“পনের দিন আগে যে নিখুঁত পবিত্র, সুন্দর প্রতিমাটিকে এক হাতে আয়ুধ, অন্য হাতে অমৃত দিয়ে বিসর্জ্জন দিয়ে এসেছিলাম, তার কথাই আজ সবচেয়ে বেশী মনে পড়ছে। তার স্মৃতি আজ সবকে ছাপিয়ে উঠেছে।
যাকে নিজ হাতে বীর সাজে সাজিয়ে সমরাঙ্গনে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম, নিশ্চিত মৃত্যুর কোলে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুমতি দিয়ে এসেছিলাম, তার স্মৃতি যে আজ পনের দিনের মধ্যে এক মুহূর্ত ভুলতে পারলাম না। সাজিয়ে দিয়ে যখন করুণভাবে বললাম, ‘তোকে এই শেষ সাজিয়ে দিলাম। তোর দাদা তো তোকে আর জীবনে কোনোদিন সাজাবে না’, তখন প্রতিমা একটু হেসেছিল। কি করুণ সে হাসিটুকু! কত আনন্দের, কত বিষাদের, কত অভিমানের কথাই তার মধ্যে ছিল।”
১৯৩২-এর ২৩ সেপ্টেম্বরের পর পনেরো দিন কেটে গিয়েছে। সূর্যকুমার সেন লিখছেন তাঁর বিষণ্ণ-আখ্যান। নাম দিয়েছেন ‘বিজয়া’। বিংশ শতকের সশস্ত্র সংগ্রামের মহাযজ্ঞে ভারতবর্ষ ততদিনে পেয়ে গিয়েছে তার প্রথম শহীদ-কন্যাটিকে। ইংরেজের গুলি নয়, পটাসিয়াম সায়ানাইডের বিষ স্তব্ধ করে দিয়েছে তাঁর রক্ত-সঞ্চালনকে। দু’সপ্তাহ পর শারদোৎসবের শেষে উপস্থিত হয়েছে বিজয়া। মায়ের বিদায়ের ক্ষণ। প্রীতিলতার আত্মবিসর্জনের কথা ভাবতে ভাবতে মাস্টারদার কি মনে পড়ছিল, বিপ্লবের স্বপ্নে বিভোর হওয়ার খেসারত দিতে গিয়ে আরও এক অপার সম্ভাবনাময় শিক্ষা-সাধক হারিয়ে গেল চিরতরে?
আসলে, মাস্টারদা কোনোদিনই আত্মহত্যাকে সমর্থন করতেন না। লড়ে প্রাণ দেওয়াই বিপ্লবীর অমোঘ নিয়তি, এই ছিল তাঁর বিশ্বাস। কিন্তু প্রয়োজনে ‘মেয়েরাও পারে’-এই মতবাদের মরিয়া প্রতিষ্ঠার জন্যে প্রীতিলতার ছটফটানি দেখে তাঁর কোমল হৃদয় আর ‘না’ বলতে পারেনি, নিজে হাতেই বিষাধারটি তুলে দিয়েছিলেন পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের নেত্রীর হাতে। সেইজন্যেই বুঝি তাঁকে বারবার কুরে কুরে খাচ্ছে এই অব্যক্ত বেদনা। প্রীতিলতার আত্মবলিদানের দুদিন পরে পুলিশের হেফাজতে বন্দি, তাঁর ছোটবেলার বন্ধু কল্পনার কাছে এই খবর পৌঁছয়। মাত্র ন’দিন আগে এই একই জায়গা আক্রমণ করতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যান কল্পনা-সহ কয়েকজন বিপ্লবী। কল্পনা পরে লিখেছিলেন, এই খবর শোনার পর তাঁর বারে বারে মনে হচ্ছিল, তিনি প্রীতির কাছে থাকলে তাকে কিছুতেই অন্তত আত্মহত্যা করতে দিতেন না।
চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী ডঃ খাস্তগীর গভর্নমেন্ট হাই ইংলিশ স্কুল ফর গার্লসের ছাত্রী ছিলেন দুজনেই। কল্পনার চেয়ে এক ক্লাস উঁচুতে পড়তেন প্রীতিলতা। ইতিহাস-শিক্ষিকা উষাদির বড় ভক্ত ছিলেন দুজনেই, এই উষাদির কাছেই স্বদেশ চেতনার প্রাথমিক শিক্ষাটা হয়েছিল তাঁদের। ব্যাডমিন্টনের সঙ্গী থেকে পরবর্তীকালে বিপ্লবের সহযোদ্ধা দুই ছাত্রীই পড়াশোনায় ছিলেন দুর্দান্ত। প্রীতিলতা অবশ্য অঙ্কে দুর্বল ছিলেন বলে ম্যাট্রিকে ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তিটি পাননি, খানিক মনখারাপ নিয়েই ঢাকার ইডেন কলেজে ইন্টারমিডিয়েট আর্টসে ভর্তি হন। ওদিকে কল্পনা ম্যাট্রিকে চতুর্থ হয়ে বিটন কলেজে (যাকে আমরা বেথুন কলেজ নামেই বেশি চিনি) ইন্টারমিডিয়েট সায়েন্স নিয়ে পড়তে চলে আসেন কলকাতায়। মুখোমুখি সাক্ষাৎ বন্ধ হয়ে গেলেও দুই বান্ধবী নিজেদের গড়েপিঠে নিচ্ছিলেন তাঁদের আশৈশব বিপ্লবী স্বপ্নের প্রস্তুতিতে। প্রীতি যোগ দিয়েছিলেন বিপ্লবী তথা সমাজকর্মী লীলা নাগের গণসংগঠন ‘শ্রীসংঘে’র মহিলা শাখা ‘দীপালি সংঘে’, কল্পনা যোগ দিয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র বোসের শিক্ষক হিসেবে খ্যাত বেণীমাধব দাসের বড় মেয়ে কল্যাণী দাসের ‘ছাত্রী সমিতি’তে।
আরও পড়ুন
আর কারও গোলামি নয়; মাস্টারদার সঙ্গী বিপ্লবী সুরেশ দে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘শ্রীলেদার্স’
বিটন কলেজে পড়তে আসার স্বপ্ন প্রীতিলতার অবশেষে পূর্ণ হয়েছিল স্নাতক স্তরে। ম্যাট্রিকের আংশিক ব্যর্থতা পুরোপুরি মিটিয়ে নেন আই. এ.-তে। মেয়েদের মধ্যে প্রথম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে পঞ্চম স্থান অধিকার করেন তিনি। বি. এ. পড়তে কলকাতায় চলে আসেন। সেসময় আবার কল্পনা বি. এসসি. পড়তে চলে যান চট্টগ্রামে। সুখেন্দুবাবুর সংস্কৃত ক্লাস, স্টেলা বসু আর নির্মলকান্তি মজুমদারের ইংরাজির ক্লাস, অকালপ্রয়াতা মিস মেরী বনার্জি, অ্যাংলো ব্যায়াম শিক্ষিকার প্রশিক্ষণ, বিটনের মৃত্যুদিনে তাঁর সমাধিতে মাল্যদান, স্মৃতিসভা, সব মিলিয়ে সাধারণ এক ছাত্রীর মতোই বহতা কেটেছিল প্রথম কয়েকটা মাসের কলকাতার কলেজ-জীবন।
সেই সাবলীল বহমানতায় উত্তেজনা-সঞ্চার হল ১৯৩০ সালের শেষ দিকে। ১ ডিসেম্বর চাঁদপুর স্টেশনে বাঙালি পুলিশ ইন্সপেক্টর তারিণী মুখোপাধ্যায়কে ভুলবশত হত্যা করলেন দুই বিপ্লবী রামকৃষ্ণ বিশ্বাস ও কালীপদ চক্রবর্তী। ব্রিটিশ-বিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের ইতিহাসে প্রকৃত অত্যাচারীর বদলে ভুল মানুষকে মারার ঘটনা-পারম্পর্যে আরও একটি নজির যুক্ত হল। এখানে বিপ্লবীদের মূল লক্ষ্য ছিল