কেউ ভিক্ষা করতেন রাস্তায় রাস্তায়, কেউ শৈশবেই হারিয়েছিলেন নিজের বাবা-মাকে। আবার কেউ পিছিয়ে পড়া জনজাতির সদস্য হওয়ায়, সুযোগ পাননি পড়াশোনার। এখন তাঁরা প্রত্যেকেই সফল নিজ-নিজ ক্ষেত্রে। কারোর নামের পাশে বসে ‘ডক্টর’, কারোর আবার ‘এমফিল’ কিংবা ‘এমবিবিএস’।
পণ্ডিচেরির বুকেই রয়েছে এমন এক আশ্চর্য ভবিষ্যৎ তৈরির কারখানা। ‘উধাভি কারাঙ্গল’-নামে পরিচিত এই স্কুলকে অ্যালিসের ওয়ান্ডারল্যান্ড (Alice's Wonderland) বললেও ভুল হয় না এতটুকু। আজ থেকে ৩২ বছর আগের কথা। এই আশ্চর্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করেছিলেন কর্ণাটকের সমাজকর্মী অ্যালিস থমাস (Alice Thomas)। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২১ বছর। তবে শৈশব থেকেই যে এই স্কুল তৈরির পরিকল্পনা ছিল তাঁর, এমনটা একেবারেই নয়। বরং, বলা ভালো আকস্মিকভাবেই শুরু হয়েছিল এই ‘ওয়ান্ডারল্যান্ড’-এর যাত্রাপথ।
১৯৯১ সাল। এক বন্ধুর বাড়িতে আড্ডা দিতে গিয়েছিলেন অ্যালিস। সে-সময়ই তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় ৮ বছর বয়সি ছোট্ট এক শিশুর। বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা চেয়ে বেড়ানোই তার জীবন। অ্যালিসের কাছেও হাত পেতেছিল সে। তবে সেদিন খুচরো পয়সা ছিল না অ্যালিসের পকেটে। এদিকে বন্ধুও বেরিয়েছেন মিনিট দশেকের জন্য। সময় কাটাতে ছোট্ট কিশোরটির সঙ্গে গল্প শুরু করেছিলেন অ্যালিস। সেই কথোপকথনই তাঁকে পৌঁছে দেয় এক আশ্চর্য অন্ধকার জগতে। যেখানে প্রতিনিয়তই শেষ হয়ে যায় হাজার হাজার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।
না, চুপ করে বসে থাকতে পারেননি তিনি। কথার ফাঁকে জেনে নিয়েছিলেন, ছোট্ট শিশুটির ঠিকানা। বাড়ি ফিরে কিছুদিনের মধ্যেই ব্যবস্থা করে ফেলেন এক ফালি ঘরের। সেখানেই গড়ে তোলেন ছোট্ট একটি স্কুল। সেই স্কুলের প্রথম ছাত্র ছিল সে-দিনের ভিক্ষুক কিশোরটি। এরপর আর ফিরে তাকাননি অ্যালিস। একবছরের মধ্যেই স্কুলে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫। পণ্ডিচেরি শহরে ঘুরে ঘুরে এ-ধরনের শিশুদের জোগাড় করেন তিনি।
প্রাথমিকভাবে কেবলমাত্র এই স্কুলে ক্লাস করার জন্যই আসত তারা। পরবর্তীতে স্কুল সংলগ্ন অঞ্চলেই গড়ে ওঠে শিক্ষার্থীদের থাকার জায়গা। বর্তমানে, একটি বয়েজ এবং গার্লস হোস্টেল ছাড়াও এই স্কুলে রয়েছে হস্তশিল্পের কাজের জন্য একটি বিশেষ ভবন। শিশুদের থাকা-খাওয়ার খরচের দায়ভারও নিজের কাঁধেই বয়ে চলেছেন অ্যালিস। হয়ে উঠেছেন দেড় শতাধিক দুঃস্থ শিক্ষার্থীদের ‘আম্মা’।
তবে বর্তমানে তাঁর কাঁধ থেকে এই স্কুলের দায়িত্ব খানিকটা নেমেছে। আসলে সফলভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরেও তাঁর শিক্ষার্থীরা ছেড়ে যাননি অ্যালিসকে। কেউ এখন তাঁর স্কুলের অধ্যক্ষা, কেউ সেখানকার অঙ্কের স্যার। আবার যাঁরা চাকরিসূত্রে বিদেশে থাকেন, তাঁরা মাস গেলেই মোটা অঙ্কের অর্থ পাঠান ‘ভাই-বোন’-দের পড়াশোনা, থাকা-খাওয়ার খরচ চালানোর জন্য। কেউ আবার এমডি করার পর, চিকিৎসার ভার নিয়েছেন এইসকল অনাথ শিশুদের। সবমিলিয়ে অ্যালিসের দূরদর্শিতা বদলে দিয়েছে সমাজের প্রথাগত নিয়ম। আজও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে যাওয়ার মন্ত্র দিয়ে চলেছেন কর্ণাটকের ৫২ বছর বয়সি মহীয়সী এবং তাঁর এই বৃহত্তর ‘পরিবার’…
Powered by Froala Editor