উৎসবে শ্রমজীবন

ছায়াছবি-কথা - ১২

আগের পর্বে

শানাল কুমার শশিধরণ। সহজতায় ক্ষমতার জটিল আখ্যানের রূপদান করেন তিনি। ‘অ্যান অফ-ডে গেম’ তাঁর দ্বিতীয় পূর্ণদৈর্ঘ ছবিতে এভাবেই ফুটে উঠেছে বর্ণবৈষম্য। পাঁচ বন্ধুর গল্প। যাঁরা আনন্দ-ফুর্তি করতে গেছেন এক নির্জন অতিথিশালায়। তাঁদের মধ্যেই এক বন্ধু দাসাকে সন্ধের মুখে মরতে হয় বাকিদের হাতে। খেলার ছলেই স্রেফ ‘কালো’ বলে। সমকামী বা প্রতিবন্ধী হলেও হয়তো এই পরিণতিই হত দাসার। তৃতীয় ছবি ‘এস দুর্গা’-তেও একই রকমের একটা আতঙ্ক বুনে দেন শানাল। ‘সেক্সি দুর্গা’ নামের সেন্সর করা এই ছবি আসলে লাভ জিহাদের গল্প। যেখানে দেখানো হয়েছে দক্ষিণেও বিদ্যমান ভাষা-ধর্ম-লিঙ্গভিত্তিক অপরায়নের বাস্তবকে। দুর্গার ধর্ষণ না হলেও চলতে থাকে একটা ভয় দেখানোর খেলা, ধর্ষণ বোধ। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতেই পরিচালক ভূমিকা বদল করেন চরিত্রদের।

দুটো তথ্যচিত্র নিয়ে কথা বলব। দুটো ছবিই প্রায় কাহিনিচিত্র হয়ে পড়ে তাদের আখ্যানশৈলীর গুণে। হাঁড়ির একটা চাল যেমন সমস্ত চালের প্রতিনিধি হতে পারে, ঠিক তেমনই একজন মজুর কী একটা মজুর-পরিবার একটা মজুর-সম্প্রদায় বা মজুর-শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করতে পারে, যদি তারা গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে লেগে থাকে গায়েগায়ে। তখন কারুরই আর আলাদা ক’রে ছবি তুলে তাকে স্বতন্ত্র করে তোলা যায় না। তারপরেও দুজন ব্যক্তির মধ্যে যে স্বাতন্ত্র, তাকে ভুলে না গিয়েও অনায়াসে আলোচনা শুরু করা যায় এই ছবিগুলোর ক্ষেত্রে।

 সেটা ২০০৬ সাল। শীতকাল। দক্ষিণ চিনের গুয়াংজং প্রদেশের গুয়াংজু শহরের কোনও এক বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। বহুঘরবিশিষ্ট বহুতলের খোপ খোপ ঘরে হাজারে হাজারে শ্রমিক কাজ করে চলেছেন। সেলাই-এর কাজ। এঁরা বস্ত্রশ্রমিক। তাঁদের সার সার সেলাইমেশিনের পাশের টেবিলেই রাখা তাঁদের দুগ্ধপোষ্য ঘুমন্ত শিশুরা। কিছু শিশু খেলে বেড়ায় কাপড়ের গাঁটরির স্তুপের অলিগলি দিয়ে। আলোবাতাসহীন এক খোপে আমরা আবিষ্কার করি এক শ্রমিক দম্পতিকে। নববর্ষ আসছে। তাই তাদের বাড়ি ফিরতে হবে। বাড়ি সিচুয়ান প্রদেশের গ্রামে। বছরে এই একবারই বাড়ি যাওয়ার সু্যোগ ঘটে। চিনের প্রায় ১৩ কোটি শ্রমিক চৈনিক নববর্ষের সময়ে শহর থেকে গ্রামে ফেরে। ট্রেনের টিকিট জোগাড় ক’রে ওঠাই মস্ত বিষয় হয়ে দাঁড়ায় সেসময়ে। টিকিট পেলেও মানুষের স্রোত ঠেলে ট্রেন অবধি পৌঁছে ট্রেনে ওঠা, সে এক ভয়ানক অভিজ্ঞতা। সেই মানবস্রোতের একটা ছোট্ট ঢেউ ফানের ছবির এই শ্রমিক পরিবারটি।

