যতই বিরোধিতা আসুক, সব সময় দাঁড়াতে হবে সঠিক এবং সত্যের পক্ষেই— বলেছিলেন গান্ধীজি। এমনকি সত্যের পক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে হাজার ঝড়-ঝাপটা এলেও তার সঙ্গে আপস করতে নারাজ ছিলেন তিনি। বলেছিলেন, সঠিক পথে চলার জন্য কখনোই কারোর কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত নয়। মহাত্মা গান্ধীর প্রভাব প্রশান্তভূষণের উপর কতখানি, তা নিয়ে তর্কের অবকাশ থেকে গেলেও, গান্ধীজির মতোই তাঁর সত্যের পক্ষে আপোসহীন মনোভাব চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। সেই প্রশান্তভূষণ, যিনি নিজে একজন বিশিষ্ট আইনজীবী এবং আদালত অবমাননার দায়েই একাধিক মামলা হয়েছে যাঁর বিরুদ্ধে।
তবে, শুধুই কি আইনজীবী? নাকি আরো কিছু পরিচয় আছে প্রশান্তভূষণের? একটু পিছনে ফিরে দেখা যাক।
সম্প্রতি বিচারব্যবস্থার পরিস্থিতি নিয়ে প্রশান্তভূষণের একটি টুইটকে ঘিরে বিতর্কের ঝড় বয়ে যায় সারা দেশে। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এসএ বোবদে এবং চার জন প্রাক্তন প্রধান বিচারপতির উদ্দেশ্যে করা আলাদা আলাদা দুটি বিতর্কিত টুইট করার জেরেই আদালত অবমাননার দায়ে প্রশান্তভূষণকে দোষী সাব্যস্তও করে সুপ্রিম কোর্টের তিন সদস্যের বেঞ্চ। আদালত নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার প্রস্তাব দিলেও, সেই মামলার শুনানিতে প্রশান্তভূষণ জানালেন আইন অনুযায়ী আদালত তাকে যা শাস্তি দেবে, তা তিনি মাথা পেতে নেবেন; কিন্তু ক্ষমা তিনি চাইবেন না।
কয়েক মাস আগেই সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এসএ বোবদের হার্লে ডেভিডসন বাইকে চড়া একটি ছবি ছড়িয়ে পড়ে সোশ্যাল মিডিয়ায়। সেই প্রেক্ষিতেই প্রশান্তভূষণ লিখেছিলেন, দেশের প্রধান বিচারপতি করোনা বিপর্যয়ের সময় মাস্ক ও হেলমেট না পরে বিজেপি নেতার ৫০ লক্ষ টাকার মোটরবাইকে চেপেছেন নাগপুরের রাজভবনে। যখন কিনা সুপ্রিম কোর্ট লকডাউনের জেরে বন্ধ, নাগরিকদের অধিকার স্তব্ধ, তখন প্রধান বিচারপতিকে কাঠগড়ায় তুলতে পিছপা হননি প্রশান্তভূষণ। এছাড়াও গত ২৭শে জুন অন্য একটি টুইটে তিনি লেখেন, ভবিষ্যতে ঐতিহাসিক এবং গবেষকেরা যখন ভারতের গত ছয় বছরে দিকে তাকাবেন, তখন তাঁরা অবশ্যই লক্ষ্য করবেন যে, অত্যন্ত সুকৌশলে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে কীভাবে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করা হয়েছে দেশজুড়ে; এবং, এই ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট এবং আরও নির্দিষ্টভাবে প্রাক্তন কয়েকজন প্রধান বিচারপতির ভূমিকাও নিশ্চই চোখ এড়িয়ে যাবে না তাঁদের।
পিছিয়ে যাওয়া যাক ২০০৯ সালে। বিশিষ্ট ইংরাজি ম্যাগাজিন ‘তেহেলকা’তে একটি সাক্ষাৎকারে প্রশান্তভূষণ বলেছিলেন, দেশের ১৬ জন বিচারপতির মধ্যে অর্ধেকই দুর্নীতিপরায়ণ। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন সময়ে কেন্দ্রের বর্তমান শাসক দলের বিরুদ্ধে নানা ইস্যু নিয়ে সরব হয়েছেন তিনি। এনআরসি অথবা সিএএ ইস্যুতেও কেন্দ্রের বিরুদ্ধে যথেষ্ট সরব হতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। রাফাল চুক্তি নিয়ে বিতর্কের সময়েও ভারতে এত বড় দুর্নীতি আগে কখনো হয়নি বলে মন্তব্য করেছিলেন তিনি। বিভিন্ন যুক্তির নিরিখে অভিযোগ করেছিলেন, দেশের নিরাপত্তাকে বিক্রি করে দিয়েছে বর্তমান সরকার। তবে গুজরাটের কুখ্যাত সোহরাবুদ্দিন হত্যা মামলা, তাতে বিজেপি নেতা অমিত শাহের জড়িয়ে যাওয়া, তা নিয়ে তদন্ত এবং পরবর্তীতে সেই মামলার বিচারপতি লোয়ার মৃত্যুর পর বিজেপি দলের প্রতি রীতিমতো আক্রমণাত্মক ছিলেন প্রশান্তভূষণ। লস্কর জঙ্গি অভিযোগে ২০০৫ সালে গুজরাত পুলিশের হাতে নিহত হন সোহরাবুদ্দিন। বিরোধীদের দাবি ছিল, মিথ্যে অভিযোগে ভুয়ো সংঘর্ষে বলির পাঁঠা করা হয়েছে সোহরাবুদ্দিনকে। সংঘর্ষের ঘটনায় নাম জড়িয়ে যায় গুজরাতের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের। ২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে এই অভিযোগের তদন্ত শুরু করে সিবিআই এবং তার ছয় মাস পরে গ্রেপ্তার হন শাহ। এরপর ২০১৪ সালে মোদী সরকার কেন্দ্রে আসতেই পাল্টে যায় দাবার চাল। যে বিচারপতির আদালতে মামলা চলছিল সেই, বিচারপতি বি.