধরে ফেললেন পোত্তুরাজা। তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন, সারাজীবন তিনি সেই মাথাটা ধরে রাখবেন।

ঋণ :
১. THE CULT OF DRAUPADI ( VOL 1 &2) - ALF HILTEBEITEL
২. THE REDISCOVERY OF THE SUDAMALA STORY : THE NARRATIVE RELIEF OF THE CANDI TEGOWANGI BETWEEN LITERACY AND ORALITY - AKIKO NOZAWA
৩. WORSHIPING THE GODESS IN SOUTH INDIA : IN POETRY, SCULPTURE, DANCE AND SONG - VEEJAY SAI

Powered by Froala Editor

More From Author See More