কলেজ স্ট্রিটে যাঁরা যান, বা যাঁরা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া— তাঁরা সবসময়ই দেখতে পেতেন এই মানুষগুলোকে। শুধু দেখাতেই সীমাবদ্ধ থাকত না, ছুটে চলে যেতেন তাঁদের কাছে। নিজের প্রিয় বাদাম, চা, নিমকি মাখা কিনে নিয়ে গল্প জুড়ে দিতেন। আস্তে আস্তে বন্ধুত্ব গভীর হয়, নিজের আত্মীয়ের মতোই হয়ে যান ওই মানুষগুলো। নামও হয়ে যায় প্রিয়; কেউ ‘চা-কাকু’, কেউ ‘বাদাম-কাকু’, ‘চুরমুর-কাকু’। সব ঠিকঠাকই চলছিল, মাঝখানে পশ্চিমবঙ্গ-সহ গোটা দেশে শুরু হয় লকডাউন। করোনা ভাইরাসের আক্রমণ থেকে বাঁচতে এটাই যে অন্যতম উপায়। কিন্তু এই মানুষগুলো, যাঁদের আয় হয় হকারি করেই, তাঁদের রোজগার যে নষ্ট হয়ে যাবে! কীভাবে চলবে চা-কাকু, বাদাম-কাকুদের?
এই চিন্তা থেকেই প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা একসঙ্গে মিলে একটি বিশেষ উদ্যোগ নিল। লকডাউনের এই সময় প্রেসিডেন্সিও বন্ধ, শুনশান কলেজ স্ট্রিট। এমন বিপর্যয়ের মধ্যে যারা পড়েছেন, তাঁদের পাশে যাতে একটু দাঁড়ানো যায়, সেই জন্যই ফান্ড তৈরি করল তাঁরা। সেখান থেকেই প্রেসিডেন্সির ক্যাম্পাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা এই মানুষগুলোর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পৌঁছে দেওয়া হল কিছু টাকা। যাতে এই লকডাউনের সময় তাঁদের অসুবিধায় না পড়তে হয়। প্রত্যেককে ফোন করে যাবতীয় তথ্য নেওয়া হয়। তারপর যথাসময় সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া হয় টাকা।
এই পুরো উদ্যোগটির অন্যতম কাণ্ডারি যিনি, তিনি প্রেসিডেন্সিরই এক প্রাক্তনী— কৌমি দত্ত। কথাপ্রসঙ্গে প্রহরকে জানাচ্ছিলেন, “এই হকার দাদা-দিদি, কাকুরা আমাদের গোটা প্রেসিডেন্সির জীবনের সঙ্গে জড়িত। আত্মীয়ের মতো হয়ে গেছেন। বাড়ির খবর নিতেন, আমাদের কেউ অসুস্থ হলে ফোন করতেন নিয়মিত। এই দাদা, কাকুদের ছাড়া প্রেসিডেন্সি ভাবা যায় না। সেই দিক থেকে তাঁদের সবার ফোন নম্বরও ছিল; তার মাধ্যমেই যোগাযোগ চলত। তারপর লকডাউন শুরু হলে সেইভাবেই আমরা যোগাযোগ করি। যদি কোনোভাবে ওই দাদাদের পাশে থাকা যায়, সেখান থেকেই এমন উদ্যোগ নেওয়া। প্রথমে আমি নিজেই চেষ্টা করি এই কাজের, পরে আরও অনেকে যুক্ত হন এই কাজে। ফেসবুকের মাধ্যমেও টাকা জোগাড় হয়। এছাড়াও কোয়ারান্টাইন স্টুডেন্ট ইয়ুথ নেটওয়ার্ক নামের একটি গ্রুপের মাধ্যমে আমরা কলেজ স্ট্রিটের আশেপাশের প্রায় ২০০ ঘরছাড়া মানুষের খাবারেরও দায়িত্ব নিয়েছি। এছাড়াও হিন্দু হোস্টেলের কিছু কর্মীদের জন্য সেখানে থাকা পড়ুয়ারাও আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়। ওখানেও এই উদ্যোগ শুরু করা হয়েছে।”
দিলীপ সাহা, আনন্দ শীলদের মুখ আজ ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। এই নামে তাঁরা পরিচিত নন ঠিকই; সেই ‘চুরমুর-কাকু’, ‘চা-কাকু’ ডাকেই বেশি স্বচ্ছন্দ। ওই ছেলেমেয়েগুলো একসঙ্গে থেকে তাঁদের কথা ভাবছে, এইভাবে এগিয়ে আসছে, এই দৃশ্যটাই ভাবতে পারেননি তাঁরা। এখন অপেক্ষা, কবে লকডাউন কাটবে আর প্রেসিডেন্সির চত্বর আবার ফিরে পাবে তার চেনা মানুষগুলোকে। মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এই নিদর্শন আমরাও একটু প্রাণ ভরে দেখি। আমরাও শুরু করি এই চেনা মানুষগুলোর জন্য…