সেলুলার জেলে প্রথম দুর্গাপুজো

যে সেলুলার জেল ১৯০৯ থেকে চালু হয়ে চিরতরে বন্ধের ঘোষণা করে ১৯২১-এ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তা চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ এবং অন্যান্য নানা বিপ্লবী আন্দোলনের প্রতিঘাতে পুনরায় খোলা হল ১৯৩২-এ। এবারে বেশিরভাগই বাঙালি বিপ্লবী। এঁরা এসেই ১৯৩৩-এর মে মাসে বিভিন্ন অধিকারের দাবিতে হরতাল শুরু করলেন। সাধারণ কাজ বন্ধের ধর্মঘটের পাশাপাশি শুরু হল ভুখা হরতাল। এই ভুখা হরতাল ভাঙতে চেয়ে জোর করে নাকে রবারের নল গুঁজে খাওয়াতে গিয়ে মেরে ফেলা হল মহাবীর সিং, মোহন কিশোর নমোদাস এবং মোহিত মোহন মৈত্রকে। দেশের মূল ভূখণ্ডে এই নিয়ে সমালোচিত হল ব্রিটিশ সরকার। মিছিল, জনসভা, গণবিক্ষোভ সংঘঠিত হল। অবশেষে জেল কর্তৃপক্ষ মেনে নিতে বাধ্য হল রাজবন্দিদের বিভিন্ন দাবি।

জুলাই মাসে হরতাল শেষ হবার পর প্রথম যে সুযোগ সুবিধা রাজবন্দিরা পেয়েছিলেন তার মধ্যে সবচেয়ে আনন্দদায়ক অংশটি হল সেলুলার জেলের ভেতরে দুর্গাপূজার আয়োজন করা। সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন পুজোর প্রস্তুতিতে।

পুজো উপলক্ষে গড়ে তোলা হল বিভিন্ন কমিটি— পুজো কমিটি, স্টোরস কমিটি, নাটক কমিটি, বিনোদন কমিটি, অভ্যর্থনা কমিটি, কিচেন কমিটি প্রভৃতি। খুব সামান্য কয়েকজন বাদে সবাই মেতে গেলেন পুজোর প্রস্তুতিতে। রোজই বিভিন্ন কমিটির মিটিং চলতে লাগল। রোজই কিছু না কিছু নতুন পরিকল্পনা হয়, সিদ্ধান্তের বদল হয়, বাজেটে কাটছাঁট হয়— দেশ থেকে বহুদূরে, আত্মীয়-স্বজন বর্জিত শত্রুপুরীতে এ এক নতুন জীবন পাওয়া।  

নাটকের জন্য একটি কমিটি তৈরি করা হল। কোচ, ম্যানেজার, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, প্রম্পটার, টেকনিক্যাল ডিরেকটর, মিউজিক মাস্টার— এককথায় যাকে বলে পুরোদস্তুর একটা প্রফেশনাল থিয়েটার কোম্পানি তৈরি হয়ে গেল। রঙ্গমঞ্চের সিনসিনারি আঁকার জন্য বেশ কয়েকটি বিছানার চাদরকে জোড়া লাগিয়ে সেলাই করা হল। রাজবন্দিদের মধ্যে যাঁরা আঁকতে পারতেন তাঁরা রং-তুলি নিয়ে নেমে পড়লেন। বিছানার চাদর জোড়া লাগিয়ে উইংসও তৈরি হল। সেগুলিতেও চিত্রাঙ্কন করা হল। এই কাজগুলি এমনই সুচারুভাবে হল যে নাটক শেষে জেলের অফিসাররা সেই সমস্ত সিন-সিনারি কিনে নিতে চাইলেন। নাটকের জন্য জোরকদমে শুরু হয়ে গেল মহড়া। নাট্য অভিনেতা ছাড়া ‘অভিনেত্রী’রাও (পুরুষ রাজবন্দিদের মধ্যে থেকেই মহিলা চরিত্রাভিনেতা) নাটকের রিহার্সালে মেতে গেলেন।

