‘প্রণব মুখোপাধ্যায়কে যাঁরা সমালোচনা করতে চান, আমাকে তাঁরা সেই সমালোচনার বারুদ বা মশলা হিসেবে ব্যবহার করেন।’ - একদা সাক্ষৎকারে এ-কথা বলেছিলেন ‘পলিয়েস্টার প্রিন্স’ ধীরুভাই আম্বানি। ভারতীয় রাজনীতির অলিন্দে এ বেশ চর্চিত বিষয়ই ছিল। বর্তমানে তার উপর ধুলোর পরত। তবু বিস্মৃতি সরিয়ে আজও আমরা দেখে নিতে পারি, রিলায়েন্সের ধূমকেতুর মতো উত্থানের সঙ্গে কীভাবে জড়িয়ে গিয়েছিল এই বঙ্গতনয়ের নাম।
‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ আজকের দিনে বেশ জানা-শোনা কথা। মোটা দাগে যা ব্যবসায়ী-সরকারের গাঁটছড়া। এর সঙ্গে ‘সাইবার ক্যাপিটালিজম’ ও ‘কমিউনিকেটিভ ক্যাপিটালিজম’ প্রভৃতির নয়া মাত্রা সংযুক্ত হয়ে পুঁজি যে জটিল ও বিবর্তিত চরিত্র নিয়েছে, তা তো একদিনে সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের নিরিখে, পিছনে তাকালে তার একটা ঐতিহাসিক রূপরেখা নিশ্চিত তৈরি করা যায়। আর, সেখানে খুব স্পষ্ট ও উজ্জ্বল বিন্দু হয়েই থাকে রিলায়েন্স।
প্রণববাবুকে বরাবরই বলা হত, তিনি চাণক্য। কেন? হয়তো উত্তরটা এরকম, যে-দলের সঙ্গে তিনি যুক্ত এবং রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে যে দায়িত্ব তাঁকে দেওয়া হত, তা তিনি এতখানি দক্ষতা ও ভারসাম্য বজায় রেখে পালন করতেন যে, তার জুড়ি মেলা ভার। ফলত, রাষ্ট্র ও ব্যবস্থার বিপদের মুহূর্তে তিনি প্রায় বিপত্তারণ। স্বয়ং ইন্দিরা গান্ধী যে তাঁর জন্য অপত্যস্নেহ তুলে রেখেছিলেন, তা এমনি-এমনি নয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, অতি বিপদের দিনেও ইন্দিরার বিরুদ্ধাচরণ করেননি প্রণববাবু। এতটাই দায়বদ্ধ তিনি। এটাই প্রণবাবুর গুণ। এবং, এটাই তাঁকে এমন কিছু সিদ্ধান্তের পথে চালিত করেছে যা হয়তো খুলে দিয়েছে সমালোচনার উৎসমুখ।
এ-কথা সর্বজনবিদিত যে, ধীরুভাই ছিলেন ইন্দিরার ঘনিষ্ঠবৃত্তে। সেই সূত্রে যে দুই ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব ছিল, তাঁদের মধ্যে একজন অবশ্যই প্রণব মুখোপাধ্যায়। ১৯৭৭-এর পর যখন ইন্দিরা আবার হৃতক্ষমতা পুনরুদ্ধার করছেন, তখন ভোটের জন্য তাঁকে অর্থ দিয়ে যাঁরা সাহায্য করেছিলেন, আম্বানি ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। এ তো আর নতুন কথা কিছু নয় যে, ব্যবসায়ীরা রাজনৈতিক দলকে অর্থসাহায্য করে। আর, উলটে কিছু সুযোগ-সুবিধা পায়। কিন্তু এই আবহটাকেই প্রায় বদলে দিয়েছিলেন ধীরুভাই। অনেকটা বাজার অর্থনীতির ফ্রিডম্যানিয় মডেলে তিনি রাজনৈতিক দলের প্রতি আনুগত্য প্রকাশককে প্রতিযোগিতাময় বাজারে পরিণত করে ফেলেছিলেন প্রায়। ব্যবসায়ী ধীরুভাইয়ের সাফ কথা ছিল, তোমাকে তোমারা আইডিয়া বাইরের কারও কাছে বেচতে হবে। সেই ‘বাইরের কেউ’ হল সরকার। ফলত, তিনি খুব খোলা গলাতেই বলতেন, যে কাউকে সেলাম করতে তিনি রাজি। তাঁর অভিধানে যে শব্দটি নেই, তা হল ‘ইগো’। ধীরুভাইয়ের এহেন মতাদর্শ ক্রমশ বদলে দিচ্ছিল অনেক কিছুই। সেই সময় বম্বে ডাইং ও আম্বানির দ্বৈরথ রাজনীতি ও অর্থনীতির যুগলবন্দির চর্চায় একটা মুখ্য জায়গা দখল করে নেয়। একই ময়দানের জন্য (পড়ুন বাজার) দুই সংস্থাই ঝাঁপিয়েছিল। পরে দেখা যায়, বম্বে ডাইং-কে হারিয়ে আম্বানিই আলোকবৃত্তে উঠে আসতে থাকেন। দখল করতে থাকেন রাজপাট।
আরও পড়ুন
মুজিব শতবর্ষে বিতরণ করা হবে মুক্তিযুদ্ধের বই, মৈত্রীর বার্তা ভারতীয় হাইকমিশনের
