পেশায় ডাকবাহক, পথে কুড়নো নুড়ি দিয়েই বানিয়ে ফেলেছিলেন আস্ত প্রাসাদ

তখন ১৯১২ সাল। প্যারিসের নগর কর্তৃপক্ষের কাছে জমা পড়ল একটি আবেদনপত্র। মৃত্যুর পর নিজের তৈরি প্রাসাদের নিচেই থেকে যেতে চান এক ব্যক্তি। কর্তৃপক্ষ আবেদন মঞ্জুর করল না। কিন্তু তাতে দমে গেলেন না সেই ব্যক্তি। প্যারিসের সমাধিক্ষেত্রে আবার নতুন করে সৌধ তৈরির কাজ শুরু করলেন। সেই ব্যক্তির নাম ফার্দিনান্দ শেভাল।

বয়স তখন ৭৬। শেভাল কোনো আর্কিটেক্ট বা ভাস্কর নন। তাঁর নিজের কথায়, তিনি কখনো কর্নিকে হাত দেননি, ছেনি ছুঁয়ে দেখেননি। তাঁর প্রাসাদের পাশ দিয়ে যারা হেঁটে যাবে, তারা দেখবে একজন কৃষকের মনের স্বপ্ন বিকশিত হয়ে জগতের রানির রূপ তৈরি করেছে। সেই প্রাসাদের নাম রেখেছিলেন 'টম্পেল ডি লা ন্যাচ্যর'। এখন 'প্যালেিস আইডিয়েল' নামেই বিখ্যাত।

পেশায় ডাকবাহক শেভাল জীবিকার সূত্রে প্যারিসের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন। এভাবেই ঘুরতে ঘুরতে একদিন রাস্তায় কুড়িয়ে পেলেন একটি নুড়ি। একটি সামান্য নুড়ি, অথচ শেভালের মনে হল যেন প্রকৃতির অনিন্দ্য সুন্দর একটি উপাদান। নুড়িটি পকেটে ভরে ফেললেন। সেটা ১৮৭৯ সাল। তারপর রাস্তায় রাস্তায় এমনই কত নুড়ি কুড়িয়ে বেড়িয়েছেন। একসময় আর পকেটে জায়গা হয় না। নুড়ি কুড়োতে ঝুড়ি নিয়ে যান। তারপর ঠেলাগাড়ি। আর সারারাত জেগে সেই নুড়ি জুড়ে জুড়ে তৈরি করেন তাঁর কল্পনার মূর্তি। প্রতিবেশীদের হাসিঠাট্টার দিকে ফিরেও তাকাতেন না। কথায় বলে বিন্দু বিন্দু দিয়ে সিন্ধু হয়। আর শেভাল নুড়ি গেঁথে গেঁথে গড়ে তুললেন এক বিশাল প্রাসাদ। প্রাসাদটি দৈর্ঘ্যে ২৬ মিটার, উচ্চতায় ১০ মিটার। কুড়িয়ে পাওয়া নুড়ি গাঁথতে ব্যবহার করেছেন চুনাপাথর ও সিমেন্ট। আর নিজের কল্পনারসে ইউরোপীয় স্থাপত্য থেকে ভারতীয় বা মিশরীয় স্থাপত্যের মেলবন্ধনে একটু একটু করে ফুটিয়ে তুলেছেন পৃথিবীর নানা প্রান্তের নানা লোককথা। তার সঙ্গে বিভিন্ন গাছগাছালি ও জীবজন্তুর সমাহার।

৩৩ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে স্বপ্নের প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন ফার্দিনান্দ শেভাল। এর মধ্যে হারিয়েছেন নিজের কন্যা অ্যালিস, পুত্র সিরিল এমনকি স্ত্রীকেও। কন্যা অ্যালিসের নামাঙ্কিত একটি পৃথক সৌধও বানিয়েছিলেন তিনি। এখন তাঁর সেসব সৃষ্টি দেখতে দেশবিদেশ থেকে প্রতিবছর হাজার হাজার দর্শক ভিড় জমান। ১৯৬৯ সালে ফ্রান্সের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আন্দ্রে ম্যালরক্স 'প্যালেইস আইডিয়েল'কে বিশেষ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ঘোষণা করেন। পরবর্তী প্রজন্মের বহু শিল্পীর সমাদর পেয়েছে এই প্রাসাদ। তার মধ্যে আছেন আন্দ্রে ব্রেটন, পাবলো পিকাসো, ম্যাক্স আর্নেস্টের মতো প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব।

১৮৭৯ সালে যখন প্রাসাদ তৈরির কাজ শুরু করেন শেভাল, তখন ডাডাইজম বা সুররিয়ালিজমের জন্মই হয়নি। অথচ তাঁর শিল্পীমনে তিনি ভবিষ্যতকে স্পর্শ করে গেছেন। বিরাট এই স্থাপত্যের মধ্যে আছে মানবসভ্যতার ঐতিহ্যের অহংকার, আছে প্রকৃতির আহ্বান। তাঁর শিল্পবোধ ভবিষ্যতের শিল্পীদের কতটা প্রভাবিত করেছিল, তার প্রমাণ আমরা পাই ম্যাক্স আর্নেস্টের 'দ্য পোস্টম্যান শেভাল' সিরিজের ছবিগুলি থেকে। তবে নিজের জীবদ্দশায় স্বীকৃতির অন্তরালেই থেকে গেছেন ফার্দিনান্দ শেভাল। নাহলে হয়তো তাঁর আবেদন খারিজ করে দেওয়ার আগে তাঁকে শিল্পী বলে চিনতে পারেন প্যারিসের নগর কর্তৃপক্ষ।

Powered by Froala Editor

More From Author See More