আরও পড়ুন
বাংলায় বর্গি আক্রমণ ও ভাস্কর পণ্ডিতের দুর্গাপুজো

কিচেন কমিটির কাজই হল সবথেকে কঠিন। প্রতিদিনের পাওনা র্যা শন থেকে প্রত্যেককে একটু-আধটু বঞ্চিত করে তাঁরা পুজোর চারদিনের মোচ্ছবের জন্য রসদ জমা করছেন। পুজোর ওই ক’দিন শুধু তো রাজবন্দিরাই ভালো খাওয়া-দাওয়া করবেন, তা নয়, ওই ক’দিন জেলের প্রত্যেকে, সাধারণ কয়েদিরাও ওই আনন্দের ভাগ পাবে।  

আরও পড়ুন
‘অবাঙালি’ দুর্গার খোঁজে

কীভাবে না জানি, পুজোর প্রস্তুতিতে, নাটকের মহড়ায় কেটে গেল একমাস। জেলের ভেতরেই এক রাজবন্দি বানিয়ে ফেললেন প্রতিমা। এই প্রতিমার মূলাধার ছিল ‘আলোর পথযাত্রী’। তারপর মহাষষ্ঠীর দিনে জেলের থালা-বাটি, ঢোল ও তরুণদলের সহর্ষ ধ্বনির মধ্য দিয়ে হয়ে গেল দেবীর বোধন। এই সময়ে বেশিরভাগ রাজবন্দিই মার্কসবাদে দীক্ষিত হচ্ছেন এবং ধর্মের সারবত্তাকে অস্বীকার করছেন। তাঁরা শুধুমাত্র একটা উৎসব উপলক্ষে সবাই একত্র হবেন, আনন্দ করবেন, নিরানন্দ, নিস্তরঙ্গ জীবনে কিছুদিনের জন্য অন্য স্বাদ সবার সঙ্গে ভাগ করে নেবেন— এই কারণেই দুর্গোৎসবের পরিকল্পনা নিয়েছিলেন বা বলা ভালো শারদোৎসবের প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু সবাই তো তা ছিলেন  না। রাজবন্দিদের মধ্যে যাঁরা তখনও ধর্ম, পুজোপার্বণে বিশ্বাসী ছিলেন তাঁদের মধ্যে তিনজন দায়িত্ব নিলেন পুজো করার।  

আরও পড়ুন
শ্রীরামপুরের ‘ডাচ দুর্গা’ ও গণেশ-যিশুর গল্প

প্রথম দিন সবকিছু সুচারুভাবে সম্পন্ন হলেও, গোল বাঁধল দ্বিতীয় দিনে। মহাসপ্তমীর দিন সকালে পুজো শুরু করার আগে দেখা গেল যে কিছু পুজোসামগ্রী পাওয়া যাচ্ছে না। এই ঘটনা যখন জানাজানি হল, তখন একজন সাত্ত্বিক রাজবন্দি রেগে গিয়ে ঘোষণা করলেন যে যদি ওই পুজোসামগ্রী অবিলম্বে খুঁজে না পাওয়া যায় তাহলে তিনি অনশন ধর্মঘটে বসবেন। চারদিকে খোঁজ রব, সে এক হইহই রইরই কাণ্ড, না পাওয়া যাওয়া যাচ্ছে পুজোসামগ্রী, না পাওয়া যাচ্ছে অপরাধীদের সন্ধান। সেদিন সন্ধ্যায় প্রথম নাটক মঞ্চস্থ হবার কথা, নাট্যাভিনেতারা উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। পুজো যদি এই কারণে ভণ্ডুল হয়ে যায়, তাহলে তাদের এতদিনের পরিশ্রমও গেল। সেদিন সকালে স্টেজ রিহার্সাল তখন স্থগিত রেখে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন পুজোসামগ্রীর সন্ধানে। এদিকে পুজোর সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। একজন মোটামুটি অনশনে বসতে চলেছেন। এই সময়ে প্রায় শেষ মুহূর্তে জেলের এক কোণে খোলা জায়গায় পাওয়া গেল সেইসব খোয়া যাওয়া পুজোসামগ্রী। সবাই আবার আনন্দের সঙ্গে মেতে গেলেন পুজোর প্রস্তুতিতে। 