কলকাতা থেকে চাঁদপুরগামী ডাউন সুর্মা মেলে সফররত ইন্সপেক্টর জেনারেল ক্রেগ। একদিন পরেই ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তায় গ্রেপ্তার হন দুজনে। পরদিন আনন্দবাজারে প্রকাশিত খবরে তাঁদের ধরা পড়ে যাওয়ার খবর প্রীতিলতাকে বিচলিত করে তোলে ঠিকই, কিন্তু তার চেয়েও বেশি চঞ্চল করে তোলে প্রতিবেদনের একদম শেষ দিকের ছোট্ট তথ্যটি – ‘যুবক দুইটির নাম রামকৃষ্ণ বিশ্বাস ও কালিপদ চক্রবর্ত্তী। তাহারা নাকি চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার মামলার ফেরার আসামী। তাহাদের কুমিল্লায় আনয়ন করা হইয়াছে।’
সেই রামকৃষ্ণদা। জেলের অন্ধকারে মৃত্যুর অপেক্ষা করতে থাকা সাড়োয়াতলির অসামান্য মেধাবী ছাত্রটি। তুতো বোনের ‘অমিতা দাস’ পরিচয়ে নিয়মিত যাতায়াত, মাঝে মাঝে আইরিশ জেলারের মুচকি হাসির ‘ইউ আর লেট’, ফাঁসির আসামী দাদার সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা করতে সহায়তা করা ডি-ভ্যালেরা, ১৯৩১-এর ৪ আগস্ট যিনি ধীরকণ্ঠে প্রীতিলতাকে জানিয়েছিলেন ‘ইয়োর ব্রাদার ইজ নো মোর’, সর্বোপরি দাদার সঙ্গে প্রায় চল্লিশবার কথোপকথনের অমূল্য ভাণ্ডার – প্রীতিলতা যেন তাঁর স্বভাবসিদ্ধ নম্রতার সঙ্গেই বিপ্লবের পথে এগোচ্ছিলেন।
প্রীতিলতার চেয়ে সোয়া এক বছরের বড় ছিলেন রামকৃষ্ণ, কিন্তু কোন এক সহজাত মেধার জোরে এবং উত্তাল সময়ের প্রভাবে মাত্র একুশেই শেষ হয়ে যাওয়া তাজা যুবকটির কথা শুনলে মনে হত, এক বিশাল ক্রান্তিযুগকে নিজের জীবন দিয়ে অনুধাবন করেছেন তিনি। কথায় কথায় প্রীতিলতাকে জিজ্ঞাসা করতেন পড়াশোনার কথা।
আরও পড়ুন
মুখে ‘মহাত্মা গান্ধী কি জয়’ স্লোগান, চট্টগ্রাম স্বাধীন করলেন মাস্টারদার অনুগত বিপ্লবীরা
প্রীতিলতা ততদিনে প্রথাগত শিক্ষার মূল্য নিয়ে সন্দেহপ্রবণ হতে শুরু করেছেন। কিন্তু রামকৃষ্ণ বলতেন, যে মেয়ে আই. এ.-তে ঢাকা বোর্ডে মেয়েদের মধ্যে প্রথম হয়ে বিটনের মতো কলেজে পড়ার সুযোগ পেয়েছে, তার অন্তত পড়াশোনায় ফাঁকি দেওয়া চলবে না। তিনি নিজে তো বটেই, ক্ষুদিরাম-প্রফুল্ল থেকে শুরু করে অনেকেই যে আবেগের বশে ভুল করে ফেলেছিলেন, তেমন ভুল যে বিপ্লবের প্রকৃত লক্ষ্যে পৌঁছনোর পথকে আরও কঠিন করে দেয়, তা স্বীকার করতেন রামকৃষ্ণ। সেজন্যেই প্রীতিলতাকে বোঝাতেন পড়াশোনার গুরুত্ব। পড়াশোনা না করলে মন সুগঠিত হবে না, প্রকৃত বোধের জন্ম হবে না, নিয়ন্ত্রণ আসবে না আবেগেও। আসলে, নিজেদের ভুলের শিক্ষাই ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন ভবিষ্যতের বিপ্লবীর মধ্যে।
