"শরীর ভরে জন্ম নেয় যদি পাপের আঁধার, সুন্দর তবে লুকিয়ে আছে হাড়ের ভিতরে ভিতরে" - সদ্য মৃত রাষ্ট্রনায়ক জুলিয়াস সিজারের উদ্দেশে মার্ক অ্যান্টনি উচ্চারণ করছেন শোকসভাষণ। আর, ৪৬ জন ছাত্রের সামনে উইলিয়াম শেক্সপিয়রের (Shakespeare) 'জুলিয়াস সিজার' নাটকের তৃতীয় অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্য পাঠ করে শোনাচ্ছেন এক মাস্টারমশাই। ভাবছেন, কোনো ইংরেজি সাহিত্যের ক্লাসঘর? না, ক্লাসঘর, তবে তার চারপাশে ঘেরা আছে গরাদ, উর্দি গায়ে পুলিশ কারণ এটা ইন্দোর জেল, ৪৬ জন ছাত্র জেলে আসামি (Inmate)।
আজ উইলিয়াম শেক্সপিয়রের ৪৫৮তম জন্মদিন। পৃথিবীতে একজন নাট্যকারের রচনার মধ্যে দিয়ে জীবনের সংশোধন করার সম্ভাবনার বীজ খুঁজে পাচ্ছেন মনোবিদরা। ২০১২ সালে পিটার হল্যান্ড, কার্ট টফ্টল্যন্ড এবং স্কট জ্যাকসন একটি সংস্থা নির্মাণ করেন SiPC বা Shakespeare in Prison Network। সংস্থাটি যদিও ইউরোপে, কিন্তু তার লক্ষ্য বিশ্বকবিকে নিয়ে বিশ্বজনীন। সমাজের দোষী মানুষগুলোকে রাষ্ট্রীয় ভাবে বঞ্চনার বিরুদ্ধে শেক্সপিয়র পাঠ, চর্চা ও অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে নিজেকে শোধন ও সমাজে পুনরাগমনের পথ তৈরির স্বপ্ন দেখা। ওয়েস্টভিল, ইন্দিযা়না হয়ে ইন্দোর জেল পর্যন্ত পর্যন্ত প্রবেশ করে গেছেন ম্যাকবেথ, হ্যমলেট, রোমিও, জুলিয়েট কিংবা কিং লিয়র।
কার্ট টফ্টল্যন্ড, যিনি তৈরি করেছেন 'জেলের ওপারে শেক্সপিয়র' নাট্যতত্ত্ব, তাঁর এই চিন্তাভাবনার কথা মাথায় রেখে নত্-র দম বিশ্ববিদ্যালয় একটি আলোচনা সভা আয়োজন করে, বিশ্বের সামনে শেক্সপিয়রের নাটক ও থিয়েটার কীভাবে জনপরিসরে মানবিক স্বয়ংক্রিয় মনোভাব তৈরি করে, তা নিয়ে। SiPC শেখাচ্ছে, কীভাবে প্রান্তিক মানব নিজে দেশের একজন হয়ে উঠতে পারে শিক্ষা, দলগত মনোভাব ও কর্মের মধ্যে দিয়ে। শেক্সপিয়র যেন মানবতার মশাল হয়ে জ্বলে আছেন মাঝখানে।
এবার আমরা একটি ভারতীয় নাট্যদলের কাছে পৌঁছে যাব - 'রাঙ্গায়ানা মাইসোর থিয়েটার', যারা গোটা ভারতবর্ষের বিভিন্ন জেল ভ্রমণ করে প্রযোজনা করে 'কিং লিয়র', 'হ্যামলেট' এবং 'ওথেলো'। তাদের মূল লক্ষ্য শেক্সপিয়রের নাট্য প্রযোজনার মাধ্যমে জেল বন্দিদের নিজেদের দোষত্রুটিগুলি নাটকের ঘটনা, চারিত্রিক স্খলন সর্বোপরি সংলাপের বোধের মধ্যে বোঝানো। জেলবন্দিরাও এই সব নাটকে অভিনয় করে থাকে।
আরও পড়ুন
নিজের এপিটাফে অভিশাপ লিখে রেখেছিলেন শেক্সপিয়র!
শেক্সপিয়রের জন্মভূমি স্ট্রটফোর্ড-আপন-আভনে ২০১৭ সালে 'Shakespeare in South Asis' চিত্রপ্রদর্শনী-তে হ্যমলেট নাটকের বিশ্বজয়ী দৃশ্য ইয়রিকের খুলি হাতে হ্যমলেট অংশটির ছবিতে দুজন সেই বন্দি-অভিনেতাকে দেখা যায় । শেক্সপিয়রের ভাষার পিছনে যে মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, তাকে দেখতেও আমার-আপনার মতোই। না হলে তার নৈতিক কিংবা অনৈতিক সংলাপ,সংকট কেনই-বা এতটা প্রভাবশালী হবে!
আরও পড়ুন
শেক্সপিয়রের লেখা শেষ নাটকের সংস্করণ ‘আবিষ্কার’ স্পেনের গ্রন্থাগারে
কন্নড় কবি ও নাট্যকার শিবপ্রকাশ 'ম্যাকবেথ 'অবলম্বনে লিখছেন 'মারনায়ক'। একটি গরাদের পিছনে বসে একজন বৃদ্ধ গল্প বলতে থাকে মারনায়ক ও চান্দ্রনায়ক( ব্যংকো)এর। গল্প শুনতে শুনতে হঠাৎ জ্বলে ওঠে আলো, একটি জেল - জেলবন্দিরা প্রশ্ন করে, মারনায়ক কি মুক্তি পাবে? উত্তর আসে, না। তখন তারা প্রশ্ন করে - 'আমরা কি কোনোদিন মুক্তি পাব?" নাটকের দল 'সংকল্প' বার বার বিভিন্ন জেলে গিয়ে একজন খুনি চোর কিংবা সমাজবিরোধীদের চোখের সামনে সত্যটা তুলে ধরতে 'ম্যাকবেথ' অভিনয় করে। নাট্যনির্দেশক ও অভিনেতা হুলুগাপ্পা কিট্টিমানির অভিনেতারাও সমাজবিরোধী ছিলেন একদিন।
আরও পড়ুন
ভারতেই জন্ম, বিবাহ, এমনকি মৃত্যুও – এভাবেই জড়িয়ে পড়েছিল শেক্সপিয়রের পরিবার
কমিউনিটি থিয়েটার নিয়ে যারা এখন খুব মাতামাতি করে, তিনজন কফি সপে বসে সংলাপ বিনিময় করে কিংবা পার্টির ব্যানারে নাটক করে - তাদের জন্য এই ২৩শে এপ্রিল একাধারে মহাকবির জন্মদিন ও বই দিবসের শুভেচ্ছা ও সাবধানতা দুইই রইল। সংকটজনক পৃথিবীতে শেক্সপিয়রের বইগুলোর প্রয়োজনীয়তা নতুন করে অনুভূত হচ্ছে আবার।
Powered by Froala Editor