পরপর তিন সন্ধ্যায় মঞ্চস্থ হল তিনটি নাটক।  প্রথম যে নাটকটি অভিনীত হল তা ছিল জেলের ভেতরে কয়েদিদের জীবনযাত্রা নিয়ে রচিত। দ্বিতীয় নাটকটির বিষয় ছিল অনশন ধর্মঘট। তৃতীয় নাটকটিতে উঠে এসেছিল ভারতীয় শ্রমিকদের জীবন, তাদের ওপর মালিকদের অত্যাচার, পীড়ন, তার বিরুদ্ধে শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ, গ্রেপ্তার ও শ্রমিকদের ওপর পুলিশের গুলিচালনা। এই নাটকটি অন্যান্য সহবন্দিদের কাছে এতটাই গ্রহণযোগ্য এবং প্রশংসিত হল যে সিদ্ধান্ত হয়ে গেল যে পরবর্তী সময়ে আবারও নাটক মঞ্চস্থ করারা সুযোগ পেলে তা হবে স্পেনের শ্রমিক আন্দোলন নিয়ে। বাংলা না জানা জেল কর্তৃপক্ষকে বলা হল যে এসব নিতান্তই সামাজিক নাটক। ইংরেজ অফিসাররা এই বক্তব্য অনুধাবন করেছিলেন কিনা জানা নেই, তবে তারা যে এই তিনদিন নাটকগুলি খুব উপভোগ করেছিলেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

নাটকের পাশাপাশি মঞ্চস্থ হল নৃত্যানুষ্ঠান। নাচে যাঁরা অংশ নিলেন, তাঁদের কারও নৃত্যশিক্ষা নেই, তাঁরা কেউই আগে কখনও নাচেননি। ফলে তা হয়ে দাঁড়াল বিশেষ মজার বিষয়। তবু তাঁদের নৃত্যরত শরীরের ওপর ইলেকট্রিক লাইট অপারেটরের আলোর নাচন নাচের অনুষ্ঠানকে মনোরঞ্জক করে তুলেছিল।

দিনের বেলাতেও নানা ধরনের অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তার মধ্যে ছিল বার্মিজ নাচ ও বাজনা, ড্যাগারের খেলা, বিভিন্ন ধরনের ক্যারিকেচার, নানারকম খেলাধুলার ব্যবস্থা। রান্নাঘরের দায়িত্বে যাঁরা ছিলেন তাঁরা এই ক’দিন ভেল্কি দেখালেন।  কমন কিচেনে এই ক’দিন পোলাও, জিলাপি, সন্দেশ, রসগোল্লা, সিঙ্গাড়া তৈরি করা হল। রাজবন্দি ছাড়াও সাধারণ কয়েদিরাও এই ক’দিন একসাথে খাওয়া-দাওয়া উপভোগ করল।  

দীর্ঘদিনের আন্দোলন, অনশন ধর্মঘট, তিনজনের মৃত্যু— এসব কিছুর ফলশ্রুতি হিসাবে ১৯৩৩ সালে আন্দামানের সেলুলার জেলে যে দুর্গাপুজোর সুযোগ পাওয়া গিয়েছিল তার সদ্ব্যবহার হল কিন্তু প্রতিমা বিসর্জনের শেষে নির্জন সেলগুলি প্রত্যেককে বারেবারে মনে করিয়ে দিতে লাগল, যে এখানে তুমি শুধুমাত্রই একজন বন্দি— দেশ থেকে বহুদুরে, আত্মীয়স্বজনবর্জিত একাকী একটা স্যাঁতস্যাঁতে সেলের বাসিন্দা।

Powered by Froala Editor