শেষ হয়ে যাচ্ছে আরও একটা বছর। ঘটনার আবহে কেটে গেল আমাদের প্রত্যেকের দিনগুলো। শুধু কি আমাদের? রাজ্য রাজনীতির ক্ষেত্রেও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে এই বছরে। ভাল-মন্দ, তর্ক-বিতর্কের জন্য সময় বাঁচিয়ে আসুন দেখে নেওয়া যাক ২০১৯-এ রাজনীতির ময়দানে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটনা—
বিজেপির মিছিল ও বিদ্যাসাগর কলেজে হামলা
১৪ মে। মঙ্গলবার। কলকাতার বিধান সরণিতে রোড শো আয়োজন করেছে বিজেপি। উপলক্ষ অমিত শাহ। মিছিলের সবার আগে গাড়িতে তিনি। কলেজ স্ট্রিট অঞ্চলে মিছিল আসার পরই শুরু হয় গণ্ডগোল। মুহূর্তে সমস্ত সংবাদমাধ্যমের ব্রেকিং নিউজ বদলে যায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাস ও বিদ্যাসাগর কলেজে হামলা চালায় বিজেপি’র কর্মীরা। ছাত্রছাত্রীরা আহত হন, বাইক পোড়ানো হয়। তবে ঘটনা অন্য মোড় দিল কলেজ প্রাঙ্গণে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙে যাওয়ার পর। দীর্ঘ বহুদিন সেই নিয়ে চলে চাপানউতোর। শুধু রাজনীতি নয়, বাংলা সংস্কৃতির ওপর বর্বর হামলা বলে উল্লেখ করেন শিক্ষাবিদরা
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাবুল সুপ্রিয়’কে কেন্দ্র করে গণ্ডগোল
তিনি একাধারে গায়ক, বিজেপি নেতা এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। এসেছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজেপি ছাত্র সংসদ আয়োজিত নবীন বরণ অনুষ্ঠানে। ১৯ সেপ্টেম্বর বাবুল সুপ্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করলে তাঁকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন পড়ুয়ারা। পরে যে বিক্ষোভ রণক্ষেত্রের আকার নেয়। সম্পূর্ণ যাদবপুর অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগের সুর চড়তে থাকে। অবস্থা এমন হয় যে, পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাবুল সুপ্রিয়কে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন।
এনআরসি তালিকা, আসামে ১৯ লক্ষ মানুষ বাদ
এনআরসি, বা জাতীয় নাগরিকপঞ্জী। এই মুহূর্তে ভারতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ইস্যু বোধহয় এটাই। আসামে এর আগেই এই বিশেষ নাগরিকত্বের তালিকা তৈরির প্রক্রিয়া চলছিল। অবশেষে, এই বছর ৩১ আগস্ট আসামে এনআরসি সম্পূর্ণ হল। তালিকা থেকে বাদ পড়লেন প্রায় ১৯ লক্ষ মানুষ। পরবর্তীকালে আরও অনেক বিতর্ক মাথা চাড়া দিয়েছে। এখনও থামেনি সেই আলোচনা। কিন্তু এই ১৯ লক্ষ মানুষের ভবিষ্যৎ কী? সরকার চুপ
সার্জিকাল স্ট্রাইক ও ভারত-পাক আবহ
২০১৯-এর লোকসভা ভোটের ঠিক আগেই ভারতের পুলওয়ামায় আত্মঘাতী জঙ্গি আক্রমণ হয়। সিআরপিএফ-এর ৪০ জন জওয়ান শহিদ হন। সেই মুহূর্ত থেকে নতুন করে ভারত-পাক সংঘাত শুরু হয়। যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয় দুই দেশের মধ্যে। এরই মধ্যে দ্বিতীয়বার সার্জিকাল স্ট্রাইক করে ভারতের বায়ুসেনা। বালাকোটে জইশ-ই-মহম্মদের সবচেয়ে বড় জঙ্গি ঘাঁটি ধ্বংস করে দেন সেনারা। যদিও এই ঘটনাও বিতর্ক এড়ায়নি।
কাশ্মীর ও ৩৭০ ধারা
আগস্টের শুরুতে কেন্দ্রীয় সরকারের একটা ঘোষণা গোটা ভারতে সাড়া ফেলে দেয়। জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা কেড়ে নিল কেন্দ্র। সংবিধানে কাশ্মীরের জন্য থাকা ৩৭০ ধারা ও ৩৫এ ধারা দুটি বিলোপ করে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করা হল। ঘোষণার পরই কাশ্মীরের ইন্টারনেট-সহ সমস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়া হল। মোতায়েন করা হল বিশাল সংখ্যক সেনা। কেন্দ্রীয় সরকারের এই সিদ্ধান্ত নতুন করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে বিতর্কের সৃষ্টি করল। যা এখনও অব্যাহত।
