কান চলচ্চিত্র উৎসবে (Cannes Film Festival) নির্বাচিত ছবিগুলোকে বেশ কিছু ভাগে বিভক্ত করা হয়ে থাকে। মানুষের চোখে তথা সারা পৃথিবীর চোখে ‘ইন কম্পিটিশন ফিচার ফিল্ম’ বা মূল প্রতিযোগিতায় সুযোগ পাওয়া ছায়াছবি এদের মধ্যে সর্বোত্তম। এই গোত্রের তেইশটি সিনেমার তুল্যমূল্য যাচাই করে শ্রেষ্ঠ কয়েকটিকে পুরস্কৃত করবেন বলেই দুনিয়ার তাবড় তারকারা এখানে জুরি হিসাবে ভিড় করেন। এই ছবিগুলোর প্রথম স্ক্রিনিং হয় ‘প্যালেস দে লা ফেস্টিভাল’-এর বিশ্বখ্যাত লুমিয়ের প্রেক্ষাগৃহে, এবং সেই স্ক্রিনিং-এ জুরি এবং পরিচালক সহ ছবির টিম উভয়ই উপস্থিত থাকেন। এ ছাড়াও আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ রয়েছে, তবে সেগুলো নিয়ে অন্য পরিসরে আলোচনা হবে।
৭৫তম বছরে এবারের ফিচার প্রতিযোগিতায় বিখ্যাত মার্কিন চলচ্চিত্রকার জেমস গ্রে-এর ছবি ‘আরমাগেডন টাইম’ (Armageddon Time) অন্যতম আকর্ষণ। এটি মূলত একটি পিরিয়ড পিস। ছবির প্রেক্ষাপট বর্ণবৈষম্য জর্জরিত ১৯৮০ সালের নিউ ইয়র্ক শহর। এমনই এক সময়কালে, আমরা একটি পরিবারের চৌহদ্দিতে প্রবেশ করি। ছবির মূল অভিনেতা দুজন স্কুলপড়ুয়া। মাইকেল ব্যানক্স রেপেটা (পল গ্রাফ) এবং জেলিন ওয়েব (জনি)। গ্রাফ পরিবারের অভিভাবক পলের দাদু অ্যারন (এ্যান্থনি হপকিন্স)। অ্যারন সবার চোখের আড়ালে নাতির চিত্রশিল্পী হওয়ার স্বপ্নকে প্রশ্রয় দিয়ে জানান, ‘ওয়েল ইউ হ্যাভ টু সাইন ইওর ওয়ার্ক, অল দা ফেমাস ওয়ানজ ডু দ্যাট!’ তাদের পরিবারের ইহুদি পরিচয় লুকিয়ে পদবি পালটে ফেলার গল্প শুনে, বিস্ময়ে দাদুর পাশে মাথা রেখে, স্বপ্ন আগলে ঘুমিয়ে পড়ে পল। এরই মধ্যে, পলের বন্ধুত্ব হয় কৃষ্ণাঙ্গ কিশোর জনির সঙ্গে। নিজেদের সুস্থ-স্বাভাবিক বন্ধুত্বের মধ্যেই পল বুঝতে শুরু করে, কোথাও গিয়ে তারা আলাদা। বন্ধুর সঙ্গে শহুরে রাস্তায় ছুটোছুটির মধ্যেই সমসাময়িক বর্ণবৈষম্য-ভিত্তিক অত্যাচারের সাক্ষী হয় পল। দুজনে মিলে স্কুলের বাথরুমে নেশা করে ধরা পড়ার পর, ‘সাদা’দের স্কুলে বদলি করা হয় তাকে। সেখানেই সে প্রথম শোনে আমেরিকান ড্রিম-এর কথা, নিগার শব্দের অর্থ। এরই মধ্যে ক্যানসার-আক্রান্ত দাদু নাতিকে বোঝান, চুপ করে থাকা নয়, বুদ্ধি দিয়ে সাহস দিয়ে লড়াই করে যাওয়াই জীবনের নাম। সিনেমার শেষের দিকে এসে নিজেরই স্কুলের কম্পিউটার চুরি করে বিক্রি করতে গিয়ে ধরা পড়ে দুই বন্ধু। পল-কে বাঁচাতে একা সমস্ত দোষ স্বীকার করা জনিকে বলতে শুনি, ‘ইট ডাজনট ম্যাটার এনি মোর, আই নো আই হ্যাভ টু ফাইট এ্যালোন’। ছবির শেষ দৃশ্যে স্কুলের পার্টি ছেড়ে বেরিয়ে আসতে আসতে পলের মুখে ফুটে ওঠে এক সদ্য-যুবকে পরিণত হওয়া দৃঢ়চেতার চাহনি। ৮০-র দশকের নিউ ইয়র্কের সান্ধ্য রাস্তায় ধীর পথে হেঁটে লংশটে অদৃশ্য হয় সে, নতুন লড়াই, আরমাগাডনের দিনগুলোর দিকে।
এ-সিনেমায় জেমস গ্রে-র নিজস্ব গল্প বলার পদ্ধতিগত নিদর্শন পরতে পরতে রয়েছে। মাইকেল ও জেলিনের স্বতস্ফূর্ত অভিনয় দর্শকের মন ছুঁয়ে যায়। অ্যান্থনি হপকিন্স যথারীতি নিজের স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে অনবদ্য। সবার মাঝেই আরো বেশি করে মন কাড়ে নিজের ব্যর্থতায়, অপারগতায় বিরক্ত, বিধ্বস্ত অথচ নিপুণভাবে পুরুষতান্ত্রিক আরভিং-এর ভূমিকায় জেরেমির অভিনয়। অন্যদিকে, গল্প বা ন্যারেটিভ তৈরিতে সার্থক হলেও, সিনেমার শব্দব্যবহার কোনো অবস্থাতেই তেমন মানের নয়। এ ধরনের পিরিয়ড পিস সিনেমায় সঠিক শব্দের ব্যবহার কোন পর্যায়ে হতে পারে, ‘গডফাদার’ তার জলজ্যান্ত উদাহরণ। সব মিলিয়ে ‘আরমাগেডন টাইম’ ঐতিহাসিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছবি। তবে এ-বিষয়ে আরো সিনেমা আমরা আগেও পেয়েছি। আর কান চলচ্চিত্র উৎসবের ইন কম্পিটিশান ফিচারে উঠে আসার মতো গুণমান এ-সিনেমার আছে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।
আরও পড়ুন
Cannes-এর দরজা ঠেলে: সত্যজিৎ-জাদুতে আবারও মুগ্ধ আন্তর্জাতিক দর্শক
সিনেমা স্ক্রিনিং-এর শেষে, প্রেস কনফারেন্স। অ্যান্থনি না-থাকলেও, হাজির অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তারকারা। আলোচনার প্রথমেই ওঠে ফ্রাঁসোয়া ত্রুফোর ‘৪০০ ব্লোজ’ ছবিটিকে অনুসরণ করার কথা। জেমস খোলাখুলি জানান, ওই ছবির থেকে মুক্তি পাওয়ার ক্ষমতা কোনো পরিচালকেরই নেই। কাজেই কোথাও অনুসরণ করে থাকলে, তা তিনি না-জেনেবুঝেই করেছেন। এরপর কথায়-কথায় বৈষম্য ইতিহাসের নানান পাতায় ঘোরাঘুরি করে আলোচনার ন্যারেটিভ। সৃষ্টিশীল মানুষ হিসাবে সমাজের সমস্যাগুলোকে তুলে ধরে তাদের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে যাওয়াই কাজ, এমনই মত সিনেমাটির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের। কেউ যদি বলেন, কোনো কিছুর সমাধান করার জন্য শিল্প করছেন, সে-কথায় তাঁদের বিশেষ ভরসা নেই।
আরও পড়ুন
Cannes-এর দরজা ঠেলে: ফরেস্ট ওয়েটেকারের মুখোমুখি
আমার প্রশ্ন ছিল একটু অন্য আঙ্গিকের। দুজন স্কুলপড়ুয়া কিশোর যখন সমাজের অন্ধকার দিকগুলোকে তাদের চরিত্রের মধ্যে দিয়ে সিনেমায় তুলে ধরতে চেষ্টা করছে, তখন তাদের সবুজ মনে সে-সমস্ত সমস্যার প্রভাবকে কীভাবে সিনেমার টিম ট্যাকেল করল? জেমস জানান, ‘আমার কাছে আপনার জন্য কোনো সহজ উত্তর নেই। এটা শিল্পী হওয়ার পদ্ধতিগত সমস্যা। আমাদের দুটোই জিনিস করণীয়, মন দিয়ে পরিশ্রম আর ঝুঁকি নেওয়া। অবশ্যই আপনার প্রশ্নে উঠে আসা ঝুঁকি, অর্থাৎ অন্ধকার দিকটা থাকছেই। কিন্তু শিল্পী হিসাবে সে-ঝুঁকি আমাদের নিতেই হবে।’ আনে হাথাওয়ে কিশোর শিল্পীদের কাছে প্রশ্নটা সহজ করে দেওয়ায়, তাদের উত্তরও যথেষ্ট সাবলীল। দুজনেই তাদের বাবা-মা এবং ছবির টিমকে আকণ্ঠ সম্মান ও ধন্যবাদ জানায়। পাশাপাশি আনে নিজেও বলেন, ‘যেহেতু আমি অনেক কম বয়স থেকেই একজন সিরিয়াস অভিনেতাই হতে চেয়েছিলাম, আমি জানি যে এক নির্দিষ্ট ধরনের শিল্পীরা আছেন, যাঁদের অনেক ছোটো বয়েস থেকেই সেই তাড়নাটা থাকে। আমি এই দুই কিশোরের মধ্যে সেটা লক্ষ করেছিলাম।’
আরও পড়ুন
Cannes-এর দরজা ঠেলে: এক সন্ধের জারি-‘জুরি’ ও ৭৫ ঘা চাবুকের ছায়া
এরপর ইহুদি ইতিহাস, আনের ইহুদি পরিবারে বিয়ে ইত্যাদির মতো বিষয়ের বেশ কিছু কথার পর, আমাদের সমাজের সমস্যাগুলোকে কেন্দ্র করেও সিনেমার বিষয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেন পরিচালক। সবশেষে জেমস জানান, ‘আই ওয়াজ ট্রাইয়িং টু শো দা ডিফারেন্ট লেয়ারজ অফ দ্যাট সিস্টেম।’ কনফারেন্সের শেষ প্রশ্ন আসে চিনের সাংবাদিকের কাছ থেকে, যে, তিনি ছবিটির শেষ দৃশ্যটি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেন না। প্রেক্ষাগৃহে হাসির রোল। পরিচালকের উত্তর, ‘একটা সিনেমার শেষ তো আপনি যা ঠিক করবেন, তা-ই। আমার মতে, একটা সিনেমার শেষ স্পষ্টতা বজায় রেখে অনিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।’
কান চলচ্চিত্র উৎসবের মতো মঞ্চে একটা সিনেমার প্রথম স্ক্রিনিং দেখে, তা সম্পর্কে নিজের মতামত ও প্রশ্নগুলো সাজিয়ে, তারপর প্রেস কনফারেন্সে সে-সিনেমার হয়ে ওঠাকে চাক্ষুষ করা সত্যিই স্মরণীয় অভিজ্ঞতা। সিনেমাটির আবেগের দিক থেকে, পরিচালনার প্রজ্ঞার দিক নিয়ে, টেকনিকাল প্রসঙ্গে প্রশ্ন থাকতেই পারে; কিন্তু একটা গল্পের সিনেমা হয়ে ওঠার পিছনে এতগুলো মানুষের এত পরিশ্রম লুকিয়ে থাকে যে, একরৈখিক বিচার অসম্ভব। জেমস ও তাঁর টিমের সিনেমা ও খোলামেলা কথাবার্তা আমাদের সেটাই শিখিয়ে দিয়ে গেল।
আসলে, আমরা আমাদের টিভির পর্দায় লাল কার্পেটে দাঁড়িয়ে ছবি ও গ্ল্যামারে মোড়া তারকাদের দেখে যে চলচ্চিত্র উৎসবের কথা কল্পনা করি, এই ফেস্টিভালের পরতে পরতে সেই ঝকঝকে অতিমাত্রিকতার ঊর্ধ্বে একরাশ মানবতা বসত করে। সেই মানবতাই কান চলচ্চিত্র উৎসবের গল্প, তার প্রাণ।
Powered by Froala Editor