ঠাকুরবাড়ি বললেই বাঙালির মাথায় আসবে জোড়াসাঁকোর কথা। মাথায় আসবে দ্বারকানাথ-দেবেন্দ্রনাথ-রবীন্দ্রনাথ-অবনীন্দ্রনাথদের নাম। কিন্তু সেটাই কি একমাত্র পরিচয়? একটা সময় বাংলার বুকে যে পরিবারটি শিক্ষা-সংস্কৃতি-বৈভবে সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল, তাঁদের অস্তিত্ব কি কেবলই জোড়াসাঁকোতে? উত্তর আসবে, না। ইতিহাস এসে বাঙালির ঘাড় ধরে ঘুরিয়ে দেবে পাথুরিয়াঘাটা, জোড়াবাগানের দিকে। উঠে আসবে ঠাকুর পরিবারের আরও এক সমৃদ্ধ ইতিহাস…
একটা সময় এই পাথুরিয়াঘাটা-জোড়াবাগান অঞ্চল থেকেই ইতিহাসের যাত্রাটি শুরু হয়েছিল। পঞ্চানন ঠাকুরের হাতে তৈরি হয়েছিল একটি পরিবার। জোড়াসাঁকো তখনও এই কাহিনিতে প্রবেশ করেনি। উত্তর কলকাতার এই অঞ্চলই প্রথম সাক্ষী থাকল ঠাকুরদের বৈভবের। তবে আজকের গল্প এই সমগ্র ছবিটিকে ঘিরে নয়। এই গল্প ঠাকুর পরিবারের আরেক কৃতি সন্তানকে নিয়ে। তিনি প্রসন্নকুমার ঠাকুর, উনবিংশ শতকে বাঙালি সমাজের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব।
প্রসন্নকুমার যখন জন্মগ্রহণ করলেন, ততদিনে দু’ভাগ হয়ে গেছে ঠাকুর পরিবার। দর্পনারায়ণ আর নীলমণি ঠাকুরের বিবাদ বাঙালি সমাজের মুখরোচক বিষয় হয়ে উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত বিস্তর কোর্ট কাছারির পর নীলমণি ঠাকুর চলে যান জোড়াসাঁকোয়। এবং, জোড়াবাগান-পাথুরিয়াঘাটায় একাই রাজত্ব চালাতে লাগলেন ‘রাজা’ দর্পনারায়ণ ঠাকুর। তাঁর দহরম-মহরম দেখে ব্রিটিশরাও চমকিত। তাঁর পুত্র গোপীমোহনও নেহাত কম বিদ্বান ছিলেন না। হিন্দু কলেজের (অধুনা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) শিক্ষা, দীক্ষা, সংস্কৃতিতে পাথুরিয়াঘাটা ঠাকুর পরিবার সবাইকে ছাড়িয়ে যেতে লাগল। আর এই পরিবারেরই বংশধর হিসেবে ১৮০১ সালে এলেন প্রসন্নকুমার ঠাকুর…
গোপীমোহনের কনিষ্ঠ সন্তান ছিলেন তিনি। ছোটো থেকেই দেখেছেন ইংরেজি শিক্ষার আবহাওয়া। নিজেও বেড়ে উঠেছিলেন সেভাবে। বাড়িতেই আসতেন ব্রিটিশ শিক্ষকরা; ছোট্ট প্রসন্ন তাঁদের কাছে পড়াশোনা করে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। ভালোভাবে দেখলে, এই রীতি পরবর্তীতেও প্রচলিত ছিল ঠাকুর পরিবারে। রবীন্দ্রনাথরাও বাড়িতেই পড়াশোনা শুরু করেছিলেন। তখনকার দিনে এই বনেদি বাড়িগুলিই ছিল শিক্ষার কেন্দ্র। কাজেই সেই পরিবেশ বাড়ির আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিল ব্যাপকভাবে। সেই আঁচ নিয়েই বড়ো হচ্ছিলেন প্রসন্নকুমার।
পরে অবশ্য শেরবার্ন স্কুল এবং হিন্দু কলেজেও পড়াশোনা করেন তিনি। গোপীমোহন বুঝতে পারলেন, তাঁর এই ছেলেটি সাধারণ নয়; অসম্ভব মেধাবী। কেবল ইংরেজি ও বাংলাই নয়, ফার্সি, সংস্কৃত, উর্দুর মতো ভাষায় ছিলেন রীতিমতো দক্ষ। আর ছিল আইনশাস্ত্র। মনপ্রাণ দিয়ে এই বিষয়টি শিখেছিলেন প্রসন্নকুমার। পারিবারিক ব্যবসা নয়, আইনজীবী হিসেবেই যে যাত্রা শুরু হবে তখনই কি বোঝা গিয়েছিল?
