“বছর দুয়েক আগে শুভাশীষ আমার বাড়িতে এল, বলল একটা তথ্যচিত্র বানাবে। জিজ্ঞেস করলাম, কী নিয়ে তথ্যচিত্র বানাবে? তা বলে কিনা, আপনাকে নিয়ে!” বলছিলেন বরিষ্ঠ ক্রীড়া সাংবাদিক চিত্তরঞ্জন বিশ্বাস ওরফে চিরঞ্জীব। সারা জীবন খেলার মাঠের জানা অজানা নানা তথ্য নিয়ে যিনি কাজ করে গিয়েছেন, তাঁকে নিয়েই তৈরি হতে চলেছে তথ্যচিত্র (Documentary) ‘সিটিয়াস অলটিয়াস ফোরটিয়াস’ (Citius Altius Fortius)। তরুণ পরিচালক শুভাশীষ ভট্টাচার্য্যের পরিচালনায় এবং ব্ল্যাক মিরর ফিল্মসের প্রযোজনায় গত ২ মাস ধরে চলছে নির্মাণের কাজ। আর আজ তাঁদের পক্ষ থেকেই শহিদ মিনার চত্ত্বরে কলকাতা স্পোর্টস জার্নালিস্ট ক্লাবের সভাঘরে তথ্যচিত্রটির পোস্টার উদ্বোধন করা হল। প্রসঙ্গত, এই আয়োজনের অনলাইন পার্টনার প্রহর।
আজকের অনুষ্ঠানে অতিথির আসনে উপস্থিত ছিলেন প্রাক্তন ফুটবলার সুব্রত ভট্টাচার্য, পশ্চিমবঙ্গ অ্যাথলেটিক্স কোচেস অ্যাসোসিয়েশনের সচিব স্বপন রাহা, স্পোর্টস অথরিটি অফ ইন্ডিয়ার প্রাক্তন চিফ জিমন্যাস্টিক কোচ মিনারা বেগম, কলকাতা স্পোর্টস জার্নালিস্ট ক্লাবের সভাপতি মুনাল চট্টোপাধ্যায়, আলোকচিত্রী অতনু পাল, অভিনেতা বিশ্বনাথ বসু এবং অবশ্যই যাঁকে ঘিরে এই আয়োজন সেই চিরঞ্জীব।
১৯৩৮ সালে অবিভক্ত বাংলার খুলনা জেলায় জন্ম চিরঞ্জীবের। দেখতে দেখতে ৮০-র গণ্ডি পেরিয়েছে বয়স। অথচ শরীর ভাঙেনি এতটুকু। ঋজু শরীরে স্পষ্ট গলায় চিরঞ্জীব শোনালেন তাঁর ক্রীড়া সাংবাদিকতার জীবনে প্রবেশের বৃত্তান্ত। ১৯৬৫ সাল, সদ্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতা নিয়ে পাশ করেছেন তিনি। আনন্দবাজার পত্রিকায় মতি নন্দী তখন শুরু করেছেন ‘মাঠে-ময়দানে’। সেই বিভাগে লেখার দায়িত্ব পড়ল চিত্তরঞ্জন বিশ্বাসের ওপর। এতদিন তিনি খেলার মাঠে শুধুই দর্শক ছিলেন। কিন্তু এবার এক অন্য ভূমিকা। কীভাবে মাঠের গল্প খুঁজে আনতে হয়, কীভাবে সাজাতে হয় সংবাদ – তার কোনো আদর্শ রূপ তখন ছিল না তাঁর কাছে। নিজে নিজেই খুঁজে নিয়েছেন সমস্ত রাস্তা।
এরপর আনন্দবাজার পত্রিকায় দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করেছেন। সেখান থেকে বেরিয়ে গিয়ে পরে যোগ দিয়েছেন ‘ইত্যাদি’ প্রকাশনীতে। আরও নানা প্রকাশনী ও সংবাদপত্রের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। ফুটবল-ক্রিকেটের খবর তো ছিলই, তবে চিরঞ্জীবের সবচেয়ে বড়ো ভূমিকা ছিল প্রচারের আড়ালে থাকা নানা খেলা, বিশেষত অ্যাথলেটিক্সের সঙ্গে সাধারণ মানুষের পরিচয় ঘটানোয়। অলিম্পিকের খবর সংগ্রহের জন্য ঘুরে বেরিয়েছেন মস্কো থেকে লন্ডন, লস অ্যাঞ্জেলস সহ পৃথিবীর নানা শহরে। আবার বাংলার খেলোয়াড়দের খেলার নিখুঁত সমালোচনাতেও তাঁর জুড়ি মেলা ভার। সুব্রত ভট্টাচার্য বলছিলেন, “চিত্তদা ছিলেন আমাদের অভিভাবকের মতো। আমরা ভালো খেললে প্রশংসাও যেমন করেছেন, তেমনই খারাপ খেলার সমালোচনা করতেও কসুর করেননি। আর এইসব সমালোচনাই তো আমাদের আরও ভালো খেলতে উদ্বুদ্ধ করেছে।”