 এই মর্মস্তুদ অভিজ্ঞতাই লাস্ট ট্রেন হোম (২০০৯) তথ্যচিত্রের পরতে পরতে সাজিয়ে দিয়েছেন পরিচালক লিক্সিন ফান। এটাই ছিল ফানের তৈরি প্রথম তথ্যচিত্র। বর্তমানে কানাডাবাসী হলেও ফানের জন্ম চিনের হুবেই প্রদেশের উহানে। (তাইই হয়ত) কোটি মানুষের ভিড়ে ঠাসা রেলস্টেশন কী গিজগিজে রেল কামড়ায় ক্যামেরা কাঁধে অবলীলায় সেঁধিয়ে যান, তাঁর চরিত্রদের বাস্তব পরিসরে অনুসরণ করতে। সেই শ্রমিক দম্পতি বহু কাঠখড় পুড়িয়ে ট্রেন, নৌকা, বাসের দীর্ঘ যাত্রা শেষে বাড়ি ফেরেন। গ্রামের বাড়িতে তাদের বৃদ্ধা মা ও দুই সন্তান। ছোটবেলা থেকেই বছরে একবারমাত্র বাবা-মাকে দেখতে পায় তারা। বাবা-মায়ের আদর কী, তারা জানে না। দুজনেই স্কুলে পড়ে। নাতি-নাতনীকে নিয়ে বৃদ্ধা কিছু ধান আর ভুট্টা ফলান সামান্য জমিতে। নাতিটি ছোটো। ইদানিং পরীক্ষার ফল একটু খারাপের দিকে যাচ্ছে তার। নাতনিটির বয়স ১৭। বাবা-মায়ের ওপর তার ভয়ানক অভিমান। সে আর স্কুল যেতে চায়না। চায় স্বাধীন হতে। চায় সেও এই গ্রামের জীবন ছেড়ে শহরে গিয়ে রোজগার করে বাবা-মা’র মতো। একদিন চলেও আসে শহরে। সেও কাজ জুটিয়ে ফেলে এক বস্ত্র কারখানায়। থাকার জায়গা বলতে একটা খাট। নিয়তির মতো পুঁজি-শ্রমের দুনিয়ার শোষণের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করে সেও।

আরও পড়ুন
সেক্সি খেলা

নববর্ষের কটা দিন কাটিয়েই সবাইকে আবার ফিরে যেতে হবে একঘেয়ে শ্রমের স্তূপীকৃত কাপড়ের শহরে, পরের নববর্ষে উপহার নিয়ে আবার ফেরার আশায়। অবসরের অবকাশ মিলবে কোথায়! নববর্ষের হরষ, তাই, তেমন উদযাপনের আনন্দ-রঙে রাঙিয়ে দেখান না পরিচালক। ঘণ্টা দেড়েকের ছবিতে নিজের বিষয়িতাকেও প্রত্যক্ষে আনেন না ফান। 

 এ যেন উৎসবের জন্য এক অনন্ত প্রতীক্ষা। দিনে কমপক্ষে ১২-১৪ ঘণ্টা কাজ থেকে মুখ তোলা যায় না। খাওয়া ঘুম স্নান সবেতেই জড়িয়ে থাকে সমুদ্রপ্রমাণ কাপড়। মুখে জিন্সের মাস্ক সেঁটে, হাজারে হাজারে জিন্সের পোষাক সেলাই করে চলতে হয় রোজ। কেউ শুধু পকেট সেলাই করে চলেছেন, তো কেউ সারাদিন চেন লাগাচ্ছেন। অক্লান্ত, অবকাশহীন। যন্ত্র থামে না, আলো নেভে না এইসব ‘নীল-সোনা’-র কারখানা-ঘরে। একঘেয়ে যান্ত্রিক শব্দ ছাড়া যেন আর কোনো সত্য নেই এ পাড়ায়। সে শব্দ যেন বধির করে দিতে পারে মানুষকে! তাই সেই যান্ত্রিক শব্দ বন্ধ করে একটা সুরযন্ত্রের শব্দ আমাদের শোনান পরিচালক। সেই সুরযন্ত্রের তালেই অবিরাম কাজ করে চলে হাত। সেই হাতের শট দেখাতে দেখাতেই ক্যামেরার কোণও বদলান পরিচালক, একঘেয়েমি কাটাতে। এবং সেটা উত্তম পুরুষ আবহকণ্ঠে জানিয়েও দেন। যন্ত্রের সেই ছন্দবদ্ধ শব্দকেই শ্রমিকেরা বদলে নেন হাসি-কান্না হিরা-পান্নার ছন্দে। ওটুকুই শ্রমের কষ্ট লাঘব করা বিনোদন। আর বছরে একবার উৎসবের সময়ে কিভাবে ফুর্তি করবেন, সেই দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা, খাটতে খাটতেই। আমরা কথা বলছি মার্চেলো গোমেজ-এর তৈরি তথ্যচিত্র ওয়েটিং ফর দ্য কার্নিভাল (২০১৯) নিয়ে।

আরও পড়ুন
নেড়ি কুত্তা


 গোমেজ তার যৌবনে উত্তর-পূর্ব ব্রাজিলের এই তিরোতামায় যখন এসেছিলেন তখন এটা ছিল নিরিবিলি একটা জনপদ। এখন এটা একটা ছোটো শিল্প-পাড়ার মতো। নিরাকার কাপড় শ্রম আর যন্ত্রের দৌলতে বিচিত্র মাপের, আকারের, ফ্যাশনের, রঙের প্যান্ট হয়ে উঠছে রাতারাতি। তারপর সেইসব  ডেনিম প্যান্ট বাইকে-টেম্পোতে বোঝাই হয়ে চলেছে হাজারে-হাজারে। একটা গ্রাম্য বস্তির মতো জায়গার সমস্ত ঘর বা বাড়িতে একটা ক’রে কারখানা। শোবার ঘর আর কারখানার মধ্যে তফাৎ নেই তেমন একটা। শ্রমিকদের সঙ্গে কথাবার্তায় (সাক্ষাৎকারে) উঠে আসে হাসি-মুখে-খেটে-চলা মানুষগুলোর মানসিক যন্ত্রণার অনুভূতির কাহিনি। তাদের কারোর কারোর শব্দচয়ন এমনকি পুঁজিবাদ পর্যন্ত পৌঁছোয়।

