একদিকে ইংল্যান্ড, আমেরিকা ও অন্যান্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলির নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে প্রথম বিশ্ব। অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট রাশিয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে, অথচ আবারও বিশ্বজুড়ে শুরু হয়েছে এক যুদ্ধের বাতাবরণ। যুদ্ধ কি সত্যিই শুরু হবে, নাকি এই দমবন্ধ করা পরিস্থিতিই চলতে থাকবে? এই প্রশ্নটাই সবার মুখে। এর মধ্যেই সবার নজর ঘুরে গেল অন্য একটি দিকে। একটি নিছকই প্রেমের গল্প। ইংল্যান্ডের গুপ্তচর সংস্থা পোর্টল্যান্ড সিক্রেট সার্ভিসের দুই কর্মচারী হ্যারি হগটন এবং ইথেল গি। তাঁদের অবৈধ সম্পর্কের অভিযোগ তুলেছেন হগটনের স্ত্রী। তবে এই খবর নিছকই প্রেমের খবর হয়ে থাকল না শেষ পর্যন্ত। তার সঙ্গে জড়িয়ে গেল ঠান্ডা যুদ্ধের ইতিহাসও।
১৯৫৬ সাল থেকেই ব্রিটিশ সরকারের সন্দেহ হয়, তাঁদের বেশ কিছু গোপন খবর পাচার হয়ে যাচ্ছে রাশিয়ার কাছে। এর পিছনে পোর্টল্যান্ড সিক্রেট সার্ভিসের কোনো পদস্থ কর্মচারীর হাত আছে বলেও সন্দেহ করেছিলেন তাঁরা। শুরু হয় নজরদারি। ঠিক এই সময়েই হঠাৎ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় হগটনের স্ত্রীর একটি চিঠি। হগটন এবং গি-এর অবৈধ সম্পর্কের কথা জানিয়েছেন তিনি। সেইসঙ্গে জানিয়েছেন তাঁরা দুজনে মিলে ব্রিটিশ সরকারের গোপন নথি পৌঁছে দিচ্ছেন বিদেশি শক্তির হাতে। হগটনের স্ত্রী চিঠিতে লিখেছেন, যে সমস্ত নথি গি-এর পাওয়ার কথা নয় তা অতি গোপনে গি-এর হাতে পৌঁছে দেন হগটন।
এই চিঠি প্রকাশ পাওয়ার পরেই হগটনের স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করে পুলিশ। আরও নানা তথ্য সংগ্রহ করেন তাঁরা। জানা যায়, এই কাজে মাইক্রোপ্রিন্টিং প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়েছেন হগটন এবং গি। একটা গোটা পাতার সমস্ত লেখার ছবি তুলে তা মাত্র একটা ডটের মতো আয়তনে ছেপে ফেলা যায় এই প্রযুক্তিতে। পোর্টল্যান্ড সিক্রেট সার্ভিসের গুটিকয় কর্মচারীই এই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে জানতেন। একটু একটু করে আরও নানা তথ্য আসে প্রশাসনের হাতে। শুধুই হগটন এবং গি নন, জড়িত আছেন এই গুপ্তচর সংস্থার আরও ৩ জন কর্মচারী। অবশ্য সমস্ত খবর সংগ্রহের পর তা রাশিয়ার হাতে পৌঁছে দেওয়ার কাজটা গি একাই করেন।
১৯৬০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গ্রেপ্তার করা হয় এই ৫ সন্দেহভাজন কর্মচারীকে। ১৯৬১ সালে শুরু হয় বিচারপ্রক্রিয়া। তবে এই বিচার প্রক্রিয়া চলাকালীন সংবাদপত্রে সবচেয়ে বেশি আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে হগটন ও গি-এর প্রেমকাহিনি। হগটন কি তাহলে তাঁর প্রথমা স্ত্রীকে ডিভোর্স দেবেন? নতুন করে বিয়ে করবেন ইথেল গিকে? ৪ বছর ধরে নিয়মিত চলেছিল এইসমস্ত মুখরোচক খবর। এর মধ্যে ১৯৬৫ সালে ৫ জন অপরাধীর শাস্তি ঘোষণা করা হয়। ১৫ বছরের কারাবাস হয় হগটন এবং গি-এর। তবে তাঁদের মধ্যে চিঠি লেখালেখি চলতে থাকে।
আরও পড়ুন
তিন-তিনটি দেশে গুপ্তচরবৃত্তি, ডাসকো পোপভের অনুকরণেই জন্ম 'জেমস বন্ড'-এর!
এই ১৫ বছর চিঠির ভিতর দিয়েই আরও কাছে এসেছেন দুজন। পরস্পরের ভালোবাসা আরও বেশি করে স্পর্শ করে গিয়েছে পরস্পরকে। ইথেলের মা মারা গেলে সমব্যথী হয়েছেন হগটন। ১৫ বছর পর ১৯৭০ সালে মুক্তি পান দুজনেই। আবারও মানুষের আগ্রহ ঘিরে ধরে তাঁদের। এবার কি বিবাহ করতে চলেছেন তাঁরা? হ্যাঁ, ১৯৭১ সালে সত্যিই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন হগটন এবং গি। এইসময় এক সাংবাদিক বৈঠকে তাঁরা জানিয়েছিলেন, ইংল্যান্ডের কোনো ক্ষতি করার উদ্দেশ্যই তাঁদের ছিল না। তাঁরা শুধু চেয়েছিলেন আর একটা বিধ্বংসী যুদ্ধের সম্ভাবনা নির্মূল করতে। অন্যদিকে হগটনের স্ত্রী চেয়েছিলেন ব্রিটিশ সরকারের সার্বিক সাফল্য। হগটন এমন কোনো জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করতেন না। আর সেই মানসিকতারই প্রকাশ দেখেছিলেন ইথেল গি-এর মধ্যেও। মতাদর্শগত এই মিলই কাছাকাছি এনেছিল দুজনের। আর সেই সম্পর্ক বজায় ছিল ১৯৮৪ সালে গি-এর মৃত্যুর দিন পর্যন্ত। তারপরেই একা হয়ে যান হগটন। পরের বছরই তাঁরও মৃত্যু হয়। শুধু অসংখ্য চিঠিতে পড়ে থাকে ভালোবাসার ইস্তেহার।
আরও পড়ুন
গুপ্তচরবৃত্তি থেকে তাপমাত্রা নির্ণয় - ‘মুশকিল আসান’ হয়ে উঠেছিল ফিনফিনে ঘুড়িই
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
গুপ্তচর সন্দেহে জেলবন্দি; ’৬২-র যুদ্ধে যেভাবে ‘বেঁচে’ ছিলেন অসমের চা-বাগানের কুলিরা