একই কথা বলছিলেন মিনারা বেগমও। শুধু খেলার সমালোচনাই নয়, তাঁর কথায় উঠে এল চিরঞ্জীবের সাংবাদিকতার মানবিক দিকটিও। “অনুশীলনের জন্য যখন আসতাম, আমাদের তো তখন বাড়িতে ফোন করে সবসময় খবর জানানো সম্ভব হত না, চিত্তদার লেখা পড়েই বাবা-মা আমাদের খবর জানতে পারতেন। আমরা নিরাপদে আছি জেনে নিশ্চিন্ত হতেন।” বলছিলেন তিনি। পেশাগত কারণেই চিরঞ্জীবের কাজের সবচেয়ে কাছাকাছি কলকাতা স্পোর্টস জার্নালিস্ট ক্লাবের সভাপতি মুনাল চট্টোপাধ্যায়। তিনি জানালেন, সাজঘর বা ড্রেসিংরুম থেকে খবর খুঁজে আনার শিক্ষা দিয়েছিলেন চিরঞ্জীবই। পরে সেটাই ক্রীড়া সাংবাদিকতার মান্য ধারায় পরিণত হয়। মুনালবাবু আরও বলছিলেন, “চিত্তদার মতো মানুষরা তথ্যের ভাণ্ডার। অথচ তাঁদের জীবনের তথ্যকে ধরে রাখার মতো কোনো উদ্যোগই তো সেভাবে নেওয়া হয় না। বাংলার কোনো ক্রীড়া সাংবাদিক বা ক্রীড়া সাহিত্যিকের জীবন নিয়েই তথ্যচিত্র তৈরি হয়নি। কজন খেলোয়াড়ের জীবন নিয়েই বা হয়েছে?” একই সুর উঠে এল আলোকচিত্রী অতনু পালের কথাতেও। তাঁর কথায়, “একটা জাতির তথ্য হারিয়ে ফেলার চেয়ে বড়ো গ্লানি আর কিছুতেই নেই। অথচ আমরা অবলীলায় তথ্য হারিয়ে ফেলি। আপসোসও করি না।”
প্রত্যেকের কাছেই তাই শুভাশীষ ভট্টাচার্য্যের এই উদ্যোগ এক অন্যরকম অনুভূতির সৃষ্টি করে। শুভাশীষের শিক্ষক স্থানীয় এবং দীর্ঘদিনের শুভাকাঙ্খী হওয়ার সুবাদেই তাঁর এই উদ্যোগ নিয়ে গর্বিত অতনু পাল। বাকিরাও যেন অনেকখানি কৃতজ্ঞ এই উদ্যোগের কাছে। এর আগেও রাসবিহারী বসু এবং নবারুণ ভট্টাচার্য্যের জীবন নিয়ে তথ্যচিত্র বানিয়েছেন শুভাশীষ। তাঁর সমস্ত কাজেই পাশে থেকেছেন অভিনেতা বিশ্বনাথ বসু। বিশ্বনাথ বলছিলেন, “ষাটের কোঠা পেরিয়েও যাঁদের শরীর অটুট, স্মৃতি সুস্পষ্ট – তাঁদের আমি হিংসা করি। আর সেই জায়গা থেকেই চিরঞ্জীবের সাম্প্রতিক বই ও অন্যান্য লেখালেখি পড়ে আমার আগ্রহ জন্মায়।” তবে সেটা তো কেবল কথার কথা। আসলে তথাকথিত বাণিজ্যিক ছবির জগতেই নিজেকে বেঁধে রাখতে চান না বিশ্বনাথ। বরং অন্য ধারার কাজগুলোও যথেষ্ট সুযোগ পাক, এটাই তাঁর উদ্দেশ্য। এভাবেই নিজের সামাজিক দায়িত্ববোধের কাছে সৎ থাকতে চান তিনি। সেই প্রসঙ্গও উঠে এল বিশ্বনাথের কথায়।
তথ্যচিত্রের সামান্য অংশের শুটিং সম্পূর্ণ হয়েছে ইতিমধ্যে। এখনও অধিকাংশ কাজই বাকি। তবে আগামী বছরের মাঝামাঝির মধ্যেই পুরোটা শেষ করে ফেলতে পারবেন বলে মনে করছেন শুভাশীষ। ডকু ফিচারের আদলে নয়, বরং ওয়েবসিরিজের মতো করে ১০ পর্বের একটা ডকু সিরিজ তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানালেন তিনি। ‘সিটিয়াস অলটিয়াস ফোরটিয়াস’-এর কাজ শেষ হলে বাংলা সিনেমার জগতে তো বটেই, বাংলার সংস্কৃতি জগতেই একটা ইতিহাস তৈরি হবে, তাতে সন্দেহ নেই। আর এই ইতিহাসের মধ্যে ধরা পড়ে যাবেন বাংলার ক্রীড়া সাংবাদিকতার সবচেয়ে বরিষ্ঠ এবং প্রচারবিমুখ মানুষটি।
Powered by Froala Editor