এনআরএস কাণ্ড এবং ডাক্তারদের দেশজোড়া প্রতিবাদ
বছরের মাঝামাঝি সময় শহর কলকাতা আবারও উত্তাল হয়ে উঠল ডাক্তারদের আন্দোলনে। জুন মাসে এনআরএস হাসপাতালে রোগী মৃত্যুকে কেন্দ্র করে জুনিয়র ডাক্তার এবং রোগীর পরিজনদের মধ্যে হাতাহাতি হয়। গুরুতর আহত হন একজন জুনিয়র ডাক্তার। যার পরেই কলকাতা-সহ রাজ্যের সরকারি হাসপাতালে কর্মবিরতি ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন ডাক্তাররা। সিনিয়র ডাক্তাররাও যোগ দেন, পদত্যাগ করেন। তবে এই আন্দোলন রাজ্যের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকেনি। একই সময় গোটা দেশে ডাক্তাররা বিক্ষোভ করেন। বিগত কয়েক দশকে ডাক্তারদের এমন আন্দোলন ভারত দেখেছে কিনা, কেউই সঠিক মনে করতে পারেননি।
বেসরকারিকরণ ইস্যু
অনেক আগে থেকেই আলোচনা চলছিল। এবার সেটাকেই কার্যক্ষেত্রে আনতে চাইছে কেন্দ্রীয় সরকার। বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে বেসরকারিকরণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল কেন্দ্র। এয়ার ইন্ডিয়া, ভারত পেট্রোলিয়াম-সহ বেশ কিছু সংস্থার বিপুল শেয়ার বিক্রির পথে তাঁরা। বিএসএনএল-এর অবস্থাও ভাল না। ধীরে ধীরে বেসরকারিকরণের পরিধি আরও বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। অর্থনীতির বেহাল অবস্থাকে চাঙ্গা করার জন্যই নাকি এমন পরিকল্পনা, বলছে কেন্দ্র। সত্যিই কি তাই? বিতর্ক, প্রতিবাদ এখনও থামেনি।
তিন তালাক বিরোধী বিল
২০১৯-এ দেশের রাজনীতিতে অন্যতম বড় ঘটনা তিন তালাক বিরোধী বিল। ৩০ জুলাই রাজ্যসভায় পাশ হল তাৎক্ষণিক তিন তালাক বিরোধী বিল। লোকসভায় আগেই পাশ হয়ে গিয়েছিল। এবার আইনে পরিণত হল এটি। এখন থেকে তিনবার তালাক বলে সঙ্গে সঙ্গেই বিবাহ বিচ্ছেদ ঘোষণা করা যাবে না। অন্যথায় তিন বছরের জেল হবে।
এনআরসি ও নাগরিকত্ব সংশোধনী নিয়ে কলকাতা-সহ গোটা দেশে ছাত্র আন্দোলন
বছরের শেষের দিকে সংসদের দুই কক্ষেই প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও পাশ হল নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল। আর তার পর থেকেই দেশজুড়ে বিক্ষোভের পরিস্থিতি তৈরি হল। তাতে ঘৃতাহুতি পড়ল রাতে দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশি আক্রমণের পর। গোটা দেশের ছাত্রসমাজ একসঙ্গে গর্জে উঠল। কলকাতা দেখল দুটো মহামিছিল। মুম্বই, দিল্লি, লখনউ— সমস্ত জায়গায় ছাত্ররা রাস্তায় নেমে এল প্রতিবাদে। সংবিধানকে বাঁচানোর জন্য। এনআরসি আর নাগরিকত্বের বিরোধিতায়। দেশের বাইরেও আন্দোলন তীব্রতর হচ্ছে। এখনও থামেনি প্রতিবাদ। রক্ত ঝরেছে, আগুন জ্বলেছে। সেই সঙ্গে এই বছরের সবচেয়ে বড় আন্দোলনও জারি আছে।
অযোধ্যা মামলা
রাম, না বাবর— জমি কার? বহু বছর ধরে চলে আসা এই বিবাদের ‘নিষ্পত্তি’ হল এই বছর। ১০ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট অয্যোধ্যা মামলার রায় দিলেন। রামলালার বিতর্কিত জমিতে মন্দিরই তৈরি করা হবে, সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডকে অন্যত্র পাঁচ একর জমি দেওয়া হবে। চাপা পড়ে গেল জমিতে হাসপাতাল, স্কুল তৈরির সিদ্ধান্তের কথা। ধর্মকে ভিত্তি করে এই রায়দানে স্বাভাবিকভাবেই বিতর্ক জারি আছে। ভবিষ্যতে আরও কী হয়, সেটাই দেখার।