ভালোর ভালো, আর মন্দের যম। বাংলায় যেমন বাঁটুল দি গ্রেট, তেমনই তেমনই ও-দেশে পপ-আই (Popeye The Sailor Man)। তবে বাঁটুলের মতো শুধু প্রবল শক্তিই নয়, তার অভিযান দক্ষতাও একইসঙ্গে পপ-আইকে জনপ্রিয় করে তুলেছিল মার্কিন কিশোর-কিশোরীদের কাছে। তাদের অনুপ্রেরণাও হয়ে উঠেছিল এই মার্কিন কমিক চরিত্রটি। এমনকি তিরিশের দশকে পপ-আইকে দেখেই পালং শাক (Spinach) খাওয়ার চল বেড়েছিল মার্কিন মুলুকে।
“আমার শক্তির সামনে সমস্ত শত্রুই শিশু, কারণ আমি পালং শাক খাই।”
পপ-আই-এর এই সংলাপ রীতিমতো ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা মার্কিন মুলুকে। আর চিকিৎসক থেকে অভিভাবক— ছোট্ট শিশুদের পালং শাক খাওয়াতে সকলেই হাতিয়ার করে নিয়েছিলেন পপ-আইকে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, অতিসামান্য গাণিতিক ভুলের কারণেই মাটন কিংবা চিকেন ছেড়ে নিজের ডায়েটে পালং-কে বেছে নিয়ছিল দুর্ধর্ষ নাবিক পপ-আই।
হ্যাঁ, বাস্তবিক গাণিতিক ভুলেই। সেই গল্পের জন্য পিছিয়ে যেতে হবে আরও কয়েকটা বছর। উনিশ শতকের শেষের দিক সেটা। পালং শাক নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে উন্মাদনার সূত্রপাত হয় ১৮৭০-এর দশকে। আর তার নেপথ্যে ছিলেন জার্মান গবেষক ও উদ্ভিদবিদ এরিখ ভন উলফ। বিভিন্ন শাক-সবজির মধ্যে আয়রন বা লোহার উপস্থিতি নিয়েই গবেষণা করছিলেন তিনি। আর তাঁর গবেষণা থেকেই উঠে আসে, প্রতি ১০০ গ্রাম পালং-এর মধ্যে ৩৫ মিলিগ্রাম লোহা রয়েছে। অর্থাৎ, সমপরিমাণ মাটনের থেকেও তাতে লোহার উপস্থিতি ১০ শতাংশ বেশি। আর এই কারণেই মাংসের থেকে পালং-কে বেশি পুষ্টিকর বলে দাবি করেন গবেষক ভন উলফ। বলাইবাহুল্য, খুব অল্পদিনের মধ্যেই পালং হয়ে ওঠে ইউরোপীয়দের কাছে ‘সুপার ফুড’। ক্রমে ক্রমে তার জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে আমেরিকাতেও।
আরও পড়ুন
এক নজরে নারায়ণ দেবনাথ সৃষ্ট সব কমিক চরিত্র
আরও পড়ুন
শুধু কমিকস্ই নয়, পুরোদস্তুর গল্পও লিখেছেন নারায়ণ দেবনাথ!
দুর্ধর্ষ নাবিক পপ-আই-এর জন্মও এই একই সময়ে। সেটা ১৯২৯ সাল। মার্কিন কার্টুনিস্ট এলজি ক্রিস্টলার জিগারের সৃষ্ট এই কমিক স্ট্রিপটি প্রথম প্রকাশিত হয় ‘ডেইলি কিং ফিচার’-এর ‘থিম্বল থিয়েটার’ বিভাগে। পালং-মাদকতা তখন গোটা বিশ্বজুড়েই। ফলে স্পষ্টতই তার ছাপ পড়ল জিগারের তৈরি কমিক চরিত্রে। মাংসের বদলে তার পাতে পড়ল পালং। মাংসের থেকে পালং বেশি পুষ্টিকর বলেই, এই খাবারকে বেছে নিয়েছে পপ-আই— এভাবেই কমিক গল্পের নির্মাণ করলেন জিগার।
আরও পড়ুন
কমিক্সের বই থেকে সোশ্যাল মিডিয়া; নতুন প্রজন্মের হাত ধরে মিমের জগতেও উজ্জ্বল টিনটিন
প্রবল জনপ্রিয় চরিত্র পপ-আই-এর এই পালং-প্রেমই মার্কিন মুলুকে পালং-মাদকতায় প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল সে-সময়। স্বাদ ভালো না হলেও, কেবল পপ-আই-এর মতো ‘বাহুবলী’ হয়ে উঠতেই রীতিমতো নাক চেপে পালং গলার্ধকরণ করত মার্কিন কিশোর-কিশোরীরা। এমনকি শুধু পপ-আই-এর কারণে মার্কিন মুলুকে ৫ বছরে পালং-এর বিক্রি ও উৎপাদন বেড়েছিল ৩৩ শতাংশ।
তবে সেই ভুল ভাঙে ১৯৩৭ সালে। পালং-এর এই সুপার পাওয়ার নিয়ে দ্বিতীয়বার গবেষণায় নামেন আরও এক জার্মান গবেষক। তাঁর অনুসন্ধানেই বেরিয়ে আসে আসল তথ্য। অন্যান্য শাক-সবজি, ফলের থেকে পালং-এ যে আয়রনের পরিমাণ বেশি— তাতে সন্দেহ নেই কোনো। তবে মাংসের পুষ্টির ধারে-কাছেও পৌঁছাতে পারে না পালং-এ উপস্থিত আয়রনের মাত্র। হ্যাঁ, গাণিতিক গণনার সময় সামান্য ভুল করেছিলেন ভন উলফ। আয়রনের শতকরা মাত্রা নির্ণয়ের সময় ভুল হয়েছিল সামান্য একটি গুনে। আর তাতেই ৩.৫ মিলিগ্রামের বদলে উত্তর আসে ৩৫ মিলিগ্রাম।
পপ-আই-এর পালং-প্রীতি জনপ্রিয় হওয়ার প্রায় এক দশক পরে প্রকাশ্যে আসে এই তথ্য। তাতে সামগ্রিকভাবে বিশ্বজুড়ে পালং-এর জনপ্রিয়তা কমে ঠিকই, কিন্তু কিশোর-কিশোরীদের জোর পালং খাওয়ানোয় রদবদল হয়নি এতটুকু। বদল আসেনি পপ-আই-এর ডিনার মেনুতেও…
Powered by Froala Editor