(প্রথম পর্ব)
বাংলায় আধুনিকতার সূত্রপাত উনিশ শতক থেকে। ‘নবজাগরণ’ যাকে বলে। অবশ্য এই অভিধা নিয়ে বিতর্ক আছে। সে বিতর্কের ইতিকথা পাই নরহরি কবিরাজের বইতে। কারও কারও মতে বাংলার নবজাগরণ ব্যাপক নয় ইতালির মতো। আংশিক। কলকাতা ও সংলগ্ন অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ। বিশাল দেশ, বিশেষত গ্রামাঞ্চলে ছিল না তার প্রভাব। সেখানে যথারীতি বিরাজ করেছে আচার, প্রথা ও সংস্কারের মরুবালিরাশি। আংশিক হলেও তথাকথিত নবজাগরণ যে একটা পরিবর্তন এনেছিল, মানতে হবে সে কথা। চিন্তাধারার পরিবর্তন, জীবনদৃষ্টির পরিবর্তন। তাই সংস্কার আন্দোলন। ধর্মসংস্কার, সমাজ সংস্কার, শিক্ষা সংস্কার। মধ্যযুগীয় অন্ধতা ও গোঁড়ামির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। শুধু শাস্ত্র নয়, চাই ব্যবহারিক জ্ঞান, চাই বিজ্ঞান শিক্ষা। গুরুদেবের কথাই আর বেদবাক্য নয়, চাই যুক্তি।
সেই যুক্তির আসর বসালেন ডিরোজিও গোলদিঘিতে। চাঁদপাল ঘাটে ভিড়েছে জাহাজ। সেই জাহাজে এসেছে টম পেইনের ‘এজ অফ রিজন’। সে বই নিয়ে কাড়াকাড়ি। অবশ্য এতে ছিলেন ইংরেজি বিদ্যালয়ের বাঙালি ছাত্ররা। বাড়াবাড়িও করেছিলেন অনেক। মধ্য কলকাতার ব্রাহ্মণ-অধ্যুষিত গুরু প্রসাদ চৌধুরী লেন। সেখানে ইয়ং বেঙ্গলরা শিককাবাব নিয়ে ঢুকে পড়তেন, চিৎকার করে বলতেন, ‘আমরা গরু খাই গো’। ঠিক যে, নবজাগরণের হাওয়া তুলেছিলেন নগর কলকাতার ইংরেজি-শিক্ষিত স্বল্পসংখ্যক মানুষ। কিন্তু হাওয়াটা ছড়িয়ে পড়ছিল ধীরবিলম্বিত লয়ে। একে একে রঙ্গমঞ্চে আসতে লাগলেন রামমোহন- বিদ্যাসাগর-ভূদেব-রঙ্গলাল-বঙ্কিমচন্দ্র-মধুসূদন- দীনবন্ধুরা। প্রগতিচিন্তা তাঁদের ছিল, কিন্তু পুরোপুরি দ্বিধামুক্ত ছিলেন না তাঁরা। আবার এাঁদের পাশাপাশি খোদ কলকাতা শহরেও ছিলেন রাধাকান্তের মতো রক্ষণশীলেরা। এসবের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলছিল দেশ, জেগে উঠছিল দেশচেতনা। অস্ফুট থেকে স্ফুটতর। স্বদেশকে নিয়ে কাশীপ্রসাদ ঘোষ, ডিরোজিওরা কবিতা লিখেছিলেন ইংরেজিতে। বঙ্কিমের ভাবনায় সে বোধ রূপ দিল ‘আনন্দমঠ’কে। রঙ্গলাল বললেন, ‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায়’। কোম্পানির শাসনের নানা অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে ধ্বনিত হতে লাগল ক্ষোভ। নানা সংঘ-সংগঠনে, সংবাদপত্রে, সভা-সমিতিতে স্ফুট-অস্ফুটভাবে প্রকাশ পেতে লাগল সেই দেশাত্মবোধ, স্বাধীনতার আকাঙ্খা ।