দাদার কথা অমান্য করেননি প্রীতিলতা। দর্শনে স্নাতক হন রীতিমতো ডিস্টিংশন পেয়ে। ততদিনে অবশ্য পুরোপুরি বিপ্লবের কাজে নিজেকে নিয়োগ করে দিয়েছেন তিনি। সাক্ষাৎ হয়েছে মাস্টারদার সবচেয়ে কাছের বন্ধু ও সহযোদ্ধা নির্মল সেনের সঙ্গে। তার উপর এসে জুটেছে পরিবারের ভার। নন্দনকানন বালিকা বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকার চাকরিটি নিয়ে তিনি চট্টগ্রামে পাকাপাকিভাবে চলে আসেন। নির্মল সেন প্রথম সাক্ষাতেই জিজ্ঞাসা করেন, অনার্স পরীক্ষা না দেওয়ার কারণ কী। এবারও খানিক অবাক হন প্রীতিলতা। বি. এ. পরীক্ষার রেজাল্টের সঙ্গে বিপ্লবের সম্পর্ক কী জানতে চাইলে নির্মল সেনের স্পষ্ট জবাব – ‘শুধু ভালো হলে হবে না। তোমার কাছে এক্সট্রিম সাক্সেস ডিমান্ড করি। আগামী কনভোকেশনে একটা অ্যাটেম্পট নিতে পারবে তো?’
আরও পড়ুন
দশ হাজার টাকা পুরস্কারের টোপ, মাস্টারদাকে ধরিয়ে দিয়েছিল এক বাঙালিই
নির্মলদার সৌজন্যে অবশেষে ছোটো থেকে শুনে আসা সেই রহস্য-মানুষটির সান্নিধ্যলাভ। রামকৃষ্ণদা, ফুটুদা, নির্মলদা, সকলেই বলেছেন এই মানুষটির তল পাওয়া যায় না। ব্রিটিশ সরকারকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়ে চলেছেন দু’বছর ধরে, সাধারণ লোকে বলবে ‘পলাতক বিপ্লবী’, কিন্তু আসলে মানুষটির মূর্তি ছিল সৌম্যকান্তি ঋষির মতো। ‘তাঁর এক কথায় সব তুচ্ছ করে ঘর ছেড়ে চলে আসতে পারি।’ কী অসম্ভব এক আকর্ষণ ছিল তাঁর উপস্থিতির মধ্যে। সঙ্গে অভিভাবক-সম দায়বদ্ধতা। তাঁকে দেখে বিস্ময়ে প্রায় কথাই বলতে পারেননি প্রীতিলতা। মাস্টারদাই প্রথম কথা বলে সমস্তটা সহজ করে দিয়েছিলেন। রামকৃষ্ণের কথা জানতে চাওয়া, চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহের বাইবেল ছিল যে বই, ড্যান ব্রিনের সেই ‘মাই ফাইট ফর আইরিশ ফ্রিডম’ পড়তে দেওয়া সলজ্জ কন্যাটিকে, আর তারপরে সেই একই প্রশ্ন – ‘পরীক্ষা নাকি ভালো দিয়েছিস?’
প্রীতিলতা ততদিনে হয়তো জেনে গিয়েছিলেন, কল্পনার আই. এসসি. ভালো না হওয়ার খবরে কীরকম গম্ভীর হয়ে গিয়েছিলেন মাস্টারদা। কিন্তু তাঁর এই চরম সিদ্ধান্ত কতখানি আত্ম-জিজ্ঞাসার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেল তাঁর ঋষিপ্রতিম দাদাটিকে, সেকথা তো জেনে যেতে পারলেন না কখনও। নাকি জেনেছিলেন অসীমতার ওপার থেকে? কে জানে!
আরও পড়ুন
মাস্টারদার পরেই তিনি, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলের ‘সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড’ অম্বিকা চক্রবর্তী
Powered by Froala Editor