ব্রাজিলের পারাওপেবা নদীর ধারে ছোট্ট গ্রাম নাও সোহা। স্থানীয় ভাষায় যার অর্থ যোদ্ধার দীপ্তি। গ্রামবাসীদের জীবনেও এবার সত্যিই যুদ্ধের সময় এসে পড়েছে। বছর তিনেক আগেই ভয়ঙ্কর বন্যায় ভেসে গিয়েছিল গোটা অঞ্চল। তারপরেও কোনোরকমে আবার জীবনের স্রোতে ফিরে এসেছিলেন তাঁরা। কিন্তু সবকিছু গুছিয়ে নেওয়ার আগেই নতুন করে এসে গেল বন্যা (Flood)। আর এবারের বন্যার পর আর গ্রামে বসবাস করা সম্ভব হবে না বলেই মনে করছেন তাঁরা। ব্রাজিল (Brazil) সরকারের তরফ থেকেও এমনটাই আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ শুধু নদীর জল নয়, জলের সঙ্গে ভেসে আসছে পাশের লোহা খনি অঞ্চলের বর্জ্য পদার্থ। পরিত্যক্ত খনিজ জলকে বিষিয়ে তুলেছে, আর সেই বিষাক্ত জল মিশেছে চাষের জমিতেও।
পারাওপেবা নদীর ধারেই রয়েছে ব্রাজিলের অন্যতম মাইনিং সংস্থা ‘ভ্যালে’-র খনি। আর নাও সোহা গ্রামের পাশেই তাঁদের বর্জ্য ফেলার জায়গা। এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরেই সরব ছিলেন গ্রামের পাতাসো ও পাতাসো হাহাই উপজাতির মানুষরা। কিন্তু কেউই তাঁদের কথায় কান দেননি। এর মধ্যেই ২০১৯ সালে হঠাৎই সেই বর্জ্য ফেলার বাঁধ ভেঙে যায়। সমস্ত আবর্জনা গিয়ে পড়ে পারাওপেবা নদীতে। আর হঠাৎ নদীর পথ রুদ্ধ হয়ে যাওয়াতেই বন্যা দেখা দেয়। প্রায় ১০ মিটার উঁচু জল ও কাদার ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছিল ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত। বন্যায় মারা গিয়েছিলেন ২৭০ জন মানুষ।
এমনিতেও পাতাসো এবং পাতাসো হাহাই উপজাতির মানুষের সংখ্যা বেশ কমে এসেছে। তার মধ্যেই বন্যায় কেড়ে নিয়েছিল অধিকাংশের প্রাণ। তারপরেও অনেকে বেঁচে গিয়েছিলেন। কিছুদিন শহরে থাকার পর আবার ফিরে এসেছিলেন নিজেদের শিকড়ের টানে। কিন্তু এর মধ্যেই নতুন করে বন্যার সূত্রপাত। এই ৩ বছরে নদী থেকে আবর্জনা পরিষ্কার করেনি ‘ভ্যালে’ কর্তৃপক্ষ। আর তার ফলেই এবারের বন্যায় গোটা গ্রাম ভেসে গিয়েছে আবার। গ্রামের ২০টি পরিবারই ঘরছাড়া। আর তার চেয়েও আতঙ্কের বিষয়, গতবার জলে বিষাক্ত ধাতু মেশেনি। কিন্তু এবারে বন্যার জলের রং ঘন লাল। ব্রাজিল সরকারের পক্ষ থেকে উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষদের পুনর্বাসনের কথা বলা হয়েছে। এই বিষয়ে ভ্যালে কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নোটিশও পাঠানো হয়েছে।
তবে ভ্যালে কর্তৃপক্ষ তাঁদের দায়িত্ব স্বীকার করতে নারাজ। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা স্পষ্টভাবেই বলছেন, এই বন্যার পর আর কোনোভাবেই কৃষিকাজ সম্ভব নয়। এমনকি পারাওপেবা নদীর জলও আর ব্যবহার করার মতো অবস্থায় নেই। তবুও ভ্যালে কর্তৃপক্ষের বক্তব্য লৌহ আকরিক থেকে পরিবেশের কোনো ক্ষতি হয় না। অন্যদিকে পাতাসো এবং পাতাসো হাহাই উপজাতির মানুষরাও আশঙ্কা করছেন, শহরে গেলে তাঁদের সংস্কৃতির মূল হারিয়ে যাবে। একদিকে বেঁচে থাকার লড়াই, অন্যদিকে নিজেদের সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা – এই যুদ্ধের শেষ কোথায় জানেন না কেউই।
Powered by Froala Editor