তমলুক জেলার দেওয়ান হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন প্রসন্নকুমার ঠাকুর। তখন জোড়াসাঁকো থেকে নিজের জীবন শুরু করেছেন দ্বারকানাথ ঠাকুরও। তাঁর ব্যবসায়ী বুদ্ধি ইংরেজদেরও অবাক করে দিচ্ছিল। একটু একটু করে নিজের কাজ বাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন দ্বারকানাথ। কিন্তু এই কাজে যে বিশ্বস্ত সঙ্গীরও প্রয়োজন! তখনই চোখ পড়ল প্রসন্নকুমারের দিকে। প্রসঙ্গত, বিচ্ছেদের পর পাথুরিয়াঘাটা এবং জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের মধ্যে বিশেষ সদ্ভাব ছিল না। সেখানে দ্বারকানাথের, প্রসন্নকুমারকে সহযোগী করার ভাবনা একটু অন্যরকমই মনে হতে বাধ্য। যাই হোক, এই দুজনের হাত ধরে আবারও একটা সাঁকো তৈরি হল পরিবারে। প্রসন্নকুমার যোগ দিলেন ‘কার, টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি’-তে…
আরও পড়ুন
মিশরের যুদ্ধক্ষেত্রে বাঙালি শ্যামলাল, পিরামিডের দেশ নিয়ে লিখলেন প্রথম বাংলা বইও
ইতিহাসের পাতা ওলটালে দ্বারকানাথ আর প্রসন্নকুমারের কাজের নিদর্শন আরও উঠে আসবে। সেই দিকে একটু পরে যাচ্ছি। এখন কাজ তো করছেন প্রসন্নকুমার; কিন্তু তাঁর আসল উৎসাহ তো আইন জীবিকার দিকে! তা নিয়ে পড়াশোনাও করেছেন যে। শেষ পর্যন্ত চলে গেলেন সদর দেওয়ানি আদালতে। ব্রিটিশ সরকারের দেওয়ানি উকিল হয়ে কাজ শুরু করেন। ধীরে ধীরে আইনজ্ঞ হিসেবে তাঁর পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। তাঁর বুদ্ধি, যুক্তি ও পরিশ্রম মুগ্ধ করে সরকারকেও। এবং জীবনের এই পর্ব থেকে প্রসন্নকুমারের প্রতিপত্তির শুরু…
সেই সময় একজন বাঙালি উকিল হিসেবে তাঁর কৃতিত্ব ছড়িয়ে পড়েছিল সমস্ত জায়গায়। তবে ব্রিটিশদের সঙ্গে বেশি ঘনিষ্ঠতার জন্য সমালোচিতও হয়েছেন তিনি। তবে সেটাই যে এক ও একমাত্র সত্যি, তা নয়। বাংলার সামাজিক উন্নয়ন, শিক্ষা ও সাধারণ মানুষের কথাও যে ভাবতেন সেটাও বোঝা যায় নানা ঘটনায়। প্রসন্নকুমার ঠাকুর যে সময় ওকালতি শুরু করেন, তখন আদালত চত্বরে ফার্সি ভাষাই ব্যবহৃত হত। সেটাই ছিল সরকারি কাজের ভাষা। প্রসন্নকুমার দেখলেন, এর ফলে তো অনেক সমস্যা হচ্ছে। বনেদি সমাজ ও উচ্চবিত্তদের মধ্যে ফার্সি শেখার প্রবণতা থাকলেও, সাধারণ মানুষরা তো এই ভাষা সম্পর্কে অবগত নয়। তাহলে? তাঁদের সুবিধার কথা ভাবা হবে না?
