১৮৯৩ সাল। আমেরিকার শিকাগো শহর ক্রমশ সেজে উঠছে বিশ্বের মহামঞ্চ হয়ে। সমস্ত জায়গা থেকে হাজির হয়েছেন বিভিন্ন ধর্মের প্রতিনিধিরা। আয়োজিত হবে বিশ্ব ধর্ম মহাসম্মেলন। তারই মাঝখানে নানা দোলাচল নিয়ে হাজির হয়েছেন এক ভারতীয়, বাঙালি যুবা। সাগর পেরিয়ে ক্লান্ত; কী করে যে কাটিয়েছেন আগের দিনগুলো তিনিই জানেন। মাথায় পাগড়ি, গায়ে গেরুয়া বস্ত্র। অনেকে ভেবেছিলেন এ নির্ঘাত ভবঘুরে। কিন্তু নরেন্দ্রনাথ দত্ত বিশ্বাস হারাননি। তখন অবশ্য তিনি স্বামী বিবেকানন্দ। তাঁর উজ্জ্বল দুটি চোখ আরও তেজে ভরপুর হয়ে গেল। শিকাগোর মহাসম্মেলনে গিয়ে যেন অকূল পাথারে পড়লেন। তিনি কী পারবেন নিজের কথা, দেশের মানুষের কথাগুলো বলতে? এমন সময়ই সেখানে দেখা হল আরেক মানুষের সঙ্গে; তিনিও ভারতীয়, সর্বোপরি খাঁটি বাঙালি। দেশ থেকে এত দূরে এসেও যে এমন প্রাপ্তিযোগ হবে ভাবেননি তিনি। তার পরের কাহিনিটুকু সকলের জানা। আমেরিকার ‘ভাই ও বোনেদের’ উদ্দেশ্যে স্বামীজির গলায় ধ্বনিত হয়েছিল মহামিলনের মন্ত্র। পশ্চাদপটে দাঁড়িয়েছিলেন সেই বাঙালি ব্যক্তিটি, যিনি নিজেও বিবেকানন্দের সঙ্গে একই মঞ্চে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তিনি, শ্রী প্রতাপচন্দ্র মজুমদার…
উনবিংশ শতক ও তার পরবর্তী সময়ের বাংলার ইতিহাসের দিকে তাকালে প্রতাপচন্দ্র মজুমদারের নাম প্রায়শই শোনা যাবে। ১৮৪০ সালে হুগলিতে জন্ম তাঁর, এক বৈদ্য পরিবারে। বাবা মারা যান ছোটো বয়সেই। প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ করে কলকাতায় এসে ভর্তিও হয়েছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে (অধুনা বিশ্ববিদ্যালয়); কিন্তু বেশিদিন ভালো লাগল না। ঠিক করলেন নিজে নিজেই পড়াশোনা চালিয়ে যাবেন। কোনো চার দেওয়ালের মধ্যে বেঁধে রাখবেন না নিজেকে। এদিকে সময়টা উনবিংশ শতক। কলকাতা ও বাংলার বুকে প্রভাব বিস্তার করছে ব্রাহ্ম ধর্ম। এককালে রাজা রামমোহন রায়ের হাত ধরে সূচনা হয়েছিল যার, তারই ঢেউ এল মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর আর কেশবচন্দ্র সেনের হাত ধরে। সেই ঢেউয়ে নিজেকে ভাসিয়ে দিলেন প্রতাপচন্দ্র মজুমদারও। দেবেন ঠাকুর আর কেশব সেনকে গুরু হিসেবে মানলেন তিনি। ১৮৫৯ সালে নিজেকে ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত করলেন। শুরু হল নতুন পথ চলা।
প্রকৃতপক্ষে প্রতাপচন্দ্রের ব্রাহ্ম হওয়ার মধ্যে দিয়ে একটা ইতিহাসেরও সূচনা হল। ভালো বক্তা, ইংরেজি ভাষায় অসামান্য দখল— ক্রমে বাংলার উঁচু সমাজের নজরে চলে আসেন প্রতাপচন্দ্র। একটা সময় আদি ব্রাহ্ম সমাজের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্বও নিয়েছিলেন। পরে ‘তত্ত্ববোধিনী’, ‘ইন্ডিয়ান মিরর’, ‘ইন্টারপ্রিটার’-এর মতো পত্রিকা সম্পাদনাও করেছেন। আর ছিল তাঁর অসংখ্য লেখা। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবকে নিয়ে তাঁর লেখা পড়ে আকৃষ্ট হয়েছিলেন স্বয়ং ম্যাক্সমুলার! এমন একজন বিখ্যাত মানুষ বিশ্ব মহাসভায় স্থান পাবেন, তাতে আর আশ্চর্য কি!