এইচ. লোয়া আচমকা ২০১৪ সালে নাগপুরে সরকারি গেস্ট হাউসে মারা যান অস্বাভাবিক ভাবে। তাঁর জায়গায় যে বিচারপতি আসেন, তিনি ক্লিনচিট দেন অমিত শাহকে। অত্যন্ত আশ্চর্যজনক ভাবে এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলও করেনি সিবিআই। তখনই বিচারপতি লোয়ার ‘অস্বাভাবিক’ মৃত্যুর নিরপেক্ষ তদন্ত চেয়ে মোট পাঁচটি পিআইএল জমা পড়ে সুপ্রিম কোর্টে। কিন্তু ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ এবং ‘অভিসন্ধিমূলক’ অভিযোগে ২০১৮ সালে এই সব ক’টি পিআইএল খারিজ করে দেয় সুপ্রিম কোর্ট। ২০১৮ সালের ১৯ এপ্রিল দিনটিকে ‘কালা দিন’ হিসেবে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন প্রশান্তভূষণ।
এই সকল অভিযোগের প্রেক্ষিতেই আদালত অবমাননার মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু প্রধান বিচারপতি বোবদেকে নিয়ে করা টুইটের জন্য আংশিক ক্ষমা চেয়ে নিলেও তাঁর আগের বক্তব্য থেকে একদমই সরে আসেননি তিনি। বরং আদালতে হলফনামা দিয়ে বলেছেন, শীর্ষ আদালতের বিচারপতিদের সমালোচনা আদালতের মর্যাদাহানি করে বলে তিনি মনে করেন না; কারণ, আদালতের ভূমিকা নিয়ে মন্তব্য করা একজন সাধারণ নাগরিকের বাকস্বাধীনতার অধিকারের মধ্যে পড়ে। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন, তাঁর মন্তব্য বিচারপতিদের ব্যক্তিগত জীবনের কাজকর্ম নিয়ে। তাই কারোর বিরুদ্ধে সরব হওয়া বা কারোর মতের সঙ্গে মিল না হওয়া আদালত অবমাননা কী করে হতে পারে?
আরও পড়ুন
‘ডাকিনীবিদ্যা জানে ওরা; বাঙালি মেয়েদের থেকে সাবধান!’
আদালত একটি গণতান্ত্রিক স্তম্ভ— শুনানির সময় নিজের যুক্তিতে বলেছেন প্রশান্তভূষণ। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হওয়ার কারণেই আদালতের ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরা মানে সেটা কখনোই আদালত অবমাননা নয়, বরং, আদালতের কাজকে আরও উন্নত করাই তাঁর লক্ষ্য ছিল। তিনি আরো জানিয়েছেন, সমালোচনা গ্রহণ করতে শিখতে হবে আদালতকেও। তাই নির্দিষ্ট কোনও বিচারপতির ভুল কাজের সমালোচনা করা মানে বিচার ব্যবস্থার ভাবমূর্তির গায়ে কালি লাগানো নয়, সেটা বুঝতে পারার মতো দায়িত্ববোধ এবং প্রাপ্তমনস্কতা অবশ্যই আশা করা যায় বৃহত্তম গণতন্ত্রের বিচার ব্যবস্থার থেকে।
খতিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, প্রশান্তভূষণ এবং তাঁকে ঘিরে হয়ে চলা এই কর্মকাণ্ড কিন্তু আসলে একটি ক্ষমতালিপ্সু প্রবণতার দিকেই ইঙ্গিত করে। যেখানে বিচারব্যবস্থাকেও হাতের পুতুল বানিয়ে ফেলা হয় রাজনৈতিক মদতের স্বার্থে। প্রশান্তভূষণের মতো কিছু ব্যক্তি এর বিরুদ্ধে গর্জে উঠলেই, তাঁদের বিরুদ্ধে ভেসে আসে 'রাষ্ট্রবিরোধী' অথবা 'সংবিধান বিরোধী' তকমা। দেশ হিসেবে এইসব ঘটনা যখন ভারতের মাথা নিচু করে দেয় অনেকটাই, তখন খানিকটা হলেও আলোর সন্ধান পাওয়া যায় প্রশান্তভূষণে মতো কিছু মানুষের বক্তব্যেই: আদালতের বিচারে অপরাধ হলেও আমি যা করেছি তার জন্য ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ক্ষমা চাইতেও তাই আমি পারব না। নাগরিকের সর্বোচ্চ কর্তব্য আদালতের বিচারে যদি অপরাধ হয়, তাহলে তার জন্য যা শাস্তি দেওয়া হবে তা হাসি মুখে আমি মেনে নিতে রাজি।
এই শক্ত শিড়দাঁড়াটুকুই এখনকার দিনে সবথেকে বড় সম্বল। বিরলও বটে!
আরও পড়ুন
অন্য অসুখ; লকডাউনের মধ্যেই বাল্যবিবাহের ব্যাপক বৃদ্ধি দেশজুড়ে
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Powered by Froala Editor