এই বছরটা যেন শুধুই দুঃসংবাদের। হারিয়ে যাওয়া ব্যক্তিত্বদের তালিকাকে বাড়িয়েই চলেছে ২০২০। বাংলার সাহিত্যজগতে আরও এক নক্ষত্রপতন হল এবার। চলে গেলেন বিশিষ্ট কবি, সাহিত্যিক, অনুবাদক অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। সুদূর জার্মানিতে থাকতেন দীর্ঘদিন। মারাও গেলেন সেখানেই, স্থানীয় সময় রাত নটায়। বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর।
১৯৩৩ সালে ৬ অক্টোবর কলকাতায় জন্ম অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের। পড়াশোনা শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীতে। পরবর্তীতে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ এবং প্রেসিডেন্সি কলেজে করেছেন উচ্চশিক্ষার পঠনপাঠন। তারপর শুরু হয়েছিল গীতিকথা এবং বাংলা কবিতা নিয়ে গবেষণা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
তবে কবিতাচর্চা করতে গিয়েই বাংলা ছাড়াও একাধিক ভাষা আপন করে নেন তিনি। লিটল ম্যাজাগিনের সঙ্গে জুড়ে দেন পাশ্চাত্য সাহিত্যকে। বহু লিটল ম্যাগাজিনেই আন্তর্জাতিক নানান ভাষার বাংলা অনুবাদ দেখতে পাওয়া যেত তাঁর সৌজন্যে। প্রথম বই ‘ভিনদেশী ফুল’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৭ সালে। ছিল একগুচ্ছ ফরাসি কবিতার অনুবাদ। তবে শুধু ফরাসিই নয়। অনুবাদ করেছেন জার্মান ও ইংরাজি সাহিত্যও। পশ্চিমবঙ্গের প্রান্তিক সাঁওতালি ভাষা ও সংস্কৃতিকেও বাংলাতে পরিচিত করে তুলেছিলেন তিনিই। বিভিন্ন কবিতা এবং সাঁওতালি ভাষার আঞ্চলিক নাটক অনুবাদ করেছিলেন বাংলায়।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ ১৪ বছর অধ্যাপনা করেছেন তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে। তারপর জার্মানির হামবোল্ড ফাউন্ডেশন, হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটেও করেছেন অধ্যাপনার কাজ। সেইসঙ্গে সমান তালেই চলেছে গবেষণা এবং সাহিত্যচর্চা। জার্মানিতে বিভিন্ন সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন এই বাঙালি সাহিত্য-নক্ষত্র। অভিনব সেই কাজের জন্য ১৯৮৫ সালে সম্মানিত হয়েছিলেন হোয়েথে মেডেলে।
এছাড়াও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুধা বসু পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কার, প্রবাসী ভারতীয় সম্মান, সাহিত্য অ্যাকাদেমী, রবীন্দ্র পুরস্কার পেয়েছেন অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। লিখেছেন ২০টিরও বেশি কবিতার বই। পাশাপাশি রয়েছে অনুবাদ, ভাষাভিত্তিক গবেষণামূলক প্রবন্ধের গ্রন্থও।
ষাটের দশক থেকে বাংলায় আন্তর্জাতিক সাহিত্যের পথিকৃৎ ছিলেন অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত এবং মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। দুই নক্ষত্রই একই সঙ্গে অধ্যাপনা করেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাংলা সাহিত্যভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি গড়ে তুলেছিলেন তুলনামূলক সাহিত্যের বুনিয়াদও। চলতি বছরেরই আগস্ট মাসে বাঙালি হারিয়েছিল মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে। এবার আরও এক ধাক্কা বাংলা সাহিত্যে। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের চলে যাওয়ায় বাংলা অনুবাদ সাহিত্যে অভিভাবকের শূন্যতাই আরও প্রকট হল যেন।
আরও পড়ুন
ছুটির দিনে কফি হাউসে বসেই পত্রিকা সম্পাদনা করতেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
"আমার ঘরের চেয়ে আরো ভালো, আরো/ নিকোনো উঠোন তার, পাখিবসা বিরাট পাঁচিল!/ ওখানে আমিও যাব, কে আমায় নিয়ে যেতে পারো?" কবিতার মধ্যে দিয়েই বারবার মুক্তির পথ খুঁজেছিলেন অলোকরঞ্জন। কবিতাই দিয়েছিল তাঁকে এক নির্মেদ প্রশান্তি। তবে তাঁর বিশ্বাস ছিল কবিতাকে কিছুই ফিরিয়ে দিতে পারেননি তিনি। সকলের আড়ালে হয়তো আবার নতুন করেই খুঁজতে গেলেন তাঁকে। নতুন করে আবিষ্কার করতে গেলেন নিজের ঘরের থেকে আরও ভালো ঘর...
Powered by Froala Editor