কলকাতার বুকে একটি ছোট্ট ঘরে তখন বসবাস করছেন জীবনানন্দ দাশ। তখনও তাঁর নাম সেভাবে ছড়িয়ে পড়েনি সাহিত্যের ময়দানে। কিছু ছোটো পত্রিকায় তাঁর লেখা বেরিয়েছে। সেরকমই একটি পত্রিকা ‘কল্লোল’-এ বেরোল একটি কবিতা - ‘নীলিমা’। একেবারে অন্যরকম, অন্য স্বাদ তাঁর। তরুণ লেখকদের মধ্যে একটা সাড়া পড়ে গেল। যথাসময় কবিতাটি ঢাকার একজন তরুণ কবিরও নজরে এল। তাড়াতাড়ি ঢাকা থেকে ছুটে এলেন কলকাতায়। ‘কল্লোল’-এর দফতরে কাজ করছেন আরেক তরুণ লেখক, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে সেই তরুণ কবি, বুদ্ধদেব বসু চলে এলেন জীবনানন্দের বাসায়। একটাই অভিপ্রায়, ‘নীলিমা’র কবির সঙ্গে আলাপ করতে হবে…
বুদ্ধদেব বসুকে ঠিক কোন বাঁধনে বাঁধা যায়? তিনি কি কবি? না ঔপন্যাসিক? এসবের কথা এলে চলে আসবে অনুবাদ, প্রবন্ধের কাজ। ঠিক কোথায় তাঁর সীমানা শুরু আর কোথায় শেষ, সেটা হয়তো এই ছোট্ট লেখায় দেখানো সম্ভব নয়। বাংলার বহু কবি-লেখক, যারা পরবর্তীকালে স্বনামধন্য হয়েছেন, তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই বুদ্ধদেবের অবদানের কথা স্বীকার করেছেন। রবীন্দ্রোত্তর যুগের বাংলা সাহিত্যকে এক সূত্রে বেঁধেছেন তিনি; সর্ব অঙ্গে। সেখানে যেমন তিনি সহযোদ্ধা, তেমনই একজন নিবিষ্ট সাধক; একইসঙ্গে সতর্ক অভিভাবকও…
তাঁর জীবনেও পদে পদে ঘটেছে বাঁকবদল। জন্মের পরপরই চলে গেলেন মা। তারপরই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন বাবা। একেবারে নিরুদ্দেশ! বেড়ে ওঠার গাছ দুটো ছোটো বয়সেই কে যেন উপড়ে দিল। একটা সময় দাদুকেও ছিনিয়ে নিল ক্যানসার। বুদ্ধদেব এখন একা, একেবারে নিঃস্ব। সম্বল বলতে কেবল দিদিমা। না, আরও একটি জিনিস ধীরে ধীরে তাঁর রাতদিনের সঙ্গী হয়ে উঠল— কবিতা। ছোটো বয়স থেকে সাহিত্যের কাছেই যেন নাড়া বাঁধলেন। পরবর্তীকালে এই জগতই যে হয়ে উঠবে তাঁর সাধনক্ষেত্র, বুঝতে পারছিলেন কি?
আইএ পরীক্ষা পেরিয়ে গেল। যথেষ্ট ভালো ফলাফল করলেন বুদ্ধদেব বসু; বৃত্তিও পেলেন। কী করবেন এই টাকা দিয়ে? মাথায় ঘুরছে কবিতা। স্কুলে পড়ার সময়ই হাতে লেখা দুটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন তিনি। এবার একেবারে জোর কদমে নামতে হবে। বৃত্তির টাকা দিয়েই ছাপলেন তাঁর নতুন পত্রিকা। বুদ্ধদেব বসু’র সঙ্গে যৌথ সম্পাদনায় অজিত দত্ত; ঢাকা থেকেই প্রকাশিত হল ‘প্রগতি’ সাহিত্য পত্রিকা। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এই পত্রিকার গুরুত্ব ঠিক কী, সেটা বোঝাতে একটি ছোটো ঘটনার উল্লেখ করা দরকার। এই পত্রিকাতেই প্রকাশিত হল জীবনানন্দ দাশের ‘বোধ’ কবিতাটি। দীর্ঘ এই কবিতাটির হাত ধরেই কার্যত আধুনিক যুগের সূত্রপাত। পথ চলা জীবনানন্দ দাশ নামক এক বিস্ময়, নির্জন কবির। আর এই সাহসটা দেখিয়েছিলেন বুদ্ধদেবই। ততদিনে ‘নীলিমা’র সূত্রে কবির সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেছে তাঁর। ‘বোধ’ কবিতাটি যেন সমস্ত আগল ভেঙে দিল। আর সেই মুহূর্তের সাক্ষী থাকলেন স্বয়ং বুদ্ধদেব, এবং তাঁর ‘প্রগতি’ পত্রিকা।