উল্টোদিক থেকে ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। যিনি নিজেও একজন অসাধারণ বক্তা, ইংরেজিতে দক্ষ। সেইসঙ্গে আছে এক অদ্ভুত সাহস, তেজ। সেই ‘নরেন’কে অনেক আগে থেকেই চিনতেন প্রতাপচন্দ্র। কিন্তু শিকাগো বিশ্বধর্মসম্মেলনে যে তাঁকে দেখে ফেলবেন, সেই কথা হয়তো ভাবেননি। এদিকে নানা পথ পেরিয়ে সেখানে পৌঁছেছেন প্রতাপচন্দ্র। ভারতের সনাতন ধর্ম, অধ্যাত্মবাদ, সর্বোপরি ব্রাহ্ম ধর্মের কথা পৌঁছে দেওয়ার জন্য ১৮৭৪ সালেই তিনি চলে গিয়েছিলেন ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ও জার্মানিতে। ব্রিমিংটন হলে তাঁর বক্তৃতা শোনার জন্য তিন হাজার মানুষ উপস্থিত ছিল! সেখান থেকে সোজা আমেরিকায়, ১৮৮৩ সালে। তাঁর খ্যাতি এমন জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিল যে, ১৮৯৩ সালের ঐতিহাসিক শিকাগো ধর্ম মহাসভায় প্রতাপচন্দ্র মজুমদারকে অ্যাডভাইজরি কমিটির সদস্য হিসেবেও মনোনীত করা হয়।
এত বড়ো ব্যক্তি, এত বড়ো বক্তা; কিন্তু দিনের শেষে শিকাগোর সেই মহাসভা স্মরণীয় হয়ে থাকল এক বাঙালি যুবকের জন্য, যার নাম স্বামী বিবেকানন্দ। প্রতাপচন্দ্রের বক্তৃতাও সবার মধ্যে জায়গা করে নেয়, আমেরিকার কাগজেও ছাপা হয় ফলাও করে। কিন্তু তিনি তো এতদিন সেখানে থেকে সেটা তৈরি করেছিলেন। আর ‘নরেন’ এসেই কিনা সবার মধ্যে নিজেকে ছড়িয়ে দিল! এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার, প্রতাপচন্দ্রের বক্তৃতার মূল সুর ছিল কেবল ব্রাহ্মধর্ম। যেখানে স্বামীজি সর্বধর্ম সমন্বয়ের কথা বলেছিলেন। কিন্তু কোথাও যেন গৈরিক বসন পরিহিত বিবেকানন্দের এই রূপ বিচলিত করেছিল প্রতাপচন্দ্রকে? তাহলে কেন ধর্মমহাসভার পর আমেরিকায় তো বটেই, বাংলাতেও স্বামী বিবেকানন্দের নামে অপপ্রচার চালাতে লাগলেন?
