প্রয়াত কবি নাসের হোসেন, শেষ হল বাংলা কবিতাচর্চার একটি অধ্যায়

৩ ডিসেম্বরের একটি ফেসবুক পোস্ট। বাইরের ভরা রোদের আলো এসে পড়েছে সামনের টেবিলে। সেখানেই মন দিয়ে একটি প্রুফ দেখে চলেছেন একজন প্রৌঢ়— কবি নাসের হোসেন। ছবিটি আজও আন্তর্জালে জীবন্ত; কিন্তু মানুষটি আর নেই। আজ সকালেই কোঠারী হাসপাতালে প্রয়াত হলেন আটের দশকে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম উল্লেখযোগ্য কবি নাসের হোসেন। 

১৯৫৮ সালের ২ জানুয়ারি কলকাতাতেই জন্ম তাঁর। কিন্তু মহানগরের জীবনের বাইরে বারবার ছুটে গেছেন নাসের হোসেন। জীবনের অনেকটা পর্যায় জুড়ে ছিল বহরমপুর। সেখানেই পড়াশোনা, কলেজ সবকিছু। পরবর্তীতে কাজের সূত্রে আবারও কলকাতাবাসী হলেও, বহরমপুর তাঁর আত্মার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গিয়েছিল। ঠিক তেমনই অংশ হয়ে গিয়েছিল সাহিত্য। বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজে পড়ার সময়ই ‘দ্য লাস্ট পেজ’ নামের পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন। পাশাপাশি চলতে থাকে কবিতা চর্চা। 

সত্তরের দশক। বাংলার এক ভয়ংকর সময়। হাজার হাজার স্বপ্নের আগুন জ্বলছে। এমন পরিমণ্ডলেই প্রথম কবিতা প্রকাশ পেল নাসের হোসেনের। শুরু হল একেবারে অন্যধারার পথ চলা। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অপারেশন থিয়েটার’ও প্রকাশ পেল। সময় এগোতে লাগল, আর বাংলা সাহিত্যের জগতে নিজের জায়গাটিও সুনির্দিষ্ট করলেন কবি নাসের হোসেন। বরাবরের মৃদুভাষী, শান্ত একটি চেহারা। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সেই দৃশ্যই বারবার ফিরে আসছিল সুকল্প চট্টোপাধ্যায়ের মুখে। “সদাহাস্যময় এই মানুষটিকে সবসময় বইয়ের জগতে, বইমেলায় ঘুরে বেড়াতে দেখেছি। অনেকসময় আড্ডা হয়েছে। একেবারে নির্বিরোধী মানুষ ছিলেন। কবিতাপাক্ষিকের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত ছিলেন। এই পত্রিকার যে ভাবনা, যে দর্শন সেটাকে নাসের দা অনেকটাই ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। আমরা যখন কবিতা লিখতে এসেছি তখন ওঁকে বেশ সক্রিয় দেখি। সেই অবস্থাতেই কাজ করতে করতে চলে গেলেন। খুবই খারাপ লাগছে।”

নাসের হোসেনের জীবনের কথা আসলে ‘কবিতাপাক্ষিক’ পত্রিকাটিও অবধারিতভাবে চলে আসবে। প্রভাত চৌধুরী এবং নাসের হোসেন— এই দুজনের হাত ধরেই এই পত্রিকাটি বাঙালি পাঠকের অন্দরে ছড়িয়ে পড়েছিল। আর সেখানেই অবতারণা ‘অর্জুন মিশ্র’-এর; নাসেরবাবুর ছদ্মনাম। চার বছর সহ-সম্পাদকও ছিলেন ‘কবিতাপাক্ষিক’-এর। বইমেলায় পত্রিকার স্টলে ঢুকলে পাঠকদের অভ্যর্থনা জানাত নাসের হোসেনের সেই স্মিত, আন্তরিক হাসি। কবিতার সূত্রে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। ১৯৮৭ সালে সার্ক সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়ে কবিতা পড়েন। বিশেষ করে তাঁর ‘ভারতবর্ষ’ কবিতাটি অনেক জায়গায় সমাদর পায়। ইউনেস্কোর বিশেষ সংকলনেও জায়গা পায় লেখাটি। বিভিন্ন পুরস্কারের পাশাপাশি, বেশ কিছু বিদেশি ভাষায়ও অনূদিত হয়েছে তাঁর কবিতা। 

কবি নাসের হোসেনের পাশাপাশি অবশ্যই চলে আসবে চিত্রশিল্পী নাসের হোসেনের কথা। কলেজে পড়াকালীনই অঙ্কনচর্চা চলে তাঁর। পরে ১৯৭৪ সালে নিজের কৃষ্ণনাথ কলেজেই তাঁর ছবির প্রথম প্রদর্শনী আয়োজিত হয়। দশ বছর পর, ১৯৮৪ সালে বিড়লা অ্যাকাডেমি অফ আর্ট অ্যান্ড কালচারে আরম্ভ হয় নাসের হোসেনের একক চিত্র প্রদর্শনী ‘দেবী ও পোড়া শহর’। সেই প্রদর্শনীতে এসেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়; সঙ্গে স্বয়ং মকবুল ফিদা হুসেন। নাসের হোসেনের আঁকা ছবি দেখে রীতিমতো অভিভূত হয়ে পড়েন তিনি। একটিই মন্তব্য করেন তিনি— ‘সিনসিয়ার অ্যান্ড গ্রেট’। 

কবিতা আর ছবি নিয়েই ছিল তাঁর দীর্ঘ জীবন। একা একাই কেটে গেছে। অবশ্য একা বলাটা ভুল; কবিতা ছিল যে সঙ্গে! নিজের কাজ নিয়েই ডুবে থাকতেন। দীর্ঘ বেশ কয়েক মাস ধরে অসুস্থ ছিলেন তিনি। ডিসেম্বরের শুরুতে ‘কবিতাপাক্ষিক’-এর প্রুফ দেখার ছবি দেখে অনেকেই নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন। নাসের দা আবারও ফিরে এসেছেন কবিতার মধ্যে— এর থেকে স্বস্তির কিছু হয় না! কিন্তু আজ সকালেই যেন বজ্রপাত। কবিতাপাক্ষিকের প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক প্রভাত চৌধুরীর ফেসবুক পোস্ট সবকিছু থামিয়ে দিল। শুধু মনে পড়ছে তাঁর ‘শূন্য’ কবিতাটির শেষ দুটো লাইন— 

‘ভেসে আছি, ওই যে দূরে পৃথিবী, চাঁদ আর গ্রহতারকা
হাতের দিকে তাকালাম- শূন্য। পায়ের দিকে তাকালাম- শূন্য।’

ছবি ঋণ - শুভঙ্কর চট্টোপাধ্যায় (ফেসবুক)

Powered by Froala Editor

Latest News See More