ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার প্রতিবাদে পত্রিকা প্রকাশ, গ্রেপ্তার কবি শম্ভু রক্ষিত

ঠিক কবে থেকে কলকাতা শহরের কাব্যপরিমণ্ডলের ভূগোল থেকে শম্ভু রক্ষিত হাওয়া হয়ে গেলেন, আমরা কেউ ঠাহর করিনি। শনিবারের কলেজ স্ট্রিটে কিংবা বইমেলার লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নে আর বড়জোর মফস্বলের কোনো পত্রিকা অনুষ্ঠানে তাঁর উপস্থিতি আমরা স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়েছিলাম। কিংবা ঠিক করে বললে, আপোসহীন এই কবির উপস্থিতিই ছিল হয়তো মূর্তিমান উপদ্রবের মতো।

শম্ভুদার নানান জীবনগল্প ছড়িয়ে আছে যুগ যুগ হাওয়ায় হাওয়ায়। সেই ষাট-সত্তরের সময়কাল থেকেই। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, একজন কবিকে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে তাঁর জীবনমিথ কতটা গুরুত্বপূর্ণ? আমরা কি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে দেখিনি যে তার কবিতা নিয়ে যত না চর্চা তার চেয়ে ঢের বেশি আগ্রহ তার মদ্যপানের গল্পগাছায়? ‘কবিকে খুঁজো না তার জীবনচরিতে’ – ঠিকই। তবু, আজ তার চলে যাওয়ার দিনে ব্যক্তিগত ছায়াপাত অগ্রাহ্য করতে পারি না। কিংবা খানিকটা পক্ষপাত নিয়েই ঝুঁকে পড়ে দেখি যে এই কবির জীবনের সঙ্গে তার কবিতার সংযোগ আছে আবার নেই-ও। 

শম্ভু রক্ষিতের কবিতার অন্যতম অনুরাগী কবি গৌতম বসুর সঙ্গে আমার নিজের মত মিলিয়ে দেখেছি। ‘প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না’ (১৯৭৩) – এই অসামান্য বইটিই শম্ভু রক্ষিতের শ্রেষ্ঠ কাজ। কলেজজীবনে দৈবাৎ হাতে এসে পড়েছিল এই বই। দৈবাৎ দ্বিবিধ অর্থে – সেসময় (২০০৩-০৪ নাগাদ) উপরিল্লিখিত জায়গাগুলোয় শম্ভু রক্ষিতকে অহরহ দেখতে পাওয়া গেলেও তাঁর বইপত্রগুলি কোনোদিনই সুলভ ছিল না। সন্ধানী পাঠক ছাড়া ওই বয়সে এই বই আমার হাতে আসার কথা নয়। আমরা তখন নবীন। হাতে যা-ই আসে গোগ্রাসে গিলছি। এই বই আমাদের ছোটো বন্ধুবৃত্তে হাতে হাতে ঘুরেছিল। ভাগ্যিস এসেছিল হাতে, তাই, আপনপথের পথিক এই কবির কবিতাকে তার জীবনযাপনের মিথ ছাড়িয়ে পড়তে পেরেছিলাম। ‘প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না’ পড়তে পড়তে ঢুকে পড়া যায় কবির নিজস্ব ভাষাদুনিয়ায়, এক আচ্ছন্ন কবিতাপাঠের অভিজ্ঞতায়। বিনয় মজুমদারকে মনে পড়ে বটে, কিন্তু শম্ভু রক্ষিতের কবিতা আপন মুদ্রাদোষেই আলাদা। কিন্তু এই বই থেকে একথা মোটেও টের পাওয়া যায় না যে এখান থেকে কীরকম পালটে যাবে তার কবিতা, হয়ে উঠবে আরও ভণিতাহীন অথচ তির্যক। তাকে আর আমাদের কাব্যপাঠের অভ্যস্ত সুখানুভূতি দিয়ে ধরে ফেলা যাবে না। তাঁর জীবনযাত্রার মতোই তার কবিতাও হয়ে উঠবে অস্বস্তিকর। পূর্বাপর শম্ভু রক্ষিতের কয়েকটি বইয়ের নামগুলি পড়লেও একটা আঁচ পাওয়া যাবে – সময়ের কাছে কেন আমি বা কেন মানুষ (১৯৭১), প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না (১৯৭৩), রাজনীতি (১৯৭৫), পাঠক, অক্ষরগুলি (১৯৮২), আমার বংশধররা (১৯৯৭), আমি কেরর না অসুর (২০০৪) ইত্যাদি। প্রায় সব বইই হয় তাঁর নিজস্ব পত্রিকা-প্রকাশনা ‘মহাপৃথিবী’ থেকে নতুবা ‘দি সী বুক এজেন্সি’ থেকে প্রকাশিত। 

এর মধ্যে ‘রাজনীতি’ বইটায় ধরা আছে আগুনখেকো সত্তরের জরুরি অবস্থার আঁচ। এই পর্ব বাদ দিয়ে শম্ভু রক্ষিতের জীবনকথা লেখা যাবে না। অদ্রীশ বিশ্বাস সহ আরও অনেকের স্মৃতিচারণেই ধরা আছে রোমাঞ্চকর সেইসব ঘটনার কথা। জরুরি অবস্থায় ইন্দিরা গান্ধীর সেন্সারশিপ আইনের বিরুদ্ধে কিছু করা দরকার ভেবে জ্যোতির্ময় দত্ত শুরু করলেন ‘কলকাতা’ পত্রিকা। তার সংযুক্ত সম্পাদক ছিলেন শম্ভু রক্ষিত। গৌরকিশোর ঘোষের যে লেখা প্রতিষ্ঠিত কাগজ ছাপতে চায়নি তা ছেপেছিল তাদের ‘কলকাতা’। স্বভাবতই সরকারি রোষানলে পড়েন তারা। শম্ভুদা নানান বিচিত্র উপায়ে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে বেড়াতেন। শোনা যায় কুড়ি-পঁচিশজনকে পুলিশ প্রেফতার করেছিল শম্ভু রক্ষিত ভেবে। শেষমেশ কবি ধরা পড়েন শিয়ালদহ স্টেশনের কাছে। জেল হয় তাঁর। এসময় তিনি থাকতেন হাওড়ার কদমতলায়, পড়াশোনা নরসিংহ দত্ত কলেজে। টুকটাক করেছেন অনেক কিছু, কিন্তু কবিতা লেখা ও পত্রিকা সম্পাদনা ছাড়া বিশেষ কিছু করেননি সারাজীবন। 

কলকাতায় যেসময় আমার সঙ্গে পরিচয় হচ্ছে কবির তখন তিনি ফিরে গেছেন গ্রামের বাড়ি, পূর্ব মেদিনীপুরের বিরিঞ্চিবেড়িয়ায়। অনেককাল পরে, আমার চাকরি হল ঘটনাচক্রে হলদিয়ায়। একদিন ট্রেনের কামরায় দেখা শম্ভুদার সঙ্গে, ফিরছেন রাতের হলদিয়া লোকালে, যেমনটা তিনি করে আসছেন গত পঁচিশ বছর। তারপর নভেম্বরের এক পড়ন্ত বিকেলে সাইকেল করে পৌঁছে যাই শম্ভু রক্ষিতের বাড়ি। দেখি, ষাটের এই স্বতন্ত্র ডিকশন, সম্ভ্রমজাগানো জীবনবোধের কবি রেললাইনের ধারে নয়ানজুলিতে মাটি কাটছেন, ঝুড়িতে তুলছেন, বয়ে আনছেন, বাড়ির সামনে ফেলে দিচ্ছেন – কেননা রাস্তা হবে। কবির বাড়ি তখন শতচ্ছিন্ন। একটু উঠোন, তার চারদিকে অনেক গাছ। অনেক ছায়া। চোখে আবেগ এসে যায়। এখন অবশ্য বাড়ি পাকা হয়েছে। মাটিমাখা হাতে শম্ভুদা আমার সামনে উবু হয়ে। আমি কবিকে তার লেখায় মিথের ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন করি। কবি কেবল হাসেন, কথা ঘোরান। গর্ব করে বলেন নিজের সন্তানসন্ততি – কীর্তিকর আর দিওতিমার কথা। আমাকে বলেন, একদিন মনে হল গ্রামের বাড়িতে, বাপ-পিতেমোর ভিটেয় ফিরে যাই। আমি ভাবি, বিরিঞ্চিবেড়িয়ার এই বাড়ি থেকে কীভাবে এত মিথ, এত রেফারেন্স আসে কবিতায়! কোথায় তার সুস্থিতি, পড়ার ঘর, বই-আলমারি, বন্ধু-সাহচর্য! কীভাবে চল্লিশ বছর ধরে লিটল ম্যাগাজিন! যেন অটল একটা বর্ম দিয়ে প্রতিরক্ষা সাজিয়ে রেখেছেন শম্ভু রক্ষিত। তাঁর বাড়ির ওই ছায়াময় উঠোনটাকেই মহাপৃথিবী বলে বোধ হতে থাকে আমার।  

শেষ কয়েকবছর অসুস্থই ছিলেন। বয়সের ভারে কলকাতা থেকে বিদায় নিয়েছিলেন অনেক আগেই। তবু, শম্ভু রক্ষিত বাংলা কবিতার এক বর্ণময় ঘটনা। তিনি ছিলেন ঋজু। আপোসহীন। অন্য অনেকের মতো নিজের দারিদ্র্যকে হাতিয়ার করেননি কখনও। শম্ভু রক্ষিত এক অমীমাংসিত ধাঁধা।

‘মহাপৃথিবী’র সম্পাদক হিসেবে বাংলা আকাদেমির মধুপর্ণী পুরস্কার পেয়েছিলেন বটে, কিন্তু কেবল সেই সম্পাদক পরিচয়েই যেন শম্ভু রক্ষিতের পরিচয় শেষ না হয়ে যায়। কবির কদর বাড়ে মৃত্যুর পর। শম্ভু রক্ষিতের কবিতাযাত্রার পথ ধরে পাঠক হাঁটুন। তার জীবনগল্প ছড়িয়ে পড়ুক নতুন প্রজন্মের ভেতর। জীবিতাবস্থায় অনেকেই তাঁকে না গিলতে পেরেছেন না উগরোতে। শম্ভু রক্ষিতের কবিতা নিয়ে এবার একটা হেস্তনেস্ত হোক। 

ঋণঃ গৌতম বসু

Powered by Froala Editor