কলেজ স্ট্রিটের উপর দিয়ে একটা হাতে টানা রিক্সায় চড়ে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করতেন তিনি। বেকার বিল্ডিং-এর প্রথম প্রবেশপথের সামনে রিক্সা এসে থামতেই পদার্থবিদ্যা বিভাগ থেকে বেরিয়ে আসতেন কেউ কেউ। ম্যাম কি এই বয়সে নিজে হেঁটে ঢুকতে পারবেন? তবে কারোর সাহায্য না নিয়েই নিজের পায়ে হেঁটে ল্যাবরেটরিতে প্রবেশ করতেন নন্দিনী ম্যাম। ভাবতে অবাক হতে হয়, ৮০ বছর বয়সে এসেও কোনোদিন তাঁকে অনুপস্থিত দেখা যেত না। শরীরে বার্ধক্যজনিত নানা রোগ বাসা বেঁধেছিল। বয়সের ভারে শরীর নুয়ে পড়েছিল। কোমড়ে বেল্ট বেঁধেই আসতেন, ল্যাবরেটরিতে স্নাতোকত্তরের ক্লাস নিতেন। দুই শতাব্দীর প্রতিষ্ঠানের মতোই তাঁর জীবনও এক ইতিহাস।
গত ২৮ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার বার্ধক্যজনিত কারণে প্রয়াত হলেন অধ্যাপিকা নন্দিনী রাহা। প্রিয় ‘ম্যাম’-এর মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ বিভাগের সকলেই। সেইসঙ্গে উঠে আসছে পুরনো বেশ কিছু স্মৃতি। ১৯৯৯ সালে বেথুন কলেজের অধ্যাপিকা থাকাকালিন অবসর নেন তিনি। এর পরের বছরেই যোগ দিলেন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি অধ্যাপিকা হয়ে। বিভাগের বর্তমান শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অনেকেই তখন ছাত্রাবস্থায়। বর্তমান অধ্যাপিকা সুচেতনা চ্যাটার্জি বলছিলেন, “আমি তখন স্নাতক স্তরের ছাত্রী। গম্ভীর মেজাজের নন্দিনী ম্যাডামকে দেখে একটু ভয়ই লেগেছিল। পরে আশ্বস্ত হয়েছিলাম এটা শুনে যে উনি স্নাতোকত্তরের ক্লাস নেবেন। অবশ্য ২০১৩ সালে যখন অধ্যাপিকা হয়ে এলাম, তখন নন্দিনীদির সঙ্গে পরিচয় বেশ জমে উঠল। তাঁর কর্তব্যপরায়ণ মানসিকতা সত্যিই অবাক করে।”
১৯৩৯ সালে বর্তমান আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র স্ট্রিটের কাছে একটি ব্রাহ্ম পরিবারে জন্ম নন্দিনী রাহার। ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়ে পড়েছেন ক্লাস ১০ পর্যন্ত। তারপর আইএসসি-তে ভর্তি হলেন বেথুন কলেজে। ১৯৫৬ সালে স্কটিশ চার্চে স্নাতক স্তরের পড়াশোনা শুরু। এরপর স্নাতোকত্তরের জন্য এসেছিলেন তৎকালিন প্রেসিডেন্সি কলেজে। স্নাতোকত্তরের পরেই ১৯৬১ সাল থেকে শুরু কর্মজীবন। প্রথমে সরোজিনী নাইডু কলেজে। তারপর ১৯৬৩ সালে যোগ দিলেন বেথুন কলেজে। ১৯৯৯ সালে অবসর নেওয়ার সময় পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন।