ধর্মমহাসভার কর্তাব্যক্তিদের কাছেও চলে গিয়েছিলেন প্রতাপচন্দ্র। স্বামী বিবেকানন্দ একজন ‘ভণ্ড’, ভবঘুরে সম্প্রদায়ের লোক— এই কথাটাই প্রচার করতে লাগলেন তিনি। স্বামীজি দুঃখও পেয়েছিলেন। তাঁর একাধিক চিঠিতে সেই প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। ১৮৯৪ সালে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে তিনি লিখছেন, “প্রভুর ইচ্ছায় মজুমদার মহাশয়ের সঙ্গে এখানে দেখা। প্রথমে বড়ই প্রীতি, পরে যখন শিকাগোসুদ্ধ নরনারী আমার উপর ভেঙে পড়তে লাগল তখন মজুমদার ভায়ার মনে আগুন জ্বলল।… পার্লামেন্ট অব রিলিজিয়নের পাদ্রীদের কাছে আমার যথেষ্ট নিন্দা করে, ‘ও কেউ নয়, ঠগ, জোচ্চোর; ও তোমাদের দেশে এসে বলে – আমি ফকীর’ ইত্যাদি বলে তাদের মন আমার উপর যথেষ্ট বিগড়ে দিলে!...” এখানেই শেষ নয়। নিজের ‘ইউনিটি অ্যান্ড দি মিনিস্টার’ পত্রিকায় স্বামীজি সম্পর্কে বিষোদগার করে চলেন তিনি। তাঁর ‘কালাপানি পার হওয়া’, ‘সিগারেট খাওয়া’ ইত্যাদি নানা কথা বললেন। উপরন্তু কলকাতায় ফেরার পর প্রতাপচন্দ্র রটালেন স্বামীজি আমেরিকায় গিয়ে ‘সমস্ত পাপ কাজ করেছেন’।
আরও পড়ুন
পিতৃহারা বিবেকানন্দের বাড়িতে গোপনে অর্থসাহায্য, চাকরিতেও সহযোগিতা শ্রীম-র
কলকাতায় প্রতাপচন্দ্র মজুমদার একটি বড়ো নাম। এদিকে তখনও ভুবনেশ্বরী দেবী বেঁচে, আর বিবেকানন্দ আমেরিকায়। স্বামীজি আশঙ্কা করছেন, এমন রটনা যেন তাঁর মায়ের কানে না যায়। এইসময় তিনি লিখছেন, “আমার বুড়ি মা এখনো বেঁচে আছেন, সারা জীবন তিনি অসীম কষ্ট পেয়েছেন... কিন্তু তাঁর শ্রেষ্ঠ আশার, তাঁর সবচেয়ে ভালবাসার যে ছেলেটিকে তিনি দান করেছেন, সে দূরদেশে গিয়ে— কলকাতায় মজুমদার যেমন রটাচ্ছে তেমনিভাবে— জঘন্য নোংরা জীবনযাপন করছে, এ সংবাদ তাঁকে একেবারে শেষ করে দেবে।”
কেন এমন করেছিলেন প্রতাপচন্দ্র? ধর্ম মহাসভার পর মনে মনে কখনও কি শ্রদ্ধা আসেনি তাঁর ‘নরেনের’ প্রতি? উত্তর জানা যায়নি। পরে এই দুজন মুখোমুখি হয়েছিলেন কিনা সেটাও জানা যায় না। কিন্তু শিকাগো ধর্মমহাসভায় ভারতের, ভারতীয় সংস্কৃতি ও ধর্মের জয়গান এই দুজনই গেয়েছিলেন। প্রতাপচন্দ্রের ভূমিকাকে কখনই খাটো করা যাবে না। অদ্ভুত ব্যাপার, ১৯০২ সালে স্বামী বিবেকানন্দের মৃত্যুর পর, তিন বছরের মধ্যে ১৯০৫ সালে তিনিও বিদায় নেন পৃথিবী থেকে। ব্রাহ্ম ধর্মের অন্যতম প্রধান প্রতিনিধির জায়গাটি খালি হয়ে যায়, বরাবরের মতো…
তথ্যসূত্র-
১। যুগনায়ক বিবেকানন্দ ২য় খণ্ড
২। পরিব্রাজক বিবেকানন্দ, গুঞ্জন ঘোষ, বর্তমান পত্রিকা
আরও পড়ুন
বিকেলেও বেড়িয়ে এলেন সুস্থ শরীরে, রাতে হঠাৎ বন্ধ হৃদযন্ত্র; মৃত্যু আগাম টের পেয়েছিলেন বিবেকানন্দ?
Powered by Froala Editor