কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত প্রণব; বাংলার বুকেই তৈরি করেছিলেন নতুন রাজনৈতিক দল

দীর্ঘদিনের যুদ্ধের পর যোদ্ধা ফিরে গেলেন ঘরে। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় এবার শারীরিকভাবেও ‘প্রাক্তন’ হলেন। কিন্তু স্রেফ রাষ্ট্রপতি হিসেবেই কি তাঁর অবস্থান? একজন শিক্ষাবিদ হিসেবে তো বটেই; বাংলা এবং ভারতের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের তকমাও তিনি পাবেন নিঃসন্দেহে। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক কেরিয়ারে নানা বাঁক এসেছে, নানা ঘটনা ঘটেছে। কংগ্রেসের হয়ে রাজনীতি করার দরুন গান্ধী পরিবারেরও ঘনিষ্ঠ ছিলেন। সব দিক দিয়েই তিনি ছিলেন খাঁটি ‘কংগ্রেসি’।

তবে সেই সুতোই আলগা হয়ে গিয়েছিল একদিন। সালটা ১৯৮৪। নিউ দিল্লির ১, সফদরজং রোডের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন থেকে বেরিয়ে আসছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। হঠাৎই তাঁর দুই শিখ দেহরক্ষীর গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় শরীর। ইন্দিরা গান্ধীর এমন মৃত্যুর ঘটনায় হতবাক হয়ে যান সবাই। গোটা দেশ স্তব্ধপ্রায়; কংগ্রেসও। তখন নিহত প্রধানমন্ত্রীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্তজন ছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। ইন্দিরা গান্ধীর পর দেশের প্রধানের চেয়ারে কে বসবে— এটাই ছিল প্রধান আলোচ্য বিষয়। রাজনৈতিক বুদ্ধি, দীক্ষা ও অভিজ্ঞতার নিরিখে দেখলে সেই সময় প্রণববাবুই ছিলেন যোগ্যতম। উনি নিজেও তেমনটাই চাইছিলেন। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক। প্রণব মুখোপাধ্যায়কে নির্বাচিত না করে কংগ্রেসের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য ঠিক করলেন, ইন্দিরার জ্যেষ্ঠ পুত্র রাজীব গান্ধীই হন পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী! 

এমন সিদ্ধান্ত প্রণববাবু প্রথমে মেনে নিতে পারেননি। তখন মনেপ্রাণে নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর আসনে দেখতে চাইছিলেন। আর সেসব নিয়েই রাজীব গান্ধীর সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ। ফলস্বরূপ, চিরকালের ‘কংগ্রেসি’ প্রণব বহিষ্কৃত হলেন দল থেকে। ঠিক করলেন, নিজেই একটি স্বতন্ত্র দল তৈরি করবেন। তাকেই শক্তিশালী করে গড়ে তুলবেন। এমন ভাবনা থেকেই ১৯৮৬ সালে পশ্চিমবঙ্গে তৈরি হল ‘রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস’। সঙ্গে থাকলেন শিশির কুমার বসু, রামারাও গুন্ডু রাও, এফ এম খান, শ্যামসুন্দর মহাপাত্র, মায়াপতি ত্রিপাঠী প্রমুখরা। অদ্ভুতভাবে, গান্ধী পরিবারের পক্ষ থেকে মানেকা গান্ধীও প্রণববাবুর সঙ্গে এই দলে যোগদান করেছিলেন। 

উদ্দেশ্য ছিল কংগ্রেসের, আরও ভালো করে বললে রাজীব গান্ধীর বিপক্ষে লড়াই করা। কিন্তু আশির দশকের কংগ্রেসের মতো শক্তিশালী দলের সঙ্গে লড়তে গেলে সেরকম সংগঠন ও সমর্থনও তো থাকা দরকার। সেটারই অভাব ছিল প্রবলভাবে। কিন্তু প্রণব মুখোপাধ্যায় ছিলেন আশাবাদী। রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেসকে লম্বা রেসের ঘোড়া করতে হবে, এটাই ছিল তাঁর চিন্তাভাবনা। কিন্তু তিনি একা ভাবলেই তো আর হবে না! তাঁর সঙ্গে যারা ছিলেন, বেশিরভাগই সেই দূরের স্বপ্ন দেখতে পাচ্ছিলেন না। সাংসদদের সংখ্যার বিচারে কংগ্রেসের থেকে অনেকটাই পিছিয়ে ছিল এই দল। 

আরও পড়ুন
প্রধানমন্ত্রী হলে, 'শ্রেষ্ঠ' হতেন তিনিই? প্রণব মুখোপাধ্যায় ও পাঁচ দশকের রাজনীতি

তিন বছর পর, রাজীব গান্ধী নিজে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সাক্ষাতে এলেন। পট পরিবর্তন যেন সময়ের অপেক্ষায় ছিল। রাজীব গান্ধীও হয়তো বুঝেছিলেন, ভারতের রাজনীতির ময়দানে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মাহাত্ম্য ও অভিজ্ঞতা ঠিক কতখানি। প্রণববাবুও নিজের দলটির সম্পর্কে সবটুকু বিশ্বাস রাখতে পারছিলেন কি? তা না হলে তিন বছর পরই, ১৯৮৯ সালে কেন রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস মিশে যাবে মূল জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে? দলটার অস্তিত্বই আর থাকবে না! সমস্ত মন কষাকষি ভুলে প্রণববাবুও ফিরে গেলেন পুরনো দলে। তবে আজ সেই সবকিছুর ঊর্ধ্বে তিনি। কোনো দলেই আবদ্ধ রইলেন না; পড়ে থাকল স্রেফ কিছু ছাই… 

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
শেষ হল লড়াই, চলে গেলেন ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়

More From Author See More