উনিশ শতক গড়িয়ে গেল বিশ শতকে। ১৯০৫। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আন্দোলন। এমন স্বতঃস্ফূর্ত, এমন ব্যাপক আন্দোলন এ দেশে আর হয়নি। অরন্ধন, রাখিবন্ধন। শাসকের সঙ্গে প্রথম টক্কর। রণাঙ্গনে বাঙালি প্রথম মুখোমুখি শাসকের সঙ্গে। শুরু হল স্বদেশি আন্দোলন। কবি-শিল্পী-উকিল-মোক্তার-ডাক্তার-শিক্ষক-অধ্যাপক-বিজ্ঞানী সকলেই সামিল সে আন্দোলনে। অবশ্য এই নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনকে মেনে নিতে পারেননি কিছু তরুণ। তাঁদের নাম হয়েছে ‘গরমপন্থী’। রবীন্দ্রনাথের মতো স্থিতধী মানুষও নিয়মতান্ত্রিকতার ঘেরাটোপকে পছন্দ করতে পারেননি। নরমপন্থীদের বিরুদ্ধে তাঁর বিদ্রুপ ‘আবেদন নিবেদনের থালা বহে বহে নতশির’। যদিও গরমপন্থীদের সম্বন্ধে তাঁর কথা, - ‘রাষ্ট্র যখন তৈরি নেই তখন রাষ্ট্রবিপ্লবের চেষ্টা করা পথ ছেড়ে অপথে চলা’। স্বদেশি আন্দোলন বাংলা সাহিত্যেও বন্যা বইয়ে দিল। কত গান, কত প্রবন্ধ, কত নাটক, কত কবিতা। কিন্তু সেই স্বদেশি আন্দোলনে অসচেতনভাবে একটা বিষবীজ ঢুকে গেল। হিন্দুত্বের বীজ। সাম্প্রদায়িকতার বীজ। অবশ্য আজকের মতো সে হিন্দুত্ববাদে রাজনীতির মোড়ক ছিল না। বাস্তবে শাসকের সঙ্গে পেরে না উঠে হীনমন্য বাঙালি তার প্রাচীন ঐতিহ্যকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে তুলে ধরতে চাইছিল। তবু সেই বিষবীজ যে একদিন মহীরূহ হতে পারে সে কথা রবীন্দ্রনাথের মতো হাতেগোনা বাঙালি লেখক বুঝেছিলেন। কম সমালোচনা হয়নি ‘চার অধ্যায়’, ‘সত্যের আহ্বান’, ‘শিক্ষার মিলনে’র। রাজনৈতিক নেতারা সেসব কথায় কান দেননি। আশু লাভ নিয়ে তাঁদের কারবার। সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের জন্ম এখান থেকে। হিন্দু-মুসলমানের বিরোধের ইতিহাসের শুরু। অচেতনভাবে গরমপন্থী বা বিপ্লবীরাও তাতে দিলেন ইন্ধন। তাঁদের এক হাতে বন্দুক, অন্য হাতে গীতা। হিন্দুর ধর্মগ্রন্থ গীতা হাতে নিলে মুসলমানরা আসবে কেন?