অবসর নেওয়ার পর কিন্তু তাঁর মন ভালো ছিল না। পরীক্ষাগারের যন্ত্রগুলোকে বাদ দিয়ে সারাদিন কাটিয়ে দেওয়া অসহ্য হয়ে উঠতে শুরু করেছিল। ঠিক এই সময়েই ২০০০ সালের পুজোর ছুটির সময় প্রেসিডেন্সি কলেজের তৎকালিন বিভাগীয় প্রধান দীপাঞ্জন রায়চৌধুরী তাঁকে ডেকে নিলেন। অবশ্য স্থায়ীভাবে নয়। পুজোর ছুটির সময়টুকুতে ইন্দিরা গান্ধী ওপেন ইউনিভার্সিটির প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস এবং পরীক্ষার জন্য ডাকা হল তাঁকে। তবে তাঁর একাকিত্বের কথা শুনে দীপাঞ্জন বাবুই পরামর্শ দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে অতিথি অধ্যাপিকা হিসাবে যোগ দেওয়ার জন্য। সেই থেকে টানা ২০ বছর দায়িত্ব পালন করে গিয়েছেন তিনি। এই কাজের জন্য কোনোদিন এক পয়সা পারিশ্রমিক নেননি। অথচ তাঁর কর্তব্যে গাফিলতির কোনো প্রশ্নই ওঠেনি কোনোদিন।
নন্দিনী রাহা বলতেন, তাঁর এই স্বভাবটা পেয়েছিলেন মায়ের কাছ থেকে। মা নলিনী রাহা ছিলেন ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। অবসরের পর তিনিও ঘরে বসে থাকতে পারেননি। ৫ বছর এক্সটেনশনে ছিলেন। তারপর পাড়ার বাচ্চাদের নিয়ে তৈরি করেছিলেন ‘বারান্দা ক্লাব’। সেখানে পড়াশোনা, নাচগান সবই হত। আর বাবা ছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজেরই ইনস্ট্রুমেন্ট কিপার। পরীক্ষাগারের প্রতি ভালোবাসার পিছনে তাঁর অবদান অনেকটাই। ভাবতে অবাক লাগে, ৮০ বছর বয়সের একজন মানুষ ল্যাবরেটরিতে আসা নতুন যন্ত্র সেট করছেন নিজের হাতে। তাঁর ছাত্রাবস্থা থেকে এখনও অবধি প্রযুক্তির যত পরিবর্তন ঘটেছে, তার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন নিজের তাগিদেই। স্বামী-সন্তান ছিল না। বিয়ে করেননি কোনোদিন। ল্যাবরেটরিই ছিল তাঁর সংসার। তিনি বলতেন, রোজ রাতে মনে করেন শরীরের যা অবস্থা পরেরদিন আর ল্যাবে যেতে পারবেন না। কিন্তু সকাল হতেই আবার এসে ঢুকতেন সেই চেনা জায়াগায়। তবে অতিমারী করোনা সেই একমাত্র আশ্রয়টাও কেড়ে নিল শেষ সময়ে। অধ্যাপিকা সুচেতনা চ্যাটার্জী বলছিলেন, “এই অতিমারীই তাঁর শেষ সময়ের জন্য অনেকটা দায়ী। মাঝেমধ্যেই ফোনে কথা হত। ল্যাবে আসতে না পারায় অবসাদ জমছিল একটু একটু করে। তারই ছাপ পড়েছিল শরীরেও। সবচেয়ে খারাপ লাগে, আর কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো আবার বিশ্ববিদ্যালয় খুলবে। কিন্তু নন্দিনীদি তাঁর নিজের জায়গায় থাকবেন না।” বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র প্রত্যুষ বর্মনের কথাতেও একই আক্ষেপের সুর। “নন্দিনী ম্যামের মতো অভিজ্ঞতা তো আর কারোর নেই। পুরনো থেকে নতুন সব যন্ত্রের কাজ, তাদের বিবর্তনের ধারা তিনি হাতে ধরে বুঝিয়ে দিতেন। এভাবে আর কেউই হয়তো বোঝাতে পারবেন না।” দুই শতাব্দীর প্রতিষ্ঠানের ইতিহাসে তিনিও এক কিংবদন্তি। নীরবেই চলে গেলেন অধ্যাপিকা নন্দিনী রাহা।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অধ্যাপক বরুণ রায়চৌধুরী, অধ্যাপিকা সুচেতনা চ্যাটার্জী, অধ্যাপক ঋতবান চ্যাটার্জী, অধ্যাপক দেবপ্রিয় শ্যাম
আরও পড়ুন
অনলাইন ক্লাসের সামর্থ্য নেই, তামিলনাড়ুতে দরিদ্র পড়ুয়াদের পড়াচ্ছেন ইঞ্জিনিয়াররাই
Powered by Froala Editor