বীরভূমের মিরাটি গ্রামে নামল শোকের ছায়া। সেইসঙ্গে শোকস্তব্ধ সারা বাংলা। অবশেষে পরাজয় স্বীকার করে নিতে বাধ্য হলেন বাংলার কাছের মানুষ প্রণব মুখোপাধ্যায়। বাংলা ছাড়িয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন জাতীয় রাজনীতির অন্যতম মুখ। পূর্ণ সময়ের জন্য দেশের রাষ্ট্রপতির দায়িত্বও সামলেছেন। অথচ তার পরেও বাংলার সঙ্গে তাঁর আত্মীয়তায় ছেদ পড়েনি কোনোদিন। এমনকি জীবনের শেষ পর্যন্ত গ্রামের দুর্গাপুজোতে পৌরোহিত্য করতেও দেখা গিয়েছে তাঁকে। স্বাভাবিকভাবেই আত্মীয় বিয়োগের দুঃখ গ্রাস করেছে সকলকে।
গত ১০ তারিখে সেনা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল তাঁকে। মস্তিষ্কে রক্তের ক্লট তৈরি হওয়ায় অস্ত্রোপচার হয় সেখানেই। করোনা পরীক্ষার রিপোর্টও পজিটিভ আসে তাঁর। কোমাতেই চালিয়ে যাচ্ছিলেন লড়াই। ফুসফুসেও ছড়িয়েছিল সংক্রমণ। সোমবার সকাল থেকেই শারীরিক অবস্থায় অবনতি হচ্ছিল দ্রুত। অবশেষে শেষ হল লড়াই। সোমবার বিকালেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর।
১৯৩৫ সালে মিরাটির বনেদি ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম প্রণব মুখোপাধ্যায়ের। কিন্তু তার মধ্যেও একধরনের মুক্তচিন্তা এবং আধুনিক মননের প্রভাব ছিল ছোটো থেকেই। আর তার সঙ্গেই জুড়ে গিয়েছিল সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশকে নতুন দিশায় এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন। সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজ এবং তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে তারপর ভর্তি হন আইন নিয়ে। এর পরেই রাজনীতির মঞ্চে আত্মপ্রকাশ প্রণব মুখোপাধ্যায়ের। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নেকনজরে আসেন তিনি। আর এই সম্পর্ক স্থায়ী হয়েছিল ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যু পর্যন্ত। এমনকি এমার্জেন্সির সময় বহু বিতর্কের মধ্যেও মন্ত্রীসভার দায়িত্ব সামলেছেন তিনি।
লোকসভার পাশাপাশি রাজ্যসভাতেও কংগ্রেসের প্রতিনিধি হিসাবে নির্বাচিত হয়েছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর রাজীব গান্ধী তাঁকে ক্রমশ কোণঠাসা করতে চাইলেও ততদিনে হয়ে উঠেছেন জাতীয় কংগ্রেস দলের একজন মহীরুহ। নানা সময়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক, বিদেশ মন্ত্রক এবং অর্থ মন্ত্রকের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। বিশেষ করে ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মন্দার মধ্যেও দেশের অর্থনীতিকে একেবারে ভেঙে পড়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়।
এর পর তাঁর রাজনীতির জীবনে অপেক্ষা করছিল আরও এক পালাবদল। দেশের নানা প্রান্তের নানা দলে বিভক্ত মানুষ একসঙ্গে রাষ্ট্রপতির আসনে দেখতে চাইলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়কেই। আর তাই ২০১২ সালে বাংলার কাছের মানুষ চলে গেলেন রাজ্য থেকে অনেক দূরে দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনে।কিন্তু এর মধ্যেও সমস্ত ব্যস্ততা কাটিয়ে প্রতি বছর দুর্গাপুজোয় বাড়িতে এসেছেন, নিজের হাতে পৌরোহিত্য করেছেন। ২০১৭ সালে রাষ্ট্রপতি পদের মেয়াদ শেষের পর আর রাজনীতির মধ্যে থাকতে চাননি তিনি। এরপর থেকে অবসর নিয়ে গ্রামেই থাকতেন। রাজনীতির সঙ্গে যোগাযোগও কমে এসেছিল অনেকটাই। কিন্তু এর মধ্যেই তাঁর মৃত্যু সংবাদ বুঝিয়ে দিল, বাঙালির স্মৃতিতে তাঁর ছবি এত তাড়াতাড়ি মলিন হওয়ার নয়।
Powered by Froala Editor