সময়টা দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝামাঝি। বছর দশেক হল কলকাতা শহরে আমদানি হয়েছে নতুন এক যন্ত্র। তাতে চলমান ছবি ধরে রাখা যায়। আজকের মতো তো তখন হাতের মুঠোয় ভিডিও রেকর্ডিং-এর ব্যবস্থা ছিল না। ঢাউস সেই যন্ত্র চালানো ছিল রীতিমতো হাঙ্গামা। কীভাবে চলত সেই ক্যামকর্ডার? বৈদ্যুতিক শক্তিতে নয়, তখনকার ক্যামকর্ডার চলত দম দেওয়া শক্তিতে। ইতিহাসে এইসব টুকটাক জানা যায়। কিন্তু চোখের সামনে এসব জিনিস দেখা, আজকে দিনে একরকম কল্পনার অতীত বৈকি! তবে উত্তর কলকাতায় খান্নার কাছে নলিনী সরকার স্ট্রিটের অখ্যাত গলির ভিতরে একবার নকুবাবুর সন্ধানে গেলেই এই সমস্ত ইতিহাস চোখের সামনে দেখতে পাওয়া যেত। বাঙালির অতীতকেই তো পরম মমতায় বাঁচিয়ে রেখেছিলেন তিনি। ৯৫ বছর বয়সে, সেই ভগ্নস্তূপের মাঝেই শেষ নিঃশ্বাস ফেলে বিদায় নিলেন সুশীলকুমার চট্টোপাধ্যায় ওরফে নকুবাবু। শুধু পিছনে ফেলে গেলেন তিল তিল করে জমিয়ে রাখা সংগ্রহ।
১০ বছর বয়সে পাথর কুড়িয়ে জমাতে শুরু করেন নকুবাবু। সেই শুরু। এরপর রাস্তার ধারেই একদিন কুড়িয়ে পেয়েছিলেন একটি পুরনো কাঁটাচামচ। সময়ের মেয়াদ ফুরোলে পুরনোকে তো এভাবেই দূরে ঠেলে দেন সবাই। অযত্ন আর অবহেলার মধ্যে থেকে তাদের কুড়িয়ে নিয়ে আসেন নকুবাবু। আর তারপর সবার জায়গা হয় তিনতলার ১০ ফুট বাই ১২ ফুট ঘরের মধ্যে। কী নেই সেখানে? পুরনো আমলের ক্যামেরা, অ্যামপ্লিফায়ার, প্রোজেক্টার থেকে শুরু করে গ্রামোফোন রেকর্ড, যেখানে যা পেয়েছেন সবই সংগ্রহে রেখে দিয়েছেন। আছে কলকাতা শহরের প্রথম ক্যাকফনিও। আর সবথেকে বড়ো কথা, আজও প্রতিটা যন্ত্রই কাজ করে। স্কটিশচার্চ কলেজের স্নাতক সুশীল চট্টোপাধ্যায় নিজের তাগিদেই শিখেছেন কারিগরিবিদ্যা। টুকটাক মেরামতির কাজ নিজেই সামলে নিতেন। তবে বড়ো কোনো গোলযোগ হলে মেকানিক ডেকে নিতেন বাড়িতেই।
তবে শুধুই যে প্রাচীন যন্ত্রপাতি, তা কিন্তু নয়। আগেই বলা হয়েছে, সংগ্রহের কাজ শুরু হয়েছিল একটি কাঁটাচামচ দিয়ে। সাহেব আমলের শুরুর দিকের বাসনপত্র যেমন আছে, তেমনই সংগ্রহ করেছেন বাবুদের আমলের বাতিদানি। অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে সাহেবরা যে-ধরণের শামুকের খোলার বোতাম ব্যবহার করতেন, তাও আছে তাঁর সংগ্রহে। সব যে খুব নিয়ম মেনে সাজানো আছে, এমনটা নয়। কিন্তু সেই বিশাল রত্নসম্ভারের মধ্যে কোথায় কোন জিনিসটা আছে, সবই নখদর্পণে ছিল নকুবাবুর। ওর মধ্যেই তো বাঁধা পড়ে ছিল তাঁর আত্মা। এমনকি সেই সম্পর্ক এতদূর গভীর ছিল যে, অর্থের বিনিময়েও কারোর কাছে নিজের সংগ্রহ বিক্রি করেননি কখনো। কলকাতার জাদুঘরে কিছু সামগ্রী দান করেছেন। কিন্তু অধিকাংশ জিনিসই সরকারের হাতে তুলে দিতেও অস্বীকার করেছিলেন তিনি। আজ বাস্তবিকই অভিভাবকহীন হয়ে পড়ল সেই ইতিহাস। অবশ্য নকুবাবুর ছেলেরা জানিয়েছেন, বাবার সংগ্রহকে তাঁরা প্রাণ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখবেন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এভাবেই ইতিহাসকে রক্ষা করার শিক্ষা দিয়ে গেলেন নকুবাবু।
তথ্যসূত্রঃ কেমন আছেন নকুবাবু?, বঙ্গদর্শন
Powered by Froala Editor