গত শতকের তিনের দশক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা দেখে জীবন আর শুভচেতনা সম্বন্ধে একটা তীব্র অবিশ্বাস জন্ম নিয়েছে বিশ্বের সর্বত্র। বাংলার সমাজ-রাজনীতির পাশাপাশি কবিতাতেও আসছে চেতনার বাঁকবদল। রবীন্দ্রনাথের আস্তিক্যবোধ যেন হারিয়েছে তার গুরুত্ব, সমকালকে চিনে নিতে হবে নতুন ভাষায়, নতুন আদর্শে। প্রমথ চৌধুরীর ‘সবুজপত্র’ তখন বন্ধ, ‘কল্লোল’, ‘কালি কলম’-এর বক্তব্য বড্ড একপেশে। সেই সময়েই আবির্ভাব ঘটে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (Sudhindranath Dutta) এবং তাঁর পত্রিকা ‘পরিচয়’-এর (Parichay)।
তিনের দশকের আশেপাশেই বাংলা কবিতা পেয়েছে জীবনানন্দ দাশ, অমিয় চক্রবর্তী, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখ কবিকে। ভাষায় আর বোধে প্রত্যেকের উচ্চারণ ভিন্ন। রবীন্দ্রনাথের দর্শনকে ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার আপ্রাণ প্রচেষ্টা। বিদেশি কবির প্রভাবও দেখা যায় তাঁদের কবিতায়। সুধীন্দ্রনাথের কবিতা সম্পর্কে একটা অভিযোগ প্রথম থেকেই যে, তাঁর শব্দচয়ন দুর্বোধ্য। তৎসম, সমাসবদ্ধ আর অপ্রচলিত শব্দদের তিনি যেন বেছে নেন ইচ্ছাকৃত। সবক্ষেত্রে এই পরীক্ষা সফল হয়েছে কিছুতেই বলা যাবে না, তবু যেন এই শব্দমন্ত্রই চিহ্নিত করে ‘উটপাখী’-র মতো মরীচিকাকে।
অথচ, প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘তন্বী’-তে শব্দের জটিল থাকলেও, শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করে রবীন্দ্রনাথের কাছেই। ১৯৩০ সালে প্রকাশিত এই কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় কবি নিজে বলেছিলেন, “সমস্ত বইখানা খুঁজে, যদি কোনওখানে কিছুমাত্র উৎকর্ষ মেলে, তবে তা রবীন্দ্রনাথের রচনারই অপহৃত ভগ্নাংশ বলে ধরে নেওয়া প্রায় নিরাপদ।” এ যেন একপ্রকার কবিগুরুর কাছে ‘ঋণস্বীকার’। অবশ্য দুজনের মধ্যে যোগাযোগ ছিল আগে থেকেই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সাহিত্য নিয়ে তর্ক হত দুজনের মধ্যে। সুধীন্দ্রনাথ তখন সুভাষচন্দ্র বসুর ‘ফরওঅর্ড’ পত্রিকার দায়িত্ব ছেড়ে কাজ করছেন একটি ইনশিওরেন্স কোম্পানিতে। যদিও মনের মধ্যে চলছে নিজেদের একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনা।
সে সময়েই একদিন আলোচনা জমে উঠল রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। কবিতার ক্ষেত্রে বিষয় নির্বাচনের গুরুত্ব কতখানি? সুধীন্দ্রনাথের মত বিষয়ের পক্ষে। সকৌতুকে রবীন্দ্রনাথ বললেন, তাহলে মোরগ নিয়ে একটি কবিতা লিখে দেখা যাক, তা বিষয় টপকে কবিতার সর্বজনীন আবেদনকে ছুঁতে পারে কিনা। কয়েকদিন বাদে সুধীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকোয় এলেন ‘কুক্কুট’ নামের একটি কবিতা লিখে। মনের মধ্যে একটা চাপা উৎকণ্ঠা। যতই হোক, ‘চ্যালেঞ্জ’ নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। কিন্তু উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন তিনি, “না, তুমিই জিতেছ।” রবীন্দ্রনাথই কবিতাটা পাঠিয়ে দিলেন ‘প্রবাসী’ পত্রিকায়। পরে যেটি সংকলিত হয়েছিল ‘ক্রন্দসী’ কাব্যগ্রন্থে। আর ‘কুক্কুট’-ই সুধীন্দ্রনাথের প্রথম প্রকাশিত কবিতা।
আরও পড়ুন
‘অরূপকথাগামী’ বিনয় মজুমদারের কবিতা
রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদ পেয়ে সাহিত্যচর্চাই হয়ে উঠল তাঁর জীবনের একমাত্র ধ্যানজ্ঞান। কবিগুরুকে চিঠিতে লিখলেন, “কাব্যে ইনটেলেকচুয়ালিজম আনতে হলে প্রাধান্য দিতে হবে চিন্তাকে”। এদিকে বিতর্ক বাঁধল অন্য জায়গায়। সজনীকান্ত দাসের ‘শনিবাবের চিঠি’-র খ্যাতি ছিল বিখ্যাত সাহিত্যিকদের ব্যঙ্গবিদ্রূপ করার জন্য। সেই পত্রিকার প্রচ্ছদপটে থাকত একটি মোরগের ছবি। ‘কুক্কুট’ প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেন জ্বলে উঠলেন তারা। রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য এক নবাগত কবির সাহসকে চূর্ণ করা দরকার অবিলম্বে। প্রকাশিত হল ‘কুক্কুট’-এর প্যারোডি, “জেবাতৃক ক্ষপার্থ উদ্গাঢ় অন্ধকার’ ইত্যাদি শব্দবাচক একটি কবিতা।
আরও পড়ুন
যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের কবিতার ‘অগভীর’ দুঃখবাদের সন্ধানে
আদৌ এরকম কোনো উদ্দেশ্য ছিল না সুধীন্দ্রনাথের। পুরো ঘটনাটি যেদিকে মোড় নিল, তাতে বেশ অস্বস্তিই বোধ করলেন তিনি। তার কিছুদিন আগেই বিভিন্ন পত্রিকায় কবিতা প্রকাশে ব্যর্থ হয়েছেন। নতুন যুগের বক্তব্যকে সাদরে গ্রহণ করতে পারেনি ‘প্রবাসী’-ও। ফলে ঠিক করলেন, নিজেই একটি পত্রিকা প্রকাশ করবেন। গিরিজাপতি ভট্টাচার্যের সূত্র ধরে আসেন প্রবোধচন্দ্র বাগচী, নীরেন রায়, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, হিরণকুমার সান্যাল, বিষ্ণু দে, সুশোভন সরকার, হীরেন মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। একেবারে চাঁদের হাট! কিন্তু অর্থের জোগান আসবে কোথা থেকে? সেই ব্যবস্থা করে দিলেন ভাই হরীন্দ্রনাথ দত্ত। নিজের থেকে দিলেন আড়াইশো টাকা এবং পঞ্চাশ জন গ্রাহক জোগাড় করে উঠল আরো দুশো টাকা। সব মিলিয়ে ছশো টাকার ব্যবস্থা করে শুরু হল পথচলা। ১৯৩১ সালে প্রকাশিত হল ‘পরিচয়’ পত্রিকা। ত্রৈমাসিক পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যার পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল ১৪৫, দাম ১ টাকা। রবীন্দ্রনাথও প্রবন্ধ পাঠালেন দ্বিতীয় সংখ্যার জন্য। কলেবরে ও জনপ্রিয়তায় বেড়ে উঠতেই ১৯৩৭ সাল থেকে ষাণ্মাসিক করে দেওয়া হল ‘পরিচয়’-কে।
তা সত্ত্বেও কিন্তু ১৯৪৩ সালে পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব ছেড়ে দেন সুধীন্দ্রনাথ। কারণ, রাজনৈতিক বিষয়ের অতিরিক্ত বাড়বাড়ন্ত। তিনের দশকের ভারতে বহু রাজনৈতিক আন্দোলন ঘটেছে, অথচ সে নিয়ে ততটা মাথা ঘামায়নি ‘পরিচয়’। কিন্তু চারের দশকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, হিটলারের রাশিয়া আক্রমণ, এদেশে বামপন্থী শক্তির উত্থানের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে ভরে গেল ‘পরিচয়’-এর পাতা। যা কিছুতেই মিলছিল না পত্রিকার প্রাথমিক উদ্দেশ্যের সঙ্গে। শেষ পর্যন্ত ‘পরিচয়’ বিক্রি করে দেন সুধীন্দ্রনাথ। পরে অবশ্য যুক্ত হয়েছেন এম. এন রায়ের ‘মার্কসিয়ান ওয়ে’-তে। কাজ করেছেন স্টেটসম্যানের সহ সম্পাদক রূপেও। তাঁর মধ্যেই ছিল কবিতার চর্চা। ‘অর্কেস্ট্রা’, ‘ক্রন্দসী’, ‘উত্তরফাল্গুনী’, ‘সংবর্ত’, ‘দশমী’-তে খুঁজে পেলেন বাংলা কবিতার নতুন পরশ। রবীন্দ্র পরবর্তী আধুনিক কবিতার দ্বার যেমন একদিকে খুলে দিলেন তিনি, তেমনই ‘পরিচয়’-এর মাধ্যমে বাংলার শিক্ষিত সমাজকে এনে দিয়েছিলেন সংস্কৃতিচর্চার নতুন মঞ্চ।
ঋণস্বীকার :
দত্ত পরিবার, সুধীন্দ্রনাথ ও ‘পরিচয়’-এর প্রকাশ, হরীন্দ্রনাথ দত্ত
সম্পাদক সুধীন্দ্রনাথ দত্ত : পরিচয় কেন ছাড়লেন, নিরঞ্জন হালদার
Powered by Froala Editor