খরচ জোগাতে অক্লান্ত পরিশ্রম বাবার, মাতৃহারা প্রিয়ম আজ অনূর্ধ্ব-১৯ ভারতীয় দলের অধিনায়ক

এই মুহূর্তে চলছে দক্ষিণ আফ্রিকায় চলছে যুব বিশ্বকাপ বা অনুর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপের আসর। আর এই আসরে ভারতীয় দল পৌঁছে গিয়েছে তাদের অন্তিম সফরে। পাকিস্তানকে রীতিমতো উড়িয়ে দিয়ে ভারত এখন ফাইনালে। আর এই অনূর্ধ্ব-১৯ ভারতীয় দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তরুণ প্রিয়ম গর্গ।

৩০ নভেম্বর ২০০০-এ জন্মানো প্রিয়ম গর্গ উত্তরপ্রদেশের মেরঠ জেলার কিলা পরীক্ষিতগড়ের বাসিন্দা। মাত্র ১১ বছর বয়সেই মা কুসুমদেবীকে হারান প্রিয়ম। মায়ের মৃত্যুর পর পরিবারকে সামালানোর জন্য ক্রিকেট ছাড়তে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বাবার আগ্রহেই ক্রিকেট ছাড়া হয়নি তার। তার বাবা নরেশ গর্গ স্বাস্থ্য আর সামাজিক দেখভাল বিভাগের একজন ড্রাইভার ছিলেন। বেশিদিন সেই চাকরি তিনি করতে পারেননি। শেষে তিনি স্কুল বাস চালানো, দুধ বিক্রি করা, মোট বওয়া আর খবরের কাগজ বিক্রির মতো কাজ করে প্রিয়মের ক্রিকেটের খরচা চালাতে থাকেন।

এর মধ্যেই প্রিয়মকে তাঁর বাবা মেরঠের ভিক্টোরিয়া পার্ক ক্রিকেট গ্রাউন্ডে নিয়ে যান কোচ সঞ্জয় রস্তোগীর কাছে। অনুরোধ করেন প্রিয়মকে ভর্তি নেওয়ার জন্য। প্রিয়মকে ব্যাট করতে বলেন সঞ্জয়। প্রিয়মের ব্যাটিং দেখে এতটাই প্রভাবিত হন তিনি যে, তাঁকে ফ্রিতে কোচিং দিতেও রাজি হয়ে যান। বাড়ি থেকে ৪০ কিলোমিটার দূর নিজের এক ভাই আর বোনের সঙ্গে প্রিয়ম বাসে করে প্রশিক্ষণ নিতে যেতে ভিক্টোরিয়া পার্কে। দ্রুত উত্থান হতে থাকে তাঁর। এ-ব্যাপারে নরেশ গর্গ বলেন,

“প্রিয়ম ৮ বছর বয়স থেকে ক্রিকেট খেলতে শুরু করেছিল। গ্রামের মানুষরা বলত ও ভীষণই ভালো ব্যাটিং করে, এই কারণে ওর মেরঠের ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে যোগ দেওয়া উচিত। সেই সময় আমার পরিবারের আর্থিক পরিস্থিতি ভালো ছিল না। আমি অনেক কষ্টে তখন মেরঠের ভামাশাহ পার্কে কোচ সঞ্জয় রস্তোগীর সঙ্গে দেখা করে প্রিয়মকে অ্যাডমিশন করাই। আজ যদি প্রিয়ম দেশের জন্য বিশ্বকাপ জেতে, তো আমার বুক চওড়া হয়ে যাবে। আমার স্বপ্ন সফল হবে।”

২০১৮-তে, বিজয় হাজারে ট্রফির জন্য তাঁকে উত্তরপ্রদেশ ক্রিকেট দলে রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য নির্বাচিত করা হয়। মাত্র এক মাস পরেই রঞ্জিতে তিনি গোয়ার বিরুদ্ধে প্রথম সেঞ্চুরিও করে ফেলেন। এক বছরের মধ্যে নির্বাচকদের নজরেও পড়েন। ভারতীয় দলের তারকা সুরেশ রায়না তাঁকে প্রশিক্ষণ দেন আলাদাভাবে। ২০১৯-এই তিনি অনূর্ধ্ব-১৯ দলে সুযোগ পান। প্রিয়ম একজন বোলার হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু কোচ তাঁকে ব্যাটিং করার পরামর্শ দেন। যখন তিনি মাত্র সাত-আট বছরের শিশু, সেই সময় তাঁর পরিবারের টিভি কেনারও সামর্থ্য ছিল না। সেই সময় প্রিয়ম নিজের বাড়ির কাছেই একটি পানের দোকানে দাঁড়িয়ে থাকতেন ক্রিকেট ম্যাচ দেখার জন্য। সচিন তেন্ডুলকরকে ভগবান মনে করেন প্রিয়ম। নিজের প্রিয় আইডলের ব্যাপারে প্রিয়ম বলেন,

“আমি আজ যা কিছু, তা সচিন তেন্ডুলকরের কারণেই। আমি যদি ওনাকে খেলতে না দেখতাম, তাহলে আমি এতদূর আসতাম না। ওঁকে দেখেই বড়ো হয়েছি আমি। প্রতিটা ম্যাচের আগে সচিনের ব্যাপারে ভাবি। এতে আমি রান করার সাহস আর শক্তি পাই। আমার স্বপ্ন সচিন তেন্ডুলকরের সঙ্গে দেখা করার, আর তার কাছ থেকে টিপস নেওয়ার। আর, একদিন টিম ইন্ডিয়ার নীল রঙের জার্সি পড়ার।”

এখনও পর্যন্ত এই তরুণ প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে একটি ডবল সেঞ্চুরি এবং একটি সেঞ্চুরি করেছেন। তাঁর ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন সফল করার পেছনে যে মানুষটি, তাঁকেও শ্রদ্ধা জানাতে ভোলেননি প্রিয়ম। বলেন -

“আমার বাবা আমাকে একজন বড়ো ক্রিকেটার হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। এর জন্য তিনি আমাকে মেরঠের ভালো অ্যাকাডেমিতে অ্যাডমিশন করিয়েছেন। পরিবারের আর্থিক স্থিতি ভালো ছিল না। এটা বোঝার জন্য আমি তখন ভীষণই ছোটো ছিলাম। আমাকে ক্রিকেটার করার জন্য বাবা দুধ বেচেছেন, ড্রাইভারিও করেছেন।”

আগামীকাল বিশ্বকাপ ফাইনাল। জিততে মরিয়া প্রিয়মও। তাঁর দিকে তাকিয়ে আপামর ভারতবাসী। এঁরাই ভারতীয় ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ। বিরাট কোহলিও একসময় অনূর্ধ্ব-১৯ দলের অধিনায়ক ছিলেন। প্রিয়মও কি সেই পথেই হাঁটবেন? তা অবশ্য সময় বলবে…

More From Author See More