এই সব কর্মকাণ্ড যখন চলছে, তখন তিনি সবে কুড়ি। ম্যাট্রিক পড়ার সময়ই বেরিয়ে গেছে প্রথম বই। তারপর জীবনে হাজির হয়েছে আরও একটি পত্রিকা- ‘কল্লোল’। যার সঙ্গে বুদ্ধদেবের নাম জড়িয়ে থাকবে আজীবন। পরে তিরিশের দশকে প্রেমেন্দ্র মিত্র, সমর সেনের সঙ্গে শুরু হল আরেক পত্রিকার যাত্রা— ‘কবিতা’। এই তিনটে পত্রিকাই ছিল আধুনিক কবিতার ও কবিতের জায়গা। বাংলা সাহিত্যকে রবীন্দ্রপ্রভাব থেকে বের করে আনতে হবে, এক জায়গায় স্থির হয়ে পড়লে তো সেটা ভালো না— এমনটাই মনে করতেন বুদ্ধদেব। এমনকি, একটা সময় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও মতপার্থক্যে যেতে দ্বিধা করেননি তিনি। ‘আধুনিক সাহিত্য’ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ধারণার বিরোধিতা করেছিলেন তিনি। সেই সময়ই তাঁর লেখা বেশ কিছু উপন্যাস নিয়ে শুরু হয়েছিল বিতর্কের ঝড়। এমনকি, পুলিশের কাছেও নালিশ জানানো হয়। কিন্তু বুদ্ধদেব বসু ছিলেন নিজের জায়গায় অনড়।
তবে সেসবই ছিল সাহিত্যের প্রতি দায়বদ্ধতা। ব্যক্তিগতভাবে বারবার ফিরে গেছেন সেই মানুষটির কাছে। রবীন্দ্রনাথের কবিতা, ভাবনা, সাহিত্য নিয়ে বলেছেন সব জায়গায়; প্রবন্ধও লিখেছেন। এমনকি, বিয়ের পর জোড়াসাঁকোতেও গিয়েছিলেন বুদ্ধদেব ও প্রতিভা বসু। তখন সেরকম কোনো কাজ করেন না বুদ্ধদেব। চাকরি নেই, জীবনের গতির ঠিক নেই, কেবল লেখালেখি করেই চলে দিন; এই ছেলের সঙ্গে মেয়ে রানু’র বিয়ে হবে? সবাই চিন্তিত। অথচ পরে সেই ছেলেটিকেই বিয়ে করলেন মেয়ে। তৈরি হল বাংলা সাহিত্য জগতের এক অমর দম্পতির। বুদ্ধদেব-প্রতিভা নাম দুটিও যেন একইসঙ্গে উচ্চারিত হতে লাগল পরে। তাঁদের ঘিরেই জন্ম নিল কবিতার গাছ। তৈরি হল নতুন ভুবন…
আরও পড়ুন
মুসলমান কবিরা লিখলেন শ্যামাসঙ্গীত, কালিকামঙ্গল - বাংলার ভক্তি ও মিলনের ইতিহাস
একদিন রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন বুদ্ধদেব আর প্রতিভা। হঠাৎই নজরে এল একটি বিক্রয়যোগ্য বাড়ি। তখন বাড়ি নিয়েও সমস্যা চলছে। আচ্ছা এখানে যদি থাকা যায়? শেষ পর্যন্ত বসু দম্পতি চলে এলেন ২০২, রাসবিহারী এভিনিউয়ের বাড়িতে। নিজের সাধের পত্রিকার নামেই নাম দিলেন বাড়িটার— ‘কবিতা ভবন’। বাংলা সাহিত্যের এক নির্ভরযোগ্য আস্তানা। হাজির হচ্ছেন নতুন প্রজন্মের কবিরা। শিক্ষকতা, অধ্যাপনা, বিদেশ ভ্রমণের পাশে এই বাড়িটি যেন হৃদয়ের অংশ হয়ে উপস্থিত হল। শুরুর দিকে অর্থসংকটও ছিল প্রবল। কিন্তু তার মধ্যেই চলত জীবনের উদযাপন। মেয়ে দময়ন্তীর জন্মদিন। এদিকে উপহার দেওয়ার সাধ থাকলেও, সাধ্য নেই। কী করবেন? উপায় বার করলেন বুদ্ধদেব। রাতারাতি আস্ত একটি কবিতা লিখে রেখে দিলেন মেয়ের বালিশের নিচে। সকালবেলায় উঠে দময়ন্তীর হাতে পড়ল সেই উপহার।
এমনই ছিলেন বুদ্ধদেব বসু। বাংলা সাহিত্যের এক দরাজ চালচিত্র। আপাদমস্তক সাহিত্যের শরীর; যেখানে ক্ষণে ক্ষণে হাজির হয় শব্দেরা। আর বুদ্ধদেব দক্ষ দর্জির মতো সেসব বুনে চলেন। তাঁত চালানোর আওয়াজ আসে রাতের বেলা। মনের ভেতর বেজে ওঠেন রবীন্দ্রনাথ। যিনি তাঁর অন্তিম মুহূর্তেও ছিলেন সঙ্গী।
তথ্যসূত্র-
১) ‘একজন কমলালেবু’/ শাহাদুজ্জামান
২) ‘বুদ্ধ-প্রত্যয়’, অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দবাজার পত্রিকা
৩) ‘বুদ্ধদেব বসু: কবিতাভবন এবং রবীন্দ্রনাথ’, লীনা দিলরুবা
আরও পড়ুন
কবিতা কি বাবার লিখে দেওয়া নাকি মায়ের নকল - 'বুনো' নবনীতা ও উত্তরাধিকারের গল্প
Powered by Froala Editor