আরও পড়ুন
নয়নসুখ

সারা বছরের এই হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর উৎসবের অনাবিল মরশুম আসে। মহল্লা খাঁখাঁ করে সবাই চলে যায় সমুদ্র-স্নানে। তিরোতামা সেই আগের নিরিবিলিতে ফিরে যায়। গোমেজ থেকে যান এই ফাঁকা মহল্লাতেই। লিও নামক এক শ্রমিকের হাতে দিয়ে দেন একটা হাত-ক্যামেরা। সে ছবি তুলে আনবে আনন্দোৎসবের আমোদফেনার। বদলে গোমেজ দেন তার আর তার পরিবারের যাতায়াতের খরচ। (অর্থাৎ) সেই সপ্তাহটুকুর আনন্দও কিন্তু কেনা যায় না এই ঘাড়-গোঁজা অনন্ত পরিশ্রম দিয়ে। তাহলে উপায়? সেই উপায়ও আসে বেচা-কেনার নিয়ম মেনেই। ঘরের টিভি, ফ্রিজ, ইলেক্ট্রনিক, ইলেক্টিক্যল যন্ত্র বিক্রি করে জোগাড় হয় সমুদ্র-সৈকতে গিয়ে গা ভাসাবার সম্বল। তাহলে উৎসব থেকে ফিরে আসার পর কি হবে! এসব যন্ত্রের প্রয়োজন তো আর ফুরিয়ে যাচ্ছে না, এক মাঘে! তাহলে? আবার দিন-রাত এক করে পরিশ্রম করতে হবে এসব ফিরে পাবার জন্য।

আরও পড়ুন
সায়াৎ নোভা অথবা রক্তবীজের রং

 ওদিকে ফানের ছবির মেয়েটি বাবা-মা’র ওপর প্রচণ্ড রাগে গালিগালাজ করে বসে। (এই অংশটা দেখতে গিয়ে বেলজিয়ামের দার্দেন ভাতৃদ্বয়ের রোসেটা (১৯৯৯) ছবির কাজের খোঁজে হন্যে হওয়া কিশোরীর কথা মনে প'ড়ে যায়।) তার ক্রুদ্ধ স্ব/র ক্যামেরার পেছনে থাকা পরিচালকের উপস্থিতিকেও প্রত্যক্ষ করে তোলে। বাবাও মেজাজ হারিয়ে হাত তুলে ফেলে মেয়ের গায়ে। মা আর শহরে ফিরবেন না কথা দিলেও মেয়ে শহরে গিয়ে কাজ নেয় ডিস্কোথেকে মদ পরিবেশনের। শপথবাক্যপাঠে তাকে বলতে হয়-- “ক্রেতাদের কথা সর্বদা সঠিক। মালিক সর্বদা সঠিক”। ওদিকে টেলিভিশনে অলিম্পিকে চিনের পদক জয়ের উদযাপন চলতে থাকে। এই দেশের কৃষক-শ্রমিকই কিন্তু একদিন একদিকে জাপ-সাম্রাজ্যবাদবিরোধী স্বাধীনতার সংগ্রাম আর অন্যদিকে সর্বহারার পক্ষের বিপ্লব করে দেখিয়েছিলেন। হ্যাঁ, তাঁদের কঠোর পরিশ্রমের প্রত্যয় দিয়েই।

আরও পড়ুন
গমক ঘর

 কোনো কোনো তাত্ত্বিক আজকের বেঁচে থাকাকে ‘ক্যাশ রিচ টাইম পুওর’ যাপন হিসেবে পড়েন। অথচ ফানের ছবির চৈনিক পরিবারটিই হোক আর গোমেজের ব্রাজিলীয় জিন্স-পাড়া-- ‘টাইম পুওর’ এঁরা বটে, কিন্তু ‘ক্যাশ রিচ’ হওয়ার উপায় কি আছে এঁদের প্রিক্যারিয়াস জীবনে! যে উৎসবের মরশুমের দিকে সারা বছরের চাতকের মতো প্রতীক্ষা, সেই উৎসবও যেন বিভীষিকাময় হয়ে প্রতি বছর ফিরে ফিরে আসে এইসব শ্রমিক জীবনে; তা তাঁরা টার্বো পুঁজিবাদের মধ্যেই থাক বা ক্রোনি পুঁজিবাদের মধ্যে। শ্রমাবকাশ কি আদৌ সত্য তাদের জীবনে! নাকি এক চাওয়ার নাম!

আরও পড়ুন
স্বপ্নোন্মাদের মৃত্যু

Powered by Froala Editor