তারপরে এল রুশ বিপ্লবের ঢেউ। করাচি রণাঙ্গন থেকে প্রথম সে-বার্তা বহন করে আনলেন একজন কবি, হাবিলদার কবি নজরুল ইসলাম। বিপ্লবের তত্ত্বকথায় আগ্রহ ছিল না তাঁর। বিপ্লবের বাণীটা তাঁর বুকে গেঁথে গিয়েছিল। অসাম্য থেকে, অবিচার থেকে, পীড়ন ও শোষণ থেকে মানুষের মুক্তির বার্তা। টেররিজম নয়, নিহিলিজম নয়, রাষ্ট্রবিপ্লব। শোষকের বিরুদ্ধে সর্বহারা মানুষের সংঘবদ্ধ লড়াই। কার্ল মার্কস বলছেন, হে সর্বহারা, শৃঙ্খল ছাড়া কিছুই হারাবার নেই তোমার। ক্ষমতাশালী জারকে হটিয়ে দিতে পেরেছে রাশিয়ার মানুষ, আমরা ইংরেজকে কেন পারব না হটিয়ে দিতে? যুগ যুগ ধরে যারা পতিত, নির্যাতিত তাঁরা এবার দাঁড়াবে মাথা উঁচু করে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘রথের রশি’তে এর সাংকেতিক আভাস দিয়েছেন। নজরুলের কবিতায় আরবি-ফার্সি-বাংলা শব্দের মিশ্রণে বিপ্লবের ঝংকার। সমকালীন বাংলা সাহিত্যকেও নজরুলবাহিত এই বাণী মথিত করল। ‘কল্লোল’ পত্রিকার রচনায় তার প্রভাব পড়ল। যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্য লিখলেন রুশ বিপ্লবের নায়ক লেনিনকে নিয়ে কবিতা। নজরুলের কবিতা, ‘ধূমকেতু’র লেখা টনক নড়িয়ে দিল শাসকের। বাজেয়াপ্ত হল তাঁর বই। কারারুদ্ধ করল তাঁকে। বাজেয়াপ্ত হল আরও অনেক বই। বাদ গেল না শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’। অবশ্য সাহিত্য বা সাহিত্যিকের উপর এই আক্রমণ প্রথম নয়। উনিশ শতকের শেষের দিলে নাটকের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা হয়েছিল ‘নাট্য নিয়ন্ত্রণ’ বিল এনে। ‘যুগান্তর’, ‘বন্দেমাতরম’ প্রভৃতি পত্রিকারও কন্ঠরোধ করার চেষ্টা হয়।
রুশ বিপ্লবের বাণী গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল এ-দেশের বুদ্ধিজীবী ও লেখকদের। মোহিতলাল মজুমদার ও বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের মতো মুষ্টিমেয় কিছু লেখক ব্যতীত প্রায় সকল লেখকই একে মানব মুক্তির বাণী বলে গ্রহণ করেছিলেন। বলা যেতে পারে, সেই থেকেই এ দেশের বেশিরভাগ লেখক বামাচারী অর্থাৎ বামপন্থী মনোভাবাপন্ন। ‘পরিচয়’, ‘অরণি’ প্রভৃতি পত্রিকা এই মনোভাবকে লালিত ও প্রসারিত করে দিতে সাহায্য করেছে।
১৯৩৬-এ গড়ে উঠল প্রগতি লেখক সংঘ। গণনাট্য সংঘ তার এক শাখা। তৈরি হল ইয়ুথস কালচারাল ইন্সটিটিউট। আড্ডা বসল ৪৬ নম্বরে। ঢাকায় তরুণ প্রগতিশীল লেখক সোমেন চন্দের হত্যাকাণ্ডের পর ফ্যাসিবিরোধী লেখক সংঘের জন্ম। এই সব সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে গেলেন বহু লেখক, বুদ্ধিজীবী। সুশোভন সরকার, নির্মলকুমার বসু, প্রিয়রঞ্জন সেন, হুমায়ুন কবীর, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, নীহাররঞ্জন রায়, হিরণকুমার সান্যাল, অমল হোম, ত্রিপুরারি চক্রবর্তী, গোপাল হালদার, সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিজন ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্র, প্রেমেন্দ্র মিত্র, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, তুলসী লাহিড়ী, রমেশচন্দ্র সেন, গোলাম কুদ্দুস, বিমলচন্দ্র ঘোষ, সতীনাথ ভাদুড়ী, সমরেশ বসু, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, নীরেন্দ্রনাথ রায়, বিষ্ণু দে, অরুণ মিত্র, জয়নুল আবেদীন, সোমনাথ লাহিড়ী, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, যামিনী রায়, অতুল বসু, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য এবং আরও অনেকে। নামের তালিকা শেষ হবার নয়। ব্রিটিশের অত্যাচারের প্রতিবাদ করে রবীন্দ্রনাথ ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ‘নাইটহুড’। তাঁর শেষদিককার কবিতায় এল অখ্যাত মানুষের কথা, যারা ‘কাজ করে’ তাদের কথা। তিনি জানালেন, ‘রাশিয়ায় না এলে আমার তীর্থদর্শন বাকি থেকে যেত।’
আরও পড়ুন
রামকৃষ্ণকে রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে শোনালেন তরুণ নরেন্দ্রনাথ, গুরুর মৃত্যুশোকেও সঙ্গী সেই গানই
Powered by Froala Editor