ততদিনে যথেষ্ট নাম করে গেছেন তিনি। প্রসন্নকুমারের মনে হল, ফার্সির সঙ্গে বাংলা ভাষাকেও আদালতের প্রাঙ্গণে আনতে হবে। তাতে বাংলার সমস্ত মানুষেরই উপকার হবে। শুরু হল এক লড়াই, ভাষাকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার লড়াই। আদালতের দরবারে নিজের বক্তব্য তুলে ধরাই শুধু নয়; পত্রিকায় একের পর এক লেখা লিখতে লাগলেন প্রসন্নকুমার ঠাকুর। শেষ পর্যন্ত তাঁরই চেষ্টাকে মান্যতা দল আদালত। ১৮৩৮ সালে প্রথমবার বাংলা ভাষা পা রাখল আদালত চত্বরে। শুধু এখানেই নয়; প্রসন্নকুমার ঠাকুরের হাত ধরে বাংলার প্রথম থিয়েটারও প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৩১ সালে শুরু হয় ‘হিন্দু থিয়েটার’-এর যাত্রা। বাংলার সংস্কৃতির দিকটিও খেয়াল রেখেছিলেন প্রসন্ন। আর তারই অঙ্গ হিসেবে শুরু হয় থিয়েটার। এ এক অন্য ইতিহাস…
আরও পড়ুন
বাংলায় নামকরণ ডাইনোসরের, আবিষ্কারের সঙ্গেও জড়িয়ে দুই বাঙালি
ঠিক তেমনই ইতিহাস জুড়ে আছে রাজা রামমোহন রায়ের সঙ্গে। ব্রিটিশদের সঙ্গে মেলামেশা করলেও, খ্রিস্টান ধর্মের প্রতি একেবারেই আকৃষ্ট হননি প্রসন্নকুমার ঠাকুর। তাই তো যখন জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুর খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হলেন, তিনি মানতে পারেননি। যাই হোক, তখন প্রসন্নকুমার রীতিমতো বিখ্যাত সরকারি উকিল। আকাশছোঁয়া বেতন তাঁর। এইসময়ই তৈরি হল ‘গৌড়ীয় সমাজ’। বাংলার অন্যতম রক্ষণশীল সংগঠন হিসেবে ইতিহাসে এর পরিচিতি। তারই প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক হিসেবে যুক্ত হন প্রসন্নকুমার ঠাকুর।
‘গৌড়ীয় সমাজ’-এর উল্টোদিকে তখন দাঁড়িয়ে আছেন রাজা রামমোহন রায়। সমাজ সংস্কারের কাজ শুরু করেছেন, ব্রাহ্ম ধর্মের ধ্বজা তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। সেইসঙ্গে চেষ্টা করছেন সতীদাহ প্রথা রদের। সঙ্গে সঙ্গে রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ গেল ক্ষেপে। এতদিনের এমন ‘পবিত্র’ প্রথা, একে কি মুছে দেওয়া যায়? গৌড়ীয় সমাজও সতীদাহ রদের বিরুদ্ধে নামল। কিন্তু এত কিছুর মধ্যেও নিজের আদর্শের জায়গায় ঠিক থাকলেন প্রসন্নকুমার ঠাকুর। রক্ষণশীল সমাজের অন্যতম মুখপাত্র তিনি; অথচ সতীদাহ প্রথা বিলোপের জন্য রামমোহন রায়কে যথা সম্ভব সাহায্য করলেন। দ্বারকানাথ ঠাকুর তো সবসময়ই ছিলেন এই আন্দোলনে। পরে প্রসন্ন ঠাকুরও এই আন্দোলনে যুক্ত হন। নিজে সাক্ষী থেকেছিলেন ব্রাহ্ম ধর্মের উত্থানের। এই সবটাই করেছিলেন নিজের যুক্তিতে, বুদ্ধিতে। বিরুদ্ধ মতটি যদি সঠিক হয়, তাহলে সব ভুলে তাকে সমর্থন করতেন প্রসন্নকুমার। কিন্তু ইতিহাস বড়ো ভুলে যায় যে! প্রসন্নকুমার ঠাকুর এবং পাথুরিয়াঘাটা আজ ধুলোয় চাপা পড়ে গেছেন প্রায়। সেই বিলাসবহুল ‘টেগোর ক্যাসল’ও রূপ হারিয়েছে। বাঙালি, তুমি কি এখনও নিজেকে চিনবে না?
তথ্যসূত্র –
১) ‘প্রথম ব্রাহ্মসমাজ মন্দির ও একটি বাড়ি’, দুর্গেশ তেজস্বিনী, বঙ্গদেশ
২) ‘দ্য টেগোর ক্যাসেল এবং ‘অন্য’ ঠাকুরবাড়ির গল্প’, সুরমিতা কাঞ্জিলাল, বঙ্গদর্শন
৩) ‘Streetwise Kolkata: why this Tagore scion got a road named after him in kolkata’, Neha Banka, The Indian Express
আরও পড়ুন
বাঙালির পাশে দাঁড়াতে যে ‘প্রেমপত্র’ চুরি করেছিলেন বেলজিয়ামের তরুণ
Powered by Froala Editor