পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এলাকা কাকদ্বীপ। ভালো-মন্দে কেটে যায় দিন। রাজ্যের অন্যান্য অংশের মতো এখানেও আসে খুশির ঈদ। ঠিক যেমন এসেছে এবারেও। কিন্তু এই বছরটা কেমন যেন ঘোলাটে লাগছে তাঁদের। একে তো হানা দিয়েছে করোনা ভাইরাস। তার থাবা এসে পড়েছে এখানেও। যার জেরে গোটা দেশে এখনও চলছে লকডাউন। একসঙ্গে জমায়েত হওয়া যাবে না। সেইসঙ্গে মাত্র কয়েকদিন আগেই সমস্ত তছনছ করে দিয়ে গেল সুপার সাইক্লোন আমফান। উপকূলবর্তী এলাকা হওয়ার জন্য ক্ষতির পরিমাণও অনেক বেশি। চোখের পলকে উপড়ে গেল গাছপালা, ল্যাম্পপোস্ট। ভেঙে গেল ঘরবাড়ি, দোকান। বিদ্যুৎ পরিষেবাও নেই।
এমন ধ্বংসস্তূপের ভেতরেই কাকদ্বীপে নেমে এল ঈদ। আমফান আর করোনার সাঁড়াশি আক্রমণের আঘাত নিয়ে দিন কাটাচ্ছে দক্ষিণবঙ্গ। কাকদ্বীপে তারই স্পষ্ট আঘাত। কেমন আছেন সেখানকার মানুষরা? কেমন ভাবে বেঁচে থাকার লড়াইটা লড়ছেন। কাকদ্বীপের মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলাম আমরা। জেনে নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম তাঁদের এখনকার পরিস্থিতি ও ঈদের কথা…
কাকদ্বীপেরই এক গৃহবধূ রাবেয়া বেগম। জিজ্ঞেস করছিলাম এই বছরের ঈদ পালনের কথা। তিনি বললেন, “এবারের ঈদ সম্পূর্ণ অন্যরকম। লকডাউনে সমস্যা তো ছিলই, ঝড়ে মানুষের উৎসবের আমেজটাই চলে গেছে৷ চারপাশে ভাঙা ঘর, বিপন্ন মানুষজন, দেখেই মনখারাপ করছে। আমি আবেদন রাখি, সবাই যেন সোশ্যাল ডিসট্যান্স রক্ষা করতে বাড়িতে নামাজ পড়েন।” প্রায় একই কথা বললেন ব্যবসায়ী সেখ ইস্রাফিল। তাঁর মাংসের দোকান। ঈদের আগে বা অন্যান্য উৎসবের আগে বেশ ভিড় থাকে দোকানে। আর এখন? “করোনার জন্য ব্যবসা মার খেয়েছিল, এবার ঝড় এসে সব মাটি করে দিল৷ আত্মীয়দের বাড়িতে যাওয়া-আসার সুযোগ নেই। বোনের বাড়ি ঝড়ে ভেঙে গেছে, সেই চিন্তায় ঈদের খুশিটাই ফিকে হয়ে গেছে। জানি না কবে স্বাভাবিক হবে সব। আমার মাংসের দোকান। ঈদের আগে সবাই মাংস নিয়ে যায়, আনন্দ করে খাওয়াদাওয়া করে। এবার সেসব কিছুই নেই৷”
সেখ আসফাকুল্লাহের বয়স কম, এখনও পড়াশোনা করছে সে। ঈদ মানে তাঁর কাছে আড্ডা, সবাই একসঙ্গে হওয়া। তার থেকেও বড়ো কথা, ঈদের দিন সালমান খানের সিনেমা আসে। আর এবার? “ধর্মীয় রীতিনীতির বাইরে ঈদ মানে আড্ডা, খাওয়াদাওয়া। এবার লাচ্ছা-সিমুই-কাবাব-বিরিয়ানি কিছুই থাকছে না। এমন সাদামাটা ঈদ কোনোদিন দেখিনি। ভাইজানের সিনেমাও থাকছে না। আশেপাশে মানুষের মাথায় ছাদ নেই, পেটে খাবার নেই, ইলেকট্রিসিটি নেই। এবারের ঈদ খুবই সাদামাটা কাটবে।” জানাল আসফাকুল্লাহ…
লকডাউন ও আমফানের এমন পরিস্থিতিতেও প্রার্থনা করতে ভুলছেন না মানুষগুলো। পরিস্থিতি অত্যন্ত খারাপ, সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। তবুও লড়াই চালিয়ে যাবেন তাঁরা। যেমন কাকদ্বীপের শেখ জলিল। পেশা ছিল দিনমজুর। ‘ছিল’, কারণ এই করোনা তাঁর রোজগারে আঘাত এনেছে। লকডাউনের ফলে চলে গেছে কাজ। আর আসবে কিনা, কবে আসবে, কিছুর নিশ্চয়তা নেই। শেখ জলিল বলছেন, “লকডাউনে কাজ ছিল না, ঝড় এসে মাথার ছাদটাও উড়িয়ে নিয়ে গেছে। সাহায্য এলে না খেয়ে মরতে হবে। ঈদ নিয়ে আলাদা কোনো খুশি নেই, শুধু নামাজটা পড়ব। আল্লাহর কাছে দোয়া চাই যেন সব ঠিক হয়ে যায়।” এই দোয়া’ই এখন চলছে সর্বত্র।
<!-- wp:gallery {"ids":[14849],"align":"center"} --><!-- /wp:gallery -->এর বাইরে গিয়ে আরও একটা জিনিসও উঠে এল। চরম বিপদের মুহূর্তে মানুষের হাত এসে ধরে মানুষ— এমন কথা জেনে এসেছি আমরা। দেখেও এসেছি। জাত-ধর্ম ভুলে বেঁচে থাকার লড়াই চলে। ঈদের দিনে মুসলিম প্রতিবেশীরা যাতে ভালো করে কাটায়, সেটাই প্রার্থনা করলেন অন্য ধর্মের মানুষরাও। ঝড় তাঁদেরও মাথার ওপর দিয়ে গেছে, করোনা তাঁদের সংসারেও হয়তো কিছু না কিছু ছাপ ফেলেছে, কিন্তু পাশে দাঁড়াতে ভোলেননি।
কাকদ্বীপের এক দোকানদার স্বপন দাস বলছেন, “ঝড়ে দোকানের টিন উড়ে গিয়েছিল। বাড়িতে তেতুলগাছ পড়েছে। কদিনে কিছুটা সামলে উঠছে৷ ঈদে বন্ধুদের বাড়িতে নেমতন্ন পেতাম, এবার লকডাউনে সেই সুযোগ হাতছাড়া হল। মানুষের হাতে টাকা নেই, মনে শান্তি নেই। মুসলিম বন্ধুদের জন্য বিশেষভাবে খারাপ লাগছে।” একই কথা বলছেন রবিশঙ্কর গায়েন। তিনি আবার পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। ব্যস্ততা বেড়ে গেছে বহুগুণ। সব জায়গায় যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে কাজ করতে হচ্ছে। তিনি বলছেন, “আমায় ঘুরে ঘুরে মোবাইল টাওয়ারগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়। ঝড়ের পর কাজের সুবাদে চারিদিকে ঘোরাঘুরির ফলে মানুষের দুরাবস্থা চাক্ষুষ দেখেছি। মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় ঈদ নিয়ে তেমন হেলদোল নেই। অন্যবার চারদিক সেজে ওঠে।”
ঈদের মরসুমে তাই জীবনের মন্ত্রকেই প্রাণপণে আঁকড়ে থাকার চেষ্টা করছে কাকদ্বীপ। বাড়ি-ঘর চলে গেছে, ভেসে গেছে শেষ সম্বল। রয়েছে করোনার চোখ রাঙানি। তার মধ্যেই মঙ্গলকামনা করছেন তাঁরা। বাড়িতে থেকেই চলছে নামাজ ও অন্যান্য আয়োজন। তারপর আবার নামতে হবে জীবনযুদ্ধে…
কৃতজ্ঞতা – সেখ সাহেবুল হক
Powered by Froala Editor