ঠিক এখানেই উঠে আসে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের নাম। আম্বানিকে যদি প্রশ্ন করা হত যে, লাইসেন্স পেতে কি প্রণব তাঁকে সাহায্য করেছিলেন? আম্বানির সাফ উত্তর হত, প্রণব অর্থমন্ত্রকে ছিলেন। সেখান থেকে লাইসেন্স দেওয়া হয় না। হক কথা। এখানে আবার মুখ্য হয়ে ওঠেন স্বামীনাথন গুরুমূর্তি। সেসময় তিনি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এর হয়ে কলম ধরেছিলেন। মূলত তাঁর অন্তর্তদন্তেই, আম্বানির উত্থানের নেপথ্যে প্রণবের ভুমিকা সামনে আসতে থাকে। জানা যায়, টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিতে ট্যাক্সেশন পদ্ধতি বা কর ব্যবস্থাকে তিনি এমনভাবে রূপায়িত করেন, যাতে সুবিধা হয় আম্বানির। হার স্বীকার করতে বাধ্য হয় প্রতিপক্ষ। অবশ্য আম্বানি এক কথায় এসব নাকচ করেছিলেন।
বম্বে ডাইং-এর হারের অপরাপর বহু কারণ ছিল। আম্বানির ব্যবসায়িক বুদ্ধিকেও কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। তবু কিছু প্রশ্ন থেকেই গিয়েছিল প্রণবের ভূমিকা নিয়ে। কোনও কোনও মহলের জিজ্ঞাসা ছিল, তাঁর এ-কাজ কি ছিল বন্ধুতার খাতিরেই? ইন্দিরার একদা ঘনিষ্ঠ ও ইন্দিরার সাহায্যকারীকে কি কিঞ্চিৎ সুনজরেই দেখতেন চাণক্য! পরবর্তীতেও দেখা গিয়েছে, অনিল ও মুকেশ আম্বানির বিবাদে যখন রিলায়েন্স-সাম্রাজ্য সংকটে, তখন ফয়সালা করে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন প্রণববাবুই।
আরও পড়ুন
ঢাকায় নিহত বঙ্গবন্ধু; পিতৃহারা শেখ হাসিনাকে দিল্লিতে আশ্রয় দিলেন প্রণব-দম্পতি
বলা বাহুল্য, যতটা সহজ করে এই সব কথা বলে ফেলা গেল, ততটাই সহজ জিনিস মোটেও নয়। প্রতিটি ঘটনারই বহু পরত আছে। এ-নিয়ে চর্চাও কম নয়। সে-চর্চার গুরুত্ব এখানেই যে, তা ক্রমাগত আমাদের ব্যবসা-রাজনীতির আঁতাত সম্পর্কে সচেতন করে। কারণ, জনমানসে এই আঁতাত একরম গ্রহণযোগ্যতা পেয়েই গিয়েছে। ফলে, কেউ আর এর বিরুদ্ধে সরব হন না। সেই সুযোগে কোনও কোনও রাজনৈতিক দল তাদের অভিসন্ধি কাজে লাগিয়ে দেশের মৌলিক কাঠামো পর্যন্ত বদলে দিতে পারে। প্রণব মুখোপাধ্যায় ও তাঁর সমকালীন নেতাদের রাজনীতি সে-পথের ছায়া মাড়ায়নি।
প্রণববাবুর প্রয়াণের পর এই প্রসঙ্গের অবতারণা তাঁর প্রতি অভিযোগের আঙুল তুলতে নয়। কারণ, সেই ১৯৮০-র দশকের মাঝ পেরিয়ে বহু জল গড়িয়ে গেছে গঙ্গা-যমুনায়। ক্রোনি ক্যাপিটালিজম এখন স্বমহিমায় তো বটেই, বরং পুঁজি সুচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরনোর নতুন নতুন রূপ পরিগ্রহ করছে প্রতিনিয়ত। প্রণববাবুর দক্ষতা এই যে, রাজনীতির এই চোরাগলি পেরিয়ে তিনি নিজেকে রাজনীতির ঊর্ধে নিয়ে যেতে পারেছিলেন। সর্বজনশ্রদ্ধেয় হতে পেরেছিলেন। সর্বভারতীয় বাঙালি হয়ে এই বাংলাকে উচ্চতম আসনে পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন। আজকের মুহূর্তে আমাদের সে-কথাটা মনে রাখাই কর্তব্য।
আরও পড়ুন
কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত প্রণব; বাংলার বুকেই তৈরি করেছিলেন নতুন রাজনৈতিক দল
[তথ্যঋণ- ইন্ডিয়া টুডে, আউটলুক, সওদাগরের দোসর / সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায় (সৃষ্টিসুখ)]
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
আরও পড়ুন
প্রধানমন্ত্রী হলে, 'শ্রেষ্ঠ' হতেন তিনিই? প্রণব মুখোপাধ্যায় ও পাঁচ দশকের রাজনীতি
Powered by Froala Editor