প্রয়াত কবি প্রভাত চৌধুরী, শোকস্তব্ধ অনুরাগীরা

‘উত্তরাধুনিক’ বা ‘পোস্টমডার্ন’ (Post Modern) – বিশ্ব সাহিত্যে তো বটেই, বাংলা সাহিত্যেও আজ বহুল আলোচিত একটি শব্দবন্ধ। তবে উত্তরাধুনিক সাহিত্য মানে যে শুধুই বিদেশী সাহিত্যের ছায়া অবলম্বন করে চলা নয়, বরং তার একটি নিজস্ব আঞ্চলিক চেহারাও থাকতে পারে, সেটা মনে করিয়ে দেওয়ার মতো সাহিত্যিক খুব বেশি জন্মাননি। আর সেইসব সাহিত্যিকদের সামনেই একটা নতুন দরজা খুলে দিয়েছিলেন কবি প্রভাত চৌধুরী (Prabhat Chowdhury), তাঁর ‘কবিতা পাক্ষিক’ পত্রিকার ভিতর দিয়ে। সাহিত্যিকের চেয়েও তাই তাঁর বড়ো পরিচয় একজন সাহিত্য কাণ্ডারি হিসাবে।

বাংলা সাহিত্যের জগতকে রিক্ত করে আজ আবারও এক নক্ষত্রের পতন হল। দীর্ঘ রোগভোগের পর মারা গেলেন কবি প্রভাত চৌধুরী। গতবছরের মাঝামাঝি থেকেই তাঁর শারীরিক অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে। কিডনি বিকল হয়ে পড়েছিল তাঁর। সপ্তাহে তিনদিন করে চলত ডায়ালিসিস। এর মধ্যেই গত ৯ জানুয়ারি করোনা ভাইরাস বাসা বাঁধে শরীরে। সেই থেকেই চিকিৎসা চলছিল। মাঝে স্বাস্থ্যের কিছুটা উন্নতি হলেও শেষ পর্যন্ত হার মানতে হয় চিকিৎসকদের। আজ সন্ধ্যায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন কবি।

১৯৪৪ সালে বাঁকুড়া জেলার হাটকেষ্টনগরে জন্ম প্রভাত চৌধুরীর। ’৬০-এর দশকে কৃত্তিবাস পত্রিকায় কবিতা প্রকাশের ভিতর দিয়ে সাহিত্যের জগতে পা রাখেন তিনি। এরপর ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘শুধু প্রেমিকার জন্য’। এই সময়েই বেশ কিছু পত্রিকা সম্পাদনা এবং নতুন নতুন পত্রিকা উদ্যোগও শুরু করেন তিনি। প্রায় ২ দশক নিরলস চর্চার পর হঠাৎই আশির দশকে লেখালিখি সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। মনে মনে হয়তো তখন থেকেই খুঁজছিলেন একটি নতুন মঞ্চ। প্রায় ১০ বছর সাহিত্যের জগত থেকে দূরে সরে থাকার পর ১৯৯৩ সালে আবার শুরু করলেন নতুন পত্রিকা উদ্যোগ। নাম রাখলেন ‘কবিতা পাক্ষিক’।

পাশাপাশি প্রকাশিত হতে থাকে তাঁর কাব্যগ্রন্থ। ১৯৯৪ সালে ‘সাদা খাতা’, ১৯৯৭ সালে ‘সাক্ষাৎকার’, ১৯৯৮-এ ‘আবার সাক্ষাৎকার’। এরপর একে একে প্রকাশ পায় ‘নোটবই’, ‘উত্তরপর্বের কবিতা’, ‘এইসব হল্লাগুল্লা’, ‘সুসমাচার’ এবং ‘প্রভৃতি’।

প্রভাত চৌধুরী বলেছিলেন, কবিতা পাক্ষিকের ভিতর দিয়ে তিনি বাংলা কবিতার সামগ্রিক যাত্রার একটা ছবিই তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ক্রমশ তার প্রাণ হয়ে উঠল উত্তরাধুনিক কবিতা। আর তা হয়েছিল স্বাভাবিকভাবেই। কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে নয়। তবে কবিতা তো শুধুই আঙ্গিকনির্ভর শিল্প নয়। সাহিত্যের ভাষ্যও যে গুরুত্বপূর্ণ, তা মনে করিয়ে দিতে ভোলেননি কবি। তিনি স্পষ্টভাবেই বারবার বলেছেন, কবিতা তাঁর নিজের মত প্রকাশের জায়গা। আর তাঁর বক্তব্যই কবিতার আঙ্গিকও তৈরি করে দেয়। অকপটে স্বীকার করেছেন, বিদেশি উত্তরাধুনিক তাত্ত্বিকদের লেখা তিনি পড়েননি। পড়ার আকর্ষণও বোধ করেননি। বরং বাংলা সাহিত্যের মধ্যে উত্তরাধুনিক প্রবণতাকেই চিনতে চেয়েছেন বারবার।

বয়স হয়েছিলই। শরীরে বাসা বেঁধেছিল নানা রোগ। আর তার মধ্যেই করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতি আরও জটিল করে তোলে। অবশ্য চিকিৎসার সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন বহু অনুজ সাহিত্যিক। কিন্তু সেই সব চেষ্টাই ব্যর্থ হল। বাংলার সংস্কৃতি জগতের ঝরে যাওয়া মহীরুহদের নামের তালিকায় যুক্ত হল আরেকটি নাম।

Powered by Froala Editor