‘অস্ট্রিয়া জীবনানন্দাই’, জীবনানন্দ দাশের নামে নামকরণ হল প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর

‘বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’। এই পংক্তির সঙ্গে অতিপরিচিত সকলেই। যেকোনো মা-ই তার সন্তানকে বুকে আগলে রাখবে— এটাই তো প্রকৃতির নিয়ম। উদাহরণ হিসাবে ক্যাঙ্গারুর কথাই ধরে নেওয়া যেতে পারে। সদ্যজাত সন্তানকে শরীরের থলিতে করেই বয়ে বেড়ায় এই মার্সুপিয়াল প্রজাতির মায়েরা। তবে আজ থেকে প্রায় ৫ কোটি বছর আগের পৃথিবীতে প্রচলিত ছিল এক ভিন্ন নিয়ম। শিশু নয় বরং নিজের শরীরের মধ্যে নারী আশ্রয় দিত তার প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ সঙ্গীকে। সম্প্রতি, অবলুপ্ত হয়ে যাওয়া এমনই এক রহস্যময় প্রাণীর সন্ধান দিলেন দুই বাঙালি গবেষক। যার বিচরণস্থল ছিল প্রাগৈতিহাসিক ভারতবর্ষ।

অস্ট্রিয়া জীবনানন্দাই (Ostrea jibananandai)। এই সেই প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী, সম্প্রতি যার সন্ধান মিলেছে ভারতের পশ্চিম উপকূলের ক্যাম্বে খাঁড়িতে। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন কবি জীবনানন্দ দাশের (Jibanananda Das) নামেই নামকরণ করা হয়েছে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রজাতিটির। 

না, কোনো স্তন্যপায়ী কিংবা মেরুদণ্ডী নয়, বরং এই প্রাণীটি অয়েস্টার গোত্রের। বা সহজ কথায় বলতে গেলে এটি এক ধরনের ঝিনুক। বছর আটেক আগের কথা। ২০১৩ সালে ক্যাম্বে খাঁড়িতে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল এই বিশেষ প্রজাতিটির জীবাশ্ম। তবে তা সম্পূর্ণ অজানা একটি প্রজাতি, সে-ব্যাপারে তখনও নিশ্চিত ছিলেন না গবেষকরা। সম্প্রতি সেই রহস্য উন্মোচন করেন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কল্যাণ হালদার (Kalyan Halder) এবং অনিকেত মিত্র (Aniket Mitra)। শুধুমাত্র চিহ্নিতকরণই নয়, অয়েস্টার গোত্রের এই প্রাণীটির ‘অজানা’ জীবনচক্রেরও হদিশ দেন দুই বাঙালি গবেষক।

গবেষণায় উঠে আসছে, এই বিশেষ প্রজাতির ঝিনুকের ক্ষেত্রে মহিলাদের আয়তন হত ৬০ মিলিমিটার পর্যন্ত। অন্যদিকে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষরা ছিল মূলত বামন। তারা আকারে কয়েক গুণ ছোটো হত মহিলাদের তুলনায়। ফলে সহজেই মহিলা সঙ্গীদের খোলসের তলায় আশ্রয় নিতে পারত তারা।

আরও পড়ুন
টুইটারের পাখি ‘ল্যারি’ প্রজাতির! কে এই ল্যারি?

গবেষকরা জানাচ্ছেন, জীবনধারণের এই অভিনব পদ্ধতি তারা রপ্ত করেছিল বিবর্তনের হাত ধরেই। আর সেই বিবর্তনের কারণ ছিল জলবায়ু পরিবর্তন। হ্যাঁ, পাঁচ কোটি বছর আগে বদলাতে থাকা জলবায়ুর সঙ্গে মানিয়ে নিতে, ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতেই এমন শারীরিক বন্দোবস্ত করেছিল এই প্রাগৈতিহাসিক অয়েস্টার। সাধারণত, বাহ্যিক প্রজনন প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই বংশবিস্তার করে ঝিনুক। পুরুষের দেহ থেকে নির্গত শুক্রাণু জলবাহিত হয়ে পৌঁছায় স্ত্রী-র দেহে। কিন্তু সেইসময় ক্রমাগত পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি বাধা হয়ে দাঁড়ায় এই প্রক্রিয়ার। ফলত, একপ্রকার বাধ্য হয়েই অভিযোজনের এই পথে হেঁটেছিল অস্ট্রিয়া জীবনানন্দাই। শুক্রাণুর সঙ্গে ডিম্বাণুর মিলন নিশ্চিত করতে মহিলাদের শরীরেই স্থায়ীভাবে জায়গা করে নিত প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ অয়েস্টার। বলাই বাহুল্য, নারীর দেহে পুরুষসঙ্গী চিরস্থায়ী হওয়ায় একগামিতার ধারাতেই অভ্যস্ত ছিল এই বিশেষ অয়েস্টার প্রজাতি। যা বিস্ময়করই বটে।

আরও পড়ুন
ভারতের নিজস্ব ‘জুরাসিক পার্ক’, দাপিয়ে বেড়াত ১৩টি প্রজাতির ডাইনোসর!

অনুমানিক ৪ থেকে ৫.৪ কোটি বছর আগে ভারতের সমুদ্র উপকূলবর্তী ম্যানগ্রোভ অঞ্চলে বসবাস করত এই আশ্চর্যকর ঝিনুকেরা। তবে এই প্রথম নয়, এর আগেও আর্জেন্টিনায় একাধিক প্রজাতির একগামী ঝিনুকের সন্ধান পেয়েছিলেন গবেষকরা। তাঁদের জীবনচক্রও যেন হুবহু মিলে যায় অস্ট্রিয়া জীবনানন্দাই-এর সঙ্গেই। তবে ভারতেও যে এই ধরনের প্রাণীর অস্তিত্ব ছিল, তা প্রকাশ্যে এল এই প্রথম। সম্প্রতি ‘অ্যাকটা প্যালিয়েন্টোলজিকা পোলোনিকা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে দুই বাঙালি গবেষকের এই গবেষণাপত্রটি। এমন একটি অজানা ‘জীবনানন্দীয়’ অধ্যায়ের সঙ্গে বাংলা কবিতার যোগসূত্রকে অস্বীকার করা যায় কী করে? “তবু তাঁর প্রাণে/ কোটি বছর পরে কোনো মানে/ বার করেছে মন কি প্রকৃতির?” জীবনানন্দের লেখায় যেন হুবহু মিলে যায় রহস্যময় সেই অতীতের সঙ্গেই। কবিরা বোধহয় এমনই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হন…

আরও পড়ুন
প্রাণীদের তুলনায় দ্বিগুণ সংকটে উদ্ভিদরা, বিলুপ্তির পথে অর্ধেক প্রজাতি

Powered by Froala Editor