মৃত্যুমুখে বাংলাদেশের রাজশাহী সিল্ক, নেপথ্যে জলবায়ু পরিবর্তন

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থিত বাংলাদেশের রাজশাহী জেলা। স্বাধীনতার আগে অখণ্ড বাংলায় এই অঞ্চলটি পরিচিত ছিল ‘রেশমের রাজধানী’ হিসাবে। আনুমানিক ত্রয়োদশ শতক থেকে সিল্ক অর্থাৎ রেশমের চাষ শুরু হয় রাজশাহীতে। অষ্টাদশ-উনিশ শতকে রাজশাহী রেশমের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে গোটা বিশ্বে। তবে এই জনপ্রিয় শিল্পই বর্তমানে মুছে যেতে বসেছে বাংলাদেশের বুক থেকে। নেপথ্যে বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তন।

বাংলাদেশই হোক কিংবা ভারত— ভারতীয় উপমহাদেশে সাধারণত তিন ধরনের রেশমের চাষ হয়। যার মধ্যে রয়েছে তুঁত, ইরি বা ইন্ডি এবং তসর। রাজশাহী সিল্কের নেপথ্যে রয়েছে তুঁত রেশম। বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ভাদ্র, অগ্রহায়ণ, চৈত্র এবং জ্যৈষ্ঠ— মূলত এই চারটি মাসেই চাষ হত তুঁত রেশমের। তার কারণ তুঁত চাষের জন্য পরিবেশের তাপমাত্রা হওয়া উচিত ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সেইসঙ্গে বায়ুর আর্দ্রতারও বড়ো ভূমিকা থাকে তুঁত উৎপাদনের জন্য। 

তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং বৃষ্টিরেখার পরিবর্তনের জন্য বদলেছে বাংলাদেশের আবহাওয়া। একদিকে যেমন চৈত্র-জ্যৈষ্ঠে তাপমাত্রা পেরিয়ে যাচ্ছে ৩৫-৪০ ডিগ্রির গণ্ডি, তেমনই আবার ভাদ্র কিংবা অগ্রহায়ণে তীব্র বৃষ্টিপাতের জন্য মাত্রাতিরিক্ত আর্দ্রতা বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে তুঁত চাষের। সবমিলিয়ে রেশম কীটের কোকুন উৎপাদনের হার এক ধাক্কায় কমে আসছে ৪০-৫০ শতাংশ। 

এখানেই শেষ নয়। তীব্র তাপপ্রবাহ এবং মাত্রাতিরিক্ত আর্দ্রতার ফলে বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবও দেখা দিচ্ছে গোটা রাজশাহী জুড়ে। কোকুন থেকে রেশম কীট জন্ম নিলেও, তারা যে নিরাপদ— তেমনটা নয় একেবারেই। ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া এবং বিভিন্ন রোগের কারণে প্রতিনিয়তই প্রাণ হারায় অজস্র রেশম কীট। ফলে সার্বিকভাবে তলানিতে এসে ঠেকেছে রেশম সুতোর উৎপাদন। রপ্তানি তো দূরের কথা, রাজশাহীতে উৎপাদিত তুঁত রেশম বর্তমানে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতেই অক্ষম। 

অবশ্য এই সমস্যা আজকের নয়। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিক থেকেই পরিবেশগত এই প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছিলেন বাংলাদেশের রেশম চাষিরা। অন্যদিকে চাহিদা মেটাতে সে-সময় চিন থেকে আমদানিকৃত রেশম সুতোর ওপরই নির্ভরতা বাড়াতে বাধ্য হয় রাজশাহীর বিভিন্ন রেশম শাড়ির কারখানাগুলি। তাতে কারখানার লাভের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছিল আরও। কারন, বাংলাদেশে উৎপাদিত সুতোর যেখানে মূল্য ছিল ১১ টাকা প্রতি কেজি, সেখানে চিনা সুতো পাওয়া যেত মাত্র ৯ টাকায়। 

বর্তমানে আকাশ ছুঁয়েছে আমদানিকৃত এই সুতোর দাম। বাংলাদেশের বাজার-জুড়ে চিনা সুতোর একাধিপত্য। প্রায় ৬৫ টাকা প্রতি কেজি দরেই সেই সুতো কিনতে বাধ্য হচ্ছেন রেশম শিল্পীরা এবং কারখানাগুলি। অন্যদিকে প্রায় বন্ধ হতে বসেছে রাজশাহী রেশমের উৎপাদনও। ফলস্বরূপ রাজশাহীতে বর্তমানে মোট রেশম কারখানার সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৪টিতে। যেখানে চলতি শতকের শুরুতেও সংখ্যাটা ছিল একশোর ঘরে। 

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সম্প্রতি একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ প্রশাসন। রেশম উৎপাদনের ক্ষেত্রে কৃষকদের বিশেষ ছাড় দিচ্ছে সরকার। আমদানি বন্ধ করতে ২৫ শতাংশ শুল্ক বসানো হয়েছে চিনা সুতোর ওপরেও। কিন্তু পরিবেশগত প্রতিকূলতাকে আদৌ কি ঠেকানো সম্ভব হবে কোনো পদক্ষেপ নিয়ে? প্রশ্নচিহ্ন ঝুলেই রয়েছে সে-জায়গায়…

তথ্যসূত্র :
১. Management of Climatic Factors for Successful Silkworm (Bombyx mori L.) Crop and Higher Silk Production: A Review, Rahmathulla, V. K., Psyche: A Journal of Entomology
২. Impact of Climate Change on Cotton Production in Bangladesh, Nadiruzzaman, M., Rahman, M., Pal, U., Croxton, S., Rashid, M. B., Bahadur, A. & Huq, Sustainability 